মালয়েশিয়ায় সুনামগঞ্জের দেবাংশুর বাঁচার লড়াই


প্রকাশিত: ১০:৩২ এএম, ২৬ মে ২০১৬

স্বপ্নের দেশ মালয়েশিয়ায় নিয়ে যাওয়ার কথা বলে নৌকায় তোলা হয়েছিল বাংলাদেশের সুনামগঞ্জের দেবাংশু পালকে। এরপর দুই মাস সাগরে এক ভয়ংকর অভিজ্ঞতার ভেতর দিয়ে মালয়েশিয়া পৌঁছান তিনি।  

বৃহস্পতিবার সুনামগঞ্জের গৌরারং ইউনিয়নের ইসবপুর গ্রামের শ্রি বিরেন্দ্র চন্দ্র পালের ছেলে দেবাংশুর সঙ্গে এ প্রতিবেদকের কথা হয়।

দেবাংশু জাগো নিউজকে জানান, সুনামগঞ্জের জামালগঞ্জ ইউনিয়নের নূরপুর গ্রামের দালাল নূরুল ইসলামের প্ররোচনায় পড়েই মালয়েশিয়ায় আসা তার। মালয়েশিয়া যাওয়ার আনন্দে বিভোর ছিলেন তিনি। শেষ পর্যন্ত সাগর পাড়ি দিয়ে ‘স্বপ্নের দেশে’ পৌঁছান তিনি!

মালয়েশিয়া পৌঁছানোর আগে নৌপথে যে ভয়ংকর অভিজ্ঞতার কথা শিকার হয়েছেন তা এ প্রতিবেদককে জানান দেবাংশু। তিনি বলেন, ‘দুই মাসের বেশি সময় ধরে আমি সাগরে ছিলাম। এই কয়েক মাস কিভাবে ছিলাম বলে বোঝাতে পারবো না। নৌকায় খাবার ছিল না, পানিও ছিল না। কিন্তু প্রতিদিন নির্যাতন চলতো, গালি-গালাজ করা হতো। পানিতে ফেলে দিয়ে  মারে ফেলার হুমকি দেয়া হয়েছে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত আমি ও আমার বন্ধু তৌহিদুল প্রাণে রক্ষা পেয়েছি।’

‘গত বছরের ১৯ জুন রাত ৮টায় বঙ্গোপসাগর থেকে যখন রওনা হই, তখন প্রথমে ছোট নৌকায় তোলা হয়। অনেকগুলো নৌকা ছিল। এই সব ছোট ছোট নৌকার মানুষ সব একদিন একটা বড় নৌকায় তোলা হলো। প্রায় এক হাজার লোক। বার্মা ও বাংলাদেশের লোক ছিল এই নৌকায়। পাচারকারীরা বললো তোমাদের এবার মালয়েশিয়ায় নিয়ে যাব। তোমরা মালয়েশিয়ায় ঢুকে যাবা।’ যোগ করেন দেবাংশু।

Debangshu

তিনি বলেন, ‘প্রায় ৭২ ঘণ্টা ধরে আমাদের নৌকা চলেছিল। কিন্তু যেদিন আমরা রওনা হই, সেদিন নৌকায় ভয়ঙ্কর মারামারি শুরু হলো। পাচারকারীরা একটা লোককে গুলি করে মেরে ফেললো। নৌকায় সবাই ভয় পেয়ে গেল। তিন দিন চলার পর নৌকাটা সাগরের যেখানে এসে থামলো, সেখানে একটা স্পিডবোট আসলো। আমাদের নৌকার ক্যাপ্টেন আর তাদের সব লোকজন সেই স্পিডবোটে পালিয়ে গেল। সাগরের মাঝখানে আমাদের এই অবস্থায় ফেলে রেখে। এরপর আমাদের তো খুব অসহায় অবস্থা। নৌকায় তেল নাই। ইঞ্জিন নষ্ট। পানি নাই। খাবার নাই। তারপর বার্মার লোকেরা জাহাজের দায়িত্ব নিল। এরপর তারা নির্যাতন শুরু করলো আমাদের বাংলাদেশিদের ওপর। যখন খুশি আমাদের মারধর করতো।’

দেবাংশু বলেন, ‘আমাদের নৌকা কোথায় কোনদিকে যাচ্ছে, কিছুই বুঝতে পারি না। কিছুদিন পর আমরা বাংলাদেশিরা সবাই অসুস্থ হয়ে পড়লাম। ইন্দোনেশিয়ান নেভি আমাদের নৌকাটা মালয়েশিয়ার সীমানায় এনে ফেলে দিয়ে চলে যায়। এরপর আমরা পড়ি বিপদে। তারপর আসলো মালয়েশিয়ান নেভি। ওরা নুডলস আর পানি দিলো খাবার জন্য। আমাদের নৌকা টেনে নিয়ে তারাও দূর সমূদ্রে ফেলে দিয়ে চলে গেল।’

এরপর আমরা কষ্টে আছি। বিশ দিন ধরে সাগরে ভাসছি। সাগরের পানি খেয়ে আছি। সবার ডায়রিয়া। কেউ দাঁড়াতে পারে না। এই বিশ দিন একবার ইন্দোনেশিয়ান নেভি আসছে, একবার মালয়েশিয়ান নেভি আসছে। সবাই খাবার দিয়ে চলে গেছে। কেউ সাহায্য করেনি।

সাগরের পানি, ঝিনুক খেয়ে বেঁচে ছিলাম। কেউ প্রস্রাব খেয়ে বেঁচে ছিল।

দেবাংশু আরো বলেন, ‘জাহাজে একদিন মারামারি লাগলো বার্মা আর বাংলাদেশিদের মধ্যে। বাংলাদেশের মানুষকে পানিতে ফেলে মারে ফেলা হলো। একদিন নৌকা ফুটো হয়ে গেল। পানি উঠতে লাগলো। তখন ইন্দোনেশিয়ার যে ফিশিং বোটগুলো আছে, ওরা এসে আমাদের উদ্ধার করলো। সারারাত ধরে চালিয়ে একদিন ভোরে (সে দিন ছিল শুক্রবার) ওরা আমাদের মালয়েশিয়ায় নিয়ে আসে। এর মধ্যে দেড়শো লোক মারা গেছে পানিতে পড়ে। যারা বুড়ো ছিল, যারা ডায়রিয়ায় দুর্বল হয়ে পড়েছিল, ওরাও বাঁচেননি।’

মালয়েশিয়া জহুর বারুতে একটি জঙ্গলে ফেলে চলে গেলো পাচারকারীরা। জঙ্গলে হাটতেছি আমরা দুই বন্ধু। হঠাৎ রাতে একটি জিপ গাড়ি দেখতে পেলাম। ওরা আমাদের ফলো করছিল। গাড়িতে বার্মা ও মালয়েশিয়ানসহ তারা চারজন ছিল।

Debangshu

তারা আমাদের গাড়িতে উঠালো। আমাদের নিয়ে এখন কি করবে জানি না। এক বাসায় নিয়ে রাখলো। পরের দিন থেকে  আমাদের দুই জনের উপর শারীরিক অত্যাচার শুরু হলো। দেশের মোবাইল নম্বর নিয়ে ওরা আমাদের বাড়িতে ফোন করে টাকা দাবি করলো।

আমাদের অভিভাবকরা টাকা পাঠালেন জন প্রতি চার লাখ করে মোট ৮ লাখ টাকা পরিশোধ করলাম আমরা। টাকা পেয়ে জহুর বারু লাড়কিন বাস স্ট্যান্ডে আমাদের নিয়ে আসলো বার্মার ওই লোকটি। লোকটি কুয়ালালামপুর গাড়িতে তুলে দিল। কুয়ালালামপুর কোতারায়া বাংলা মার্কেটে আসলাম। পরিচয় হলো এক বাঙালি ভাইয়ের সঙ্গে। তিনি কাজ ঠিক করে দিলেন ক্লাংএ। মাসে এক হাজার রিঙ্গিত। আট মাস কাজ করে এক টাকাও পাইনি। বরং ওই বাঙালি সুপার ভাইজার বেতনের কথা বললে বলতো তুমরা অবৈধ বেশি কথা বললে পুলিশের হাতে তুলে দিব। উপায়ন্তর না পেয়ে রাতের আধারে সেখান থেকে পালিয়ে আসলাম। তিনদিন না খেয়ে ছিলাম। যোগ করেন দেবাংশু।  

তিনি বলেন, কুয়ালালামপুর থেকে জীবনের ঝুকি নিয়ে আবার চলে গেলাম সেই জহুর বারু। পরিচয় হলো আমাদের সুনামগঞ্জের একজনের সঙ্গে। সেও নৌকায় এসেছে। তিন মাস ধরে এক সঙ্গে একটি কন্সট্রাকশন সাইডে কাজ করছি। কিন্তু অবৈধ হওয়ায় বেতন কম। তবুও বেচে থাকার তাগিদে পড়ে রয়েছি। জানি না ভাগ্যে কি আছে। এই এক বছরে বাড়িতে মাত্র ৫০ হাজার টাকা পাঠিয়েছি।

তবুও ভেঙে পড়েননি দেবাংশু। তার ভয় শুধু পুলিশকে। দিনে প্রজেক্টে কাজ আর জঙ্গলে রাত কাটে তার। এভাবেই জীবন যুদ্ধে বেঁচে থেকে স্বপ্ন পূরণের চেষ্টা করছেন তিনি।

একে/পিআর

প্রবাস জীবনের অভিজ্ঞতা, ভ্রমণ, গল্প-আড্ডা, আনন্দ-বেদনা, অনুভূতি, স্বদেশের স্মৃতিচারণ, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক লেখা পাঠাতে পারেন। ছবিসহ লেখা পাঠানোর ঠিকানা - [email protected]