শিক্ষকের মর্যাদা

মো. ইয়াকুব আলী
মো. ইয়াকুব আলী মো. ইয়াকুব আলী
প্রকাশিত: ০৪:০৩ পিএম, ০৮ অক্টোবর ২০২৪
বুয়েটের হাসিব মোহাম্মদ আহসান স্যারের সাথে লেখক

সেই প্রাক-প্রাথমিক থেকে শুরু করলে আমার জীবনে শিক্ষকদের তালিকাটা বেশ দীর্ঘ। তাদের সবাই হয়তোবা এখনো বেঁচেও নেই। তবুও তালিকাটা একটু ঝালিয়ে নেওয়া যাক। আদর্শলিপির পাঠ নিয়েছিলাম পাশের বাসার সাকেরা বু’র কাছে। পাড়া সম্পর্কে ফুফাতো বোন হয় যদিও উনার সাথে আমাদের কোনো রক্ত সম্পর্কের আত্মীয়তা নেই। এরপর ভর্তি হলাম বাড়াদি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে। সেখানে ছিলেন বোরকা আপা, হিন্দু আপা, চশমা পরা একজন বয়স্ক স্যার আর প্রধান শিক্ষক ছিলেন সাধন স্যার। চশমা পরা স্যারের নাম আজ আর মনে নেই।

এরপর আমরা আবার গ্রামের বাড়িতে ফিরে গেলে ভর্তি হলাম চরভবানীপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে। সেখানে ছিলেন আফসার স্যার, নজরুল স্যার, পুতুল স্যার আর প্রধান শিক্ষক ছিলেন রতন বাগচি স্যার। প্রত্যন্ত চর এলাকা তাই কোনো শিক্ষকই এসে বেশিদিন টিকতেন না। স্থানীয় আফসার স্যার আর নজরুল স্যারই ছিলেন আমাদের ভরসা। তবে রতন বাগচি স্যার প্রধান শিক্ষক হিসেবে যোগ দিয়ে প্রত্যন্ত চর এলাকার এই স্কুলটার চেহারা খোলনলচে বদলে দিয়েছিলেন। সেই গল্পে ফিরবো আবার।

বিজ্ঞাপন

এরমধ্যে আবার একবার অল্প কিছু দিনের জন্য বাড়াদিতে ফিরে আবারও বাড়াদি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ভর্তি হয়েছিলাম কিন্তু কিছুদিন পরেই আবার ভবানীপুর ফিরে যেতে হয়েছিল। তাই প্রাথমিকের প্রায় পুরো পাঠ নিয়েছিলাম প্রত্যন্ত গ্রামের এই স্কুলটাতে।

শিক্ষকের মর্যাদাপ্রাথমিকের শিক্ষক রতন বাগচী স্যারের সাথে লেখক

বিজ্ঞাপন

বিজ্ঞাপন

এরপর মাধ্যমিকের সময় আবার বাড়াদিতে ফিরে আসা। ভর্তি হলাম পাশের গ্রামের জগতি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে। সেখানে অনেক শিক্ষক ছিলেন, সবার নাম আজ মনেও নেই। বাংলার পণ্ডিত স্যার, ইংরেজির সেকেন্ড স্যার, বিজ্ঞানের নজরুল স্যার, অংকের শরীফ স্যার, একজন ছিলেন পিটি স্যার, আরও ছিলেন হেডস্যার। মফস্বলের একটা স্কুলের যা চরিত্র তার সবই বিদ্যমান ছিল এই স্কুলে।

মাধ্যমিক পেরিয়ে কলেজে ভর্তি হলাম কুষ্টিয়া সরকারি কলেজে। সেটা ছিল বিশ্ববিদ্যালয় কলেজ। তার শিক্ষকের সংখ্যাও ছিল অনেক। সবাইকে চিনতামও না। বিজ্ঞান বিভাগের স্যারদের বাইরে চিনতাম শুধু বাংলা আর ইংরেজির শিক্ষকদের। বাংলাদেশের শিক্ষা ব্যবস্থার কলেজ বিষয়টাকে আমার কাছে এখন পর্যন্ত সবচেয়ে আকর্ষণীয় মনে হয়। মাধ্যমিক পেরিয়ে বয়সন্ধির একটা ঘোরলাগা সময়ে আমরা কলেজে ভর্তি হয়। চারপাশে যা দেখি সবই রঙিন লাগে। একই ক্লাসের বিপরীত লিঙ্গের সহপাঠীর সাথে তখন ঝগড়া না করে বন্ধুত্ব করতে ইচ্ছা করে। ইচ্ছা করে তার সাথে কিছুক্ষণ কথা বলতে। সেটা করতে পারলেই যেন জীবন সার্থক হয়ে যাবে।

এরপর বিশ্ববিদ্যালয়ে এসে ভর্তি হলাম ঢাকায়। মফস্বলের একটা ছেলের জন্য সেটা ছিল একটা বিশাল পদক্ষেপ। বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকদের তো গোনা গুনতি ছিল না। নিজের বিষয়েরই সব শিক্ষককে চিনতাম না। প্রত্যেক ছাত্রের জন্য একজন করে শিক্ষক ছিলেন উপদেষ্টা হিসাবে যিনি আসলে বিশ্ববিদ্যালয়ে সেই ছাত্রের স্থানীয় অভিভাবকের দায়িত্ব পালন করতেন। আমার উপদেষ্টা ছিলেন হাসিব মোহাম্মদ আহসান স্যার। এছাড়াও আমরা পাঠ্য হিসেবে যেসব শিক্ষকদের লেখা বই পড়তাম তাদেরও শিক্ষক হিসেবেই মানি।

বিজ্ঞাপন

বিজ্ঞাপন

যাইহোক এখন যখন পেছন ফিরে তাকাই তখন জীবনের সমস্ত অর্জনের অর্ধেকের দাবিদার হিসেবে এইসব শিক্ষকদেরই মানি। আর বাকি অর্ধেকের দাবিদার আমার বন্ধুরা। বিষয়টা এমন না যে ছাত্র থাকা অবস্থায় সব শিক্ষককে ভালো লাগতো কিন্তু এখন বুঝি আমার জীবন চরিত্র গঠনে উনাদের সবারই অবদান আছে। আমি তাই সবসময়ই উনাদের জন্য মনেমনে শ্রদ্ধা বোধ করি। আর চেষ্টা করি সবার সাথে যোগাযোগটা রাখার যদিও বাস্তবতার কারণে সবসময় সেটা সম্ভব হয়ে উঠে না।

গত বছর শিক্ষক দিবস উপলক্ষে অনেকের সাথেই অনেকদিন পর আবার যোগাযোগ হয়েছিল। এর বাইরে প্রাথমিকের রতন বাগচী স্যার, কলেজের সাত্তার স্যার আর মুহাম্মদ আজিজ হাসান স্যারের সাথে যোগাযোগটা মোটামুটি নিয়মিতই হয়। মুহাম্মদ আজিজ হাসান স্যারের লেখা পদার্থবিজ্ঞান প্রথম আর দ্বিতীয় পত্র বই দুটো পড়েছিলাম উচ্চমাধ্যমিকে। স্বপ্নেও কল্পনা করিনি একদিন স্যারের উনার সাথে পরিচয় হবে, সামনাসামনি দেখা হবে।

শিক্ষকের মর্যাদাকলেজের রসায়নের শিক্ষক আতিয়ার রহমান স্যারের সাথে লেখক

বিজ্ঞাপন

ফেসবুকের দুনিয়ায় পরিচয় হয়েছিল স্যারের কন্যা রিফাতের সাথে। রিফাত আর আমি একই ব্যাচের ছাত্র ছিলাম যদিও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান আলাদা ছিল। রিফাত কিন্তু শুরুতেই বলেনি যে সে আজিজ হাসান স্যারের মেয়ে। তখন বুঝলাম বড় মানুষেরা আর তাদের সন্তানেরা আসলেও কতটা বিনয়ী হন। গত বছর দেশে যেয়ে স্যারের সাথে দেখা করলাম। স্যারকে সামনাসামনি দেখে কি পরিমাণ চমৎকৃত হয়েছিলাম সেটা প্রকাশ করার মতো শব্দ আমার ভাণ্ডারে নেই। অত্যন্ত অমায়িক কিন্তু মিশুক প্রকৃতির একজন মানুষ। আর স্যারের চোখের দৃষ্টি অন্তর্ভেদী। এরপর থেকেই স্যারের সাথে যোগাযোগটা আছে।

গত বছর আরও বহুদিন বাদে দেখা হলো কলেজের রসায়নের শিক্ষক নওরোজ স্যারের সাথে। স্যার মনের দিক দিয়ে এখনও সেই তরুণ বয়সেই আছেন। বিজ্ঞানের শিক্ষক হয়েও স্যার ছিলেন আমাদের ক্রীড়া উপদেষ্টা। এছাড়াও একজন নিবেদিতপ্রাণ সংস্কৃতি কর্মী। নিজের সন্তানদেরকেও মানুষ করেছেন একই আদর্শে। তারা একইসাথে আধুনিক কিন্তু অত্যন্ত মানবিক মানুষ। স্যারের সহধর্মিনীও চমৎকার একজন মানুষ। এছাড়াও কাকতালীয়ভাবে দেখা হয়ে গিয়েছিল বুয়েটে আমার উপদেষ্টা হাসিব স্যারের সাথে।

বন্ধু চঞ্চল তার পেশাদারী ক্যামেরা দিয়ে আমাদের একটা চমৎকার ছবি তুলে দিয়েছিল। কতদিন পর স্যারকে দেখলাম। কতদিন পর স্যারের সেই পরিচিত কণ্ঠস্বর শুনলাম। স্যারের কথা বলার একটা বিশেষ ধরণ আছে যেটা অন্যদের থেকে আলাদা। স্যার মন এবং মননে এখনও তরুণই আছেন।

বিজ্ঞাপন

দুই হাজার বাইশ সালে হঠাৎ করেই দেখা হয়ে গেল কলেজের রসায়নের আতিয়ার স্যারের সাথে তাও আবার খোদ এই সিডনিতে। আতিয়ার স্যারকে নিয়ে আমি যতই লিখি না কেন সেটা কম মনে হয় আমার কাছে। উনি একাধারে ছিলেন আমার শিক্ষক এবং অভিভাবক। স্যার মেলবোর্ণে এসেছিলেন উনার ছেলের বাসায়। সেখান থেকে সিডনি বেড়াতে এসেছিলেন। তারপর এসেছিলেন আমাদের এক ব্যাচ সিনিয়র মেজবার ভাইয়ের বাসায়। মেজবার ভাইয়ের অবদান আমার জীবনে অপরিসীম।

এখন সহজ করে বললে সিডনিতে উনি আমার স্থানীয় অভিভাবক। স্যার এসেই খবর পাঠালেন। আমি মুহূর্তমাত্র দেরি না করে হাজির হলাম। স্যারকে দেখে মনে হলো আমি সেই উনিশশো ছিয়ানব্বই সালে ফিরে গেছি। স্যারের চেহারায় বয়সের কোন ছাপ নেই। কণ্ঠস্বরের সেই বাজখাঁই আওয়াজ এখনও অটুটু রয়েছে। কতশত স্মৃতিচারণ করলাম আমরা সবাই মিলে।শিক্ষকের মর্যাদা
কলেজের রসায়নের শিক্ষক নওরোজ হোসাইন সাঈদ স্যারের সাথে লেখক

অনেকদিন ধরেই পরিকল্পনা করছিলাম প্রাথমিকের রতন বাগচী স্যারের সাথে দেখা করার কিন্তু সবকিছু মিলিয়ে হয়ে উঠছিল না। এবছর জরুরি প্রয়োজনে মার্চে দেশে যেতে হয়েছিল। তখন ভাবলাম এই সুযোগটা আর হাতছাড়া করা ঠিক হবে না। ফুপাতো ভাই জাহিদের হোন্ডার পেছনে চড়ে চলে গেলাম স্যারের সাথে দেখা করতে। স্যারের পুরো পরিবারের সাথে দেখা হলো। আমার কল্পনায় স্যারের যে চেহারা ছিল এখন আর স্যার তেমন দেখতে নেই কিন্তু মনটা এখনও তরুণ।

বিজ্ঞাপন

স্যারের কথাবার্তাও সেই আগের মতোই আছে। দুজন মিলে কতশত স্মৃতিচারণ করলাম। প্রত্যন্ত চর এলাকায় যেখানে মানুষ টয়লেট ব্যবহার করতো না স্যার কিভাবে সেখানে মানিয়ে নিয়েছিলেন সেই গল্প করলেন। স্কুলের অন্য শিক্ষক এবং ছাত্রদের নিয়েও অনেক কথা হলো। স্যারের কথার মাধ্যমে চলে গেলাম গত শতাব্দীর সেই আশির দশকে। বয়স কমে একলাফে হয়ে গেল আট দশ বছর।

বলা হয়ে থাকে বাবা মা আমাদের জন্ম দেন কিন্তু প্রকৃত মানুষ হিসাবে আমাদের তৈরি করেন আমাদের শিক্ষকেরা। এই কথাটা আমার জীবনে পুরোপুরি সত্য। তাই আমি পৃথিবীর যে প্রান্তেই থাকি সকল শিক্ষকের ছাত্র হয়েই থাকি। এমনকি এখন যখন নিজের ছেলে মেয়ের শিক্ষকের সাথে দেখা হয় তাদেরকেও স্যার ম্যাডাম বলেই সম্বোধন করি। শিক্ষাগুরুর মর্যাদা আসলে বলে বা লিখে শেষ করার নয়।

বাংলাদেশে একজন মানুষের জীবনের ভিত্তি তৈরি হয় প্রাথিমিকের শিক্ষকের হাতে কিন্তু এই মানুষগুলোর বেতনই সবচেয়ে কম। এটা আমার কাছে একটা পরিহাস মনেহয়। উনাদের বেতন আসলে হওয়া উচিৎ সবার চেয়ে বেশি এবং আমার মনেহয় সবচেয়ে যোগ্য শিক্ষকদেরকে প্রাথমিকে নিয়োগ দেয়া উচিৎ।

বিজ্ঞাপন

শিক্ষকদের আমি ব্যক্তিগতভাবে কখনোই ভুলি নাই এবং ভুলবো না জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত। ছেলেমেয়েদের নিজের শিক্ষকদের গল্প করি। যদি বেঁচে থাকি একসময় হয়তোবা নাতি নাতনীদের কাছেও উনাদের গল্প করবো। আমার খুব ইচ্ছা এক এক করে সব স্যারের সাথে দেখা করার। জানি না সেটা সম্ভব হবে কি না তবে উনাদের প্রতি মনেমনে শ্রদ্ধা কাজ করে সবসময়।

শিক্ষকের মর্যাদাউচ্চমাধ্যমিক পদার্থবিজ্ঞান বইয়ের লেখক মুহাম্মদ আজিজ হাসান স্যার

শিক্ষক দিবস আসলে উনাদের প্রতি কৃতজ্ঞতা জানানোর একটা আলাদা সুযোগ তৈরি হয়। বিশ্ব শিক্ষক দিবসে পৃথিবীর সকল শিক্ষকের প্রতি অন্তরের অন্তঃস্থল থেকে আন্তরিক শ্রদ্ধা এবং ভালোবাসা। পরিশেষে প্রাথমিকে পড়া কবি কাজী কাদের নেওয়াজ'র শিক্ষা গুরুর মর্যাদা কবিতার কিছু চরণ দিয়ে লেখাটা শেষ করি-

‘আজ হতে চির-উন্নত হল শিক্ষাগুরুর শির,
সত্যই তুমি মহান উদার বাদশাহ্ আলমগীর।’

এমআরএম/এএসএম

প্রবাস জীবনের অভিজ্ঞতা, ভ্রমণ, গল্প-আড্ডা, আনন্দ-বেদনা, অনুভূতি, স্বদেশের স্মৃতিচারণ, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক লেখা পাঠাতে পারেন। ছবিসহ লেখা পাঠানোর ঠিকানা - jagofeature@gmail.com