অন্ধকারে আলো

১৯৭১-এর সাহসিকতা এবং ২০২৪ সালে আশা

রহমান মৃধা
রহমান মৃধা রহমান মৃধা
প্রকাশিত: ০৩:২৭ পিএম, ১৪ সেপ্টেম্বর ২০২৪

১৯৭১ সালের শেষের দিক। বাংলাদেশের গ্রামাঞ্চলে চারদিকে শুধু যুদ্ধের গন্ধ, আতঙ্ক আর অস্থিরতা। হানাদার বাহিনীর অত্যাচার, গ্রামের পর গ্রাম পুড়ে যাওয়া, আর মুক্তিযোদ্ধাদের গেরিলা আক্রমণের খবর বাতাসে ভেসে বেড়াচ্ছে। এমনই এক রাতে, এক প্রত্যন্ত গ্রামের ছোট্ট কুঁড়েঘরে আমি একা, আশপাশে কেবল কাঁদামাখা পথ আর বুনো গাছপালা। যুদ্ধের কারণে গ্রামের সবাই আতঙ্কে, কেউ ঘর থেকে বের হয় না, বিদ্যুৎ তো নেইই, আলো জ্বালানোও মানা—কারণ শত্রুরা তখন আলো দেখলেই আক্রমণ চালায়।

হঠাৎ করে বাইরে থেকে প্রচণ্ড ঝড় শুরু হলো। ঝড়ের সঙ্গে অঝোরে বৃষ্টি আর মাঝে মাঝে বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে। বাতাসে একটা অদ্ভুত গন্ধ, যেন পোড়া মাটির সাথে মিশে আছে যুদ্ধের ভয়াবহতার স্মৃতি। ঘরের ভেতর বসে আছি, মনেও এক অদ্ভুত অস্থিরতা। বাইরে মেঘের গর্জন, যেন যুদ্ধবিমান উড়ছে মাথার ওপর দিয়ে। বিদ্যুতের চমকে কখনো গ্রামের পুড়ে যাওয়া বাড়ির কাঠামো, কখনো শূন্য মাঠের মাঝে দাঁড়িয়ে থাকা গাছগুলোকে আরও ভয়ংকর লাগছে।

এমনই এক বিদ্যুতের ঝলকানিতে হঠাৎ ঘরের এক কোণে চোখ পড়ে, যেন একটা ছায়া দাঁড়িয়ে আছে। বুক ধকধক করছে, মনে হচ্ছে কেউবা কিছু আমার দিকে এগিয়ে আসছে। বাইরের ঝড় যেন আরও তীব্র হলো, জানালা কাঁপছে, বাতাসের ঝাপটা ঘরের মধ্যে ঢুকছে। সেই ছায়াটা ধীরে ধীরে এগিয়ে আসছে, আমি পেছনে সরে যাই, কিন্তু পা যেন মাটি থেকে আলগা হয়ে যাচ্ছে না। মনের মধ্যে যুদ্ধের সব ভয়াবহতা, মৃত্যু, শূন্যতা—সবকিছু মিলে এক ভয়ংকর অনুভূতি।

কিন্তু ঠিক তখনই, আমার মনে হলো, এই ছায়া, এই ভয়—সবই তো যুদ্ধের সৃষ্টি, আমার মনে গেঁথে থাকা আতঙ্ক। আমি ধীরে ধীরে সাহস সঞ্চয় করলাম, মনে মনে ঠিক করলাম, মুক্তিযোদ্ধারা যদি তাদের জীবন বাজি রেখে যুদ্ধ করতে পারে, তবে আমি কেন এই ভয়ের কাছে হার মানবো? আমি দৃঢ়তার সঙ্গে সেই ছায়ার দিকে তাকালাম। বিদ্যুতের আলোয় দেখলাম, সেটা কোনো অশুভ শক্তি নয়, বরং এক মুক্তিযোদ্ধার ছায়া, যিনি আমাদের জন্য নিজের জীবন উৎসর্গ করেছেন। তার চোখে একরাশ সাহস আর আশার আলো, যা আমাকে শক্তি দিলো।

তেমনই এক অন্ধকার সময়ে, আমি মনে করতে পারি রাশেদ ভাইয়ের মতো গ্রামের শত শত পরিচিত মুখ কীভাবে একে একে ঝরে গেলো। যুদ্ধের বিভীষিকাময় রাতে তাদের অনেককেই হারাতে হয়েছে। একই সাথে আমি বুঝলাম, যুদ্ধের ভয়াবহতা আর অন্ধকার যতই গাঢ় হোক না কেন, আমাদের মনের ভেতরে লুকিয়ে থাকা সাহস আর স্বাধীনতার আকাঙ্ক্ষা সেই অন্ধকারকে ছিন্ন করতে পারে।

বাইরের ঝড় থেমে গেছে, কিন্তু আমার ভেতরের ঝড় এখনও থামেনি। তারপরও সেই অন্ধকারের মধ্যেও যেন কোথাও সূর্যের মতো আশার আলো ফুটে উঠছিল। আমার মনে পড়ে, স্কুল জীবনের সেই প্রথম গান, ‘মা তোর মুখের বাণী আমার কানে লাগে সুধার মত’—সেই গানের প্রতিটি ছন্দ, প্রতিটি শব্দ যেন স্বাধীনতার এক নতুন অর্থ নিয়ে ধরা দেয়। গানের সেই সুর, সেই গন্ধ, যেন মায়ের আঁচল থেকে আসা।

তখন স্বাধীনতার চেতনা ছিল রবি ঠাকুরের অজর কবিতার মতো। এক একটি শব্দের মধ্যে লুকিয়ে ছিল সাহস, বীরত্ব, আর অমরত্বের আকাঙ্ক্ষা। মনে হয়েছিল, দেশের প্রতিটি মানুষ, প্রতিটি শিশু, এমনকি প্রাকৃতিক সবকিছুতেই যেন স্বাধীনতার অনুরণন বাজছে। আমি অনুভব করলাম, সবার হৃদয়ে তখন একটাই প্রতিজ্ঞা—মুক্তি চাই। এই চেতনা, এই প্রত্যয় আমাদের গ্রামের প্রান্তরে ছড়িয়ে পড়ে, আর আমাদেরও সাহস জোগায়।

আমি জানি, বাংলাদেশ একদিন এই অন্ধকার থেকে বেরিয়ে আসবে, নতুন প্রজন্মদের জন্য থাকবে এক আলোকিত ভবিষ্যৎ।

আলো আসতে শুরু করেছে, ভোরের প্রথম কিরণ দেখা দিচ্ছে। সেই মুক্তিযোদ্ধার ছায়া আমার মনে গেঁথে গেছে, আমি জানি, তার সেই সাহসিকতা আর আত্মত্যাগ আমাদের ভয়কে জয় করতে শেখাবে। ২০২৪ সালের নতুন প্রজন্মরাও ঠিক তেমনই এক সাহস আর আশার প্রতীক হবে, যারা যেকোনো দুর্যোগ থেকে মাথা উঁচু করে বেরিয়ে আসতে পারবে, যেমন আমরা বেরিয়ে এসেছিলাম ১৯৭১-এর অন্ধকার থেকে।

আমার স্বপ্ন একটি দুর্নীতিমুক্ত ক্যাশলেস বাংলাদেশ, যেখানে প্রতিটি লেনদেন স্বচ্ছতা ও ন্যায়বিচারের প্রতীক হবে। আমি দেখতে চাই, বাংলার প্রতিটি ঘরে শুধু মানবতা ও নৈতিকতার আলো জ্বলছে—একটি এমন আলো, যা গোটা বিশ্বের সকল পথভ্রষ্ট মানুষের হৃদয়ে আলোড়ন তুলবে। এই আলো হবে আমাদের নতুন মুক্তির প্রতীক, যা ১৯৭১-এর সাহসিকতার মতোই আমাদের ভবিষ্যতকে উজ্জ্বল করবে।

এই স্বপ্নই আমাদের শক্তি দেবে, দেবে আমাদের পথ চলার প্রেরণা। আমরা যে জাতি, যার ইতিহাসে রয়েছে অগণিত সংগ্রাম আর অর্জনের গল্প। আমি জানি, আমরা আবারো প্রমাণ করবো যে আমরা একটি সাহসী, শক্তিশালী, ও আশা-ভরা জাতি, আমরা পারব- পারতে আমাদের হবেই।

রহমান মৃধা, সাবেক পরিচালক, ফাইজার, সুইডেন।
[email protected]

এমআরএম/এএসএম

প্রবাস জীবনের অভিজ্ঞতা, ভ্রমণ, গল্প-আড্ডা, আনন্দ-বেদনা, অনুভূতি, স্বদেশের স্মৃতিচারণ, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক লেখা পাঠাতে পারেন। ছবিসহ লেখা পাঠানোর ঠিকানা - [email protected]