গণমাধ্যমের স্বাধীনতা এবং কিছু কথা
স্বাধীনতা সংগ্রামের পর থেকে বাংলাদেশ অনেক রাজনৈতিক অস্থিরতা ও পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে গেছে। একটি স্বাধীন এবং গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র হিসেবে গড়ে ওঠার পেছনে গণমাধ্যমের ভূমিকা বরাবরই গুরুত্বপূর্ণ থাকার কথা ছিল। গণমাধ্যমকে বলা হয় রাষ্ট্রের চতুর্থ স্তম্ভ; এর মাধ্যমে জনগণ তথ্য জানতে পারে এবং রাষ্ট্রের কার্যক্রমের ওপর নজরদারি চালাতে সক্ষম হয়।
তবে গণমাধ্যম কখনও স্বাধীন হয়ে ওঠেনি মূলত স্বৈরশাসন এবং দুর্নীতির কারণে। বিভিন্ন সময়ে দেশের গণমাধ্যমগুলোর ভূমিকা নিয়ে বিভিন্ন প্রশ্ন উঠেছে। বিশেষত, রাষ্ট্র বা প্রশাসনের ভয়ে অনেক ক্ষেত্রে তারা নিরপেক্ষভাবে তথ্য প্রকাশ করতে পারেনি।
প্রশাসনের প্রভাব ও গণমাধ্যমের ভয়
গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে মতপ্রকাশের স্বাধীনতা এবং গণমাধ্যমের স্বাধীনতা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু বাংলাদেশে গণমাধ্যমের ওপর যে প্রভাব বা চাপ রয়েছে, তা কি প্রশাসনের প্রভাবের কারণে? যদি সত্যিই তাই হয়, তবে প্রশাসনকে জিজ্ঞাসা করা উচিত- কোন কারণে গণমাধ্যমের স্বাধীনতার ওপর এই প্রভাব বিদ্যমান, যখন স্বৈরাচারের শাসনের অবসান হয়েছে?
অন্য এক সম্ভাবনা: প্রোপাগান্ডা ও পক্ষপাতিত্ব
তবে বিষয়টি শুধুমাত্র এখানেই সীমাবদ্ধ নয়। অনেক ক্ষেত্রে এমনও হতে পারে যে, কিছু গণমাধ্যম রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে প্রোপাগান্ডা ছড়ানোর জন্য বা বর্তমান সরকারকে বিপদে ফেলার উদ্দেশ্যে উদ্দেশ্যপ্রণোদিত সংবাদ প্রকাশ করছে। আবার, কিছু গণমাধ্যম অতীতের স্বৈরশাসকদের তোষামোদ করে চলেছে তাদের নিজস্ব স্বার্থে বা তাদের নিজস্ব রাজনৈতিক ও আর্থিক স্বার্থ রক্ষার জন্য। এর ফলে, তারা নিজেদের নিরপেক্ষতা বজায় রাখতে পারছে না।
এ বিষয়ে নিজস্ব অভিজ্ঞতা থেকে বলতে পারি যে, সদ্য কিছু গুরুত্বপূর্ণ লেখা গণমাধ্যমে প্রকাশের জন্য পাঠানো হয়েছিল, কিন্তু কিছু গণমাধ্যম সেই লেখাগুলো প্রকাশ করতে দ্বিমত পোষণ করেছে এবং লেখাগুলোকে নাখোশও করেছে। এ থেকেই বোঝা যায়, গণমাধ্যমের একটি অংশ এখনো কেন ভয়ে বা পক্ষপাতিত্বে আবদ্ধ রয়েছে।
গণমাধ্যমের সততা ও দায়িত্বশীলতা নিশ্চিত করার প্রয়োজনীয়তা
একটি রাষ্ট্রের সুসংহত গঠন ও সংস্কারের জন্য গণমাধ্যমের শতভাগ সততা ও নিষ্ঠা নিশ্চিত করা জরুরি। যদি গণমাধ্যম সত্য তথ্য তুলে ধরতে ব্যর্থ হয়, তবে জনগণ যেমন সত্য থেকে বঞ্চিত হবে, তেমনই রাষ্ট্রের উন্নয়ন প্রক্রিয়া জটিলতার সম্মুখীন হবে। সরকারের উচিত একটি স্বাধীন ও নিরপেক্ষ তদন্ত কমিশন গঠন করা, যা গণমাধ্যমের কার্যক্রমের সত্যতা যাচাই করবে এবং প্রোপাগান্ডা ছড়ানোর অভিযোগগুলো খতিয়ে দেখবে।
সমাধানের পথ কী হতে পারে?
১. মতপ্রকাশের স্বাধীনতা নিশ্চিত করা: প্রশাসনকে নিশ্চিত করতে হবে যে মতপ্রকাশের স্বাধীনতা সংবিধানিকভাবে সুরক্ষিত এবং তা রক্ষায় তারা প্রতিজ্ঞাবদ্ধ।
২। নিরপেক্ষ তদন্ত কমিশন গঠন: প্রশাসনের ওপর গণমাধ্যমের যে কোনো ধরনের হস্তক্ষেপ বা চাপের অভিযোগ রয়েছে, তা নিরপেক্ষভাবে তদন্ত করার জন্য একটি স্বাধীন তদন্ত কমিশন গঠন করা প্রয়োজন। এছাড়া গণমাধ্যমের প্রোপাগান্ডা বা পক্ষপাতমূলক আচরণের অভিযোগগুলোকেও যথাযথভাবে খতিয়ে দেখা উচিত।
৩। গণমাধ্যম নীতি ও নিয়মাবলীর সংস্কার: গণমাধ্যমের স্বাধীনতা নিশ্চিত করার জন্য নীতি ও নিয়মাবলীর সংস্কার প্রয়োজন, যেন গণমাধ্যম তার দায়িত্বশীল ভূমিকা পালন করতে পারে এবং জনগণকে সঠিক তথ্য দিতে পারে।
সরকারের করণীয় ও দায়িত্ব
সরকারের উচিত গণমাধ্যমের ওপর সব ধরনের অযাচিত প্রভাব বন্ধ করা এবং তাদের স্বাধীনতা নিশ্চিত করা। একইসঙ্গে, তাদের উচিত নিশ্চিত করা যে গণমাধ্যম কোনো প্রকার প্রোপাগান্ডা ছড়াচ্ছে না এবং সত্য তথ্য প্রকাশ করছে। এ লক্ষ্যে প্রশাসনের স্বচ্ছতা বজায় রাখা এবং সঠিক তথ্যপ্রবাহ নিশ্চিত করার উদ্যোগ নেওয়া জরুরি।
সর্বস্তরে প্রকাশের গুরুত্ব
এই প্রতিবেদনটি শুধুমাত্র মতামতের পাতায় সীমাবদ্ধ না রেখে সব মিডিয়া ও গণমাধ্যমের সর্বস্তরে প্রকাশ করা একান্ত জরুরি। এটি বাংলাদেশের গণতন্ত্রের ভবিষ্যৎ সম্পর্কে একটি গুরুত্বপূর্ণ আলোচনা উন্মোচন করবে এবং জনগণ ও প্রশাসনের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করবে। গণমাধ্যমের সততা ও দায়িত্বশীলতা নিশ্চিত করতে আলোচনা ও পদক্ষেপ গ্রহণের মাধ্যমে দেশের সমৃদ্ধি ও গণতান্ত্রিক ভিত্তির জন্য পথ সুগম হবে।
রহমান মৃধা, সাবেক পরিচালক, ফাইজার, সুইডেন। [email protected]
এমআরএম/এমএস