বাংলাদেশ নিয়ে কেন আশাবাদী
দেশ আসলে কী? এটা কি শুধুই একটা ভুখণ্ড? না কি সেখানে বসবাসকারী জনগোষ্ঠি? না কি এটা শুধুই বুকের গভীরে ধারণ করা একটা অনুভূতি মাত্র? আমার কাছে দেশ মানে এর সব কয়টি। তবে প্রবাসী হিসাবে এখন তৃতীয়টিই সবচেয়ে বেশি সত্যি। সেই দেশ নিয়ে আমি বরাবরই ভীষণ রকমের আশাবাদী। কারণ দেশকে যে সাধারণ মানুষরা ধারণ (ওউন) করে আমি তাদের খুব কাছ থেকে দেখেছি। আমাদের দেশের কৃষক, গার্মেন্টকর্মী, প্রবাসী শ্রমিক এরাই দেশের চালিকাশক্তি। এর বাইরে আছে ক্ষুদ্র ও মাঝারি ব্যবসায়ী। আরও আছে কায়িক শ্রমিক, রিকশাওয়ালা, ভিক্ষুক। সবাই যার যার অবস্থান থেকে দেশের কাজে অবদান রেখে চলেছেন।
বাংলাদেশ নিয়ে আমরা আসলে হতাশা প্রকাশ করি না। আমাদের যেটুকু হতাশা তার সবটুকুজুড়েই আমাদের নেতৃত্ব। আরও সহজ করে বললে রাজনৈতিক দল আর সর্বগ্রাসী আমলাতন্ত্র হচ্ছে আমাদের হতাশার মূল কারণ। সংবিধান অনুযায়ী যাদের আসলে প্রজাতন্ত্রের মানে জনগণের চাকর হয়ে থাকার কথা তারা হয়ে বসেছিল দেশের মালিক। তাই সাধারণ জনগণ দেশকে আর ধারণ করতে সাহস করতো না। কিন্তু ছাত্র জনতার গণঅভ্যূথানে স্বৈরাচার সরকার পতনের পর দেশের মালিকানা রাতারাতি বদলে গেছে। এখন দেশের মানুষদের পাশাপাশি প্রবাসীরাও নিজেকে দেশের মালিক মনে করছেন।
কাগজে কলমে আমাদের সক্ষমতা নিয়ে সবসময়ই প্রশ্ন ছিল। আমরা এখন পর্যন্ত যা অর্জন করেছি তার অংক কোনোভাবেই মেলে না। কিন্তু এইসব তাত্ত্বিক এবং গাণিতিক হিসাবের বাইরেও আমাদের মধ্যে এমন একটা কিছু আছে যার বলে আমরা সবসময়ই অসম্ভবকে সম্ভব করে ঘুরে দাঁড়িয়েছি বারবার। একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ ছিল যেকোনো হিসাবেই একটা অসম যুদ্ধ। আমাদের কোনোভাবেই জয়ের সম্ভাবনা ছিল না। একটা প্রশিক্ষিত সেনাবাহিনীর বিপরীতে লুঙ্গি পরে খালি গায়ে যুদ্ধ করে দেশ স্বাধীন করে আমরা সারা বিশ্বকে বুঝিয়ে দিয়েছিলাম দেশকে ভালোবাসলে আর নিজেকে দেশের মালিক মনে করলে সবই সম্ভব।
এত গেলো ইতিহাসের কথা। এবার আসা যাক সাম্প্রতিক ঘটনাবলীতে। চব্বিশ সালে এসে জেনারেশন জি বুকের তাজা রক্তে রাজপথ রাঙিয়ে যেন আমাদের নতুন করে স্বাধীনতা এনে দিলো। এই স্বাধীনতা কথা বলার। এই স্বাধীনতা নিজের অধিকার বুঝে নেওয়ার। এই স্বাধীনতা অন্যায়ের প্রতিবাদের। এই স্বাধীনতা দেশের প্রকৃত মালিকানার। ছাত্ররা বুঝিয়ে দিলো দেশের আসল মালিক দেশের সরকারপ্রধান আর তার চাটুকার রাজনৈতিক নেতাকর্মী এবং আমলারা না। আর সেটা সম্ভব হলো সবার একজোট হয়ে রাস্তায় নামার ফলে। পাখির মতো গুলি করে তাদের মারা হলো কিন্তু একজন মরলে দাঁড়িয়ে গেলো আরো দশজন। সেই দশজন মারা গেলে দাঁড়িয়ে গেলো আরো একশজন। এভাবে সংখ্যাটা বাড়তেই থাকলো। অবশেষে এলো সেই কাঙ্ক্ষিত স্বাধীনতা।
দেশ স্বাধীন হবার পর নতুন অন্তর্বর্তীকালীন সরকার দায়িত্বভার গ্রহণের আগ পর্যন্ত দেশে কোনো শাসনব্যবস্থা ছিল না। তখন মাথাচাড়া দিয়ে উঠলো কিছু সুযোগ সন্ধানী মানুষ আর ডাকাত। সুযোগসন্ধানীরা নিজের প্রতিপক্ষের বাড়িতে হামলা করতে শুরু করলো। বিশেষ করে হাতেগোনা কিছু মানুষ সংখ্যালঘুদের ওপর হামলা করতে শুরু করলো। তাদের ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান থেকে শুরু করে উপাসনালয় কিছুই রেহাই পাচ্ছিল না। তখন আবার দেশের সাধারণ মানুষই তাদের পাশে এসে দাঁড়ালো। তারা রাত জেগে পাহারা দিতে শুরু করলো। কোনো অপকর্মের সংবাদ পেলেই সেটা এলাকার মসজিদের মাইকে ঘোষণা দিয়ে প্রতিহত করা হলো।
আর ডাকাতদের বিরুদ্ধে মানুষ সবাই এক হয়ে গেলো। পাড়ায় পাড়ায় মহল্লায় মহল্লায় মানুষ উৎসব করে রাত জেগে পাহারা দিতে শুরু করলো। শহরের মানুষেরা যারা এতদিন নিজেদের নিয়েই ব্যস্ত ছিল তারা এই প্রথম নিজেদের মধ্যে মেলামেশার সুযোগ পেলো। তৈরি হলো একটা নতুন সংস্কৃতি। মানুষ নিজের স্বার্থ বিসর্জন দিয়ে অন্যের স্বার্থকে প্রাধান্য দিতে শিখলো। অন্যের বিপদে এগিয়ে আসার অনুপ্রেরণা পেল। আসলে আমরা সবাই যে একই দেশের একই মায়ের সন্তান। তাই আমরা দেশটাকে অনেক ভালোবাসি। এতদিন সেটা প্রকাশ করার সুযোগ ছিল না। কিন্তু এই নতুন বিপদ আমাদের আবার একতাবদ্ধ করে দেশকে ভালোবাসতে শেখালো।
এর পরপরই এলো প্রলয়ংকরী বন্যা। এটাকে দেশের ইতিহাসের সবচেয়ে মর্মান্তিক বন্যাও বলা হচ্ছে। কারণ এই বন্যাটা হয়েছে একেবারেই হঠাৎ করে। এ ধরনের বন্যার ইংরেজিতে একটা নাম আছে - ফ্ল্যাশ ফ্লাড। ফ্ল্যাশ ফ্লাডে পানি দ্রুত সরে যায় কিন্তু আমাদের পানি দ্রুত সরে যাওয়ার কোনো উপায় নেই। উজানের দেশে বেশিরভাগ নদীতেই বাঁধ দেওয়া। তাই আমাদের দেশের নদীগুলো মৃতপ্রায়। তাই যখন হঠাৎ করে অনেক পানি চলে এসেছে তখন সেটা দুপাশের বিশাল জনগোষ্ঠিকে প্লাবিত করেছে। আর নদী মরে যাওয়াতে এই পানি বের হবারও রাস্তা খুঁজে পাচ্ছে না। যদিও আমাদের দেশের পানি বিজ্ঞানীরা অদ্ভুত সব কথা বলছেন। তারা কেউই নদী মরে যাওয়ার কারণে বন্যার পানি আটকে থাকার কথা বলছেন না।
যাইহোক দেশের মানুষ যখন বন্যায় অসহায় হয়ে পড়লো তখন আবার আমরা একজোট হয়ে তাদের পাশে দাঁড়ালাম। যেটা আগেই বলেছিলাম যেকোনো বিপদ দেশের প্রতি আমাদের ভালোবাসাটাকে জাগিয়ে দেয়। পাঁচই আগস্টের ক্রান্তিকাল পার হয়ে নতুন সরকারের জন্য এই বন্যা মোকাবিলা বেশ কঠিন হয়ে পড়তো যদি না সাধারণ মানুষ তাদের সর্বোচ্চ সক্ষমতা নিয়ে এগিয়ে না আসতো। এতদিন সাধারণ মানুষ স্বৈরাচারের কবলে পড়ে নিজ দেশেই নিজেকে অচ্ছুৎ মনে করতো। এবার স্বাধীন দেশে যেন সেই দমবন্ধ হয়ে আটকে থাকা ভালোবাসাটা প্রকাশ করার সুযোগ পেলো।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র শিক্ষক মিলনায়তন কেন্দ্রে আমরা একটা অসম্ভব রকমের সুন্দর দৃশ্য দেখলাম। দলে দলে সারি সারি মানুষ বন্যার্তদের জন্য সাহায্য নিয়ে হাজির হয়ে গেলো। মুহূর্তের মধ্যে তৈরি হয়ে গেলো একদল স্বেচ্ছাসেবক বাহিনী। আমার এই ক্ষুদ্র জীবনে দেখা সবচেয়ে সুন্দর বাংলাদেশের প্রতিচ্ছবি হয়ে এটা আমার মনের মনিকোঠায় আঁকা হয়ে থাকবে। একেবারে মায়ের কোলের শিশু থেকে শুরু করে আবাল-বৃদ্ধ-বণিতা সবাই সাহায্য নিয়ে এসেছে। এমন না যে সবাই টাকা নিয়ে এসেছে।
যার যার সামর্থ্য আছে তাই নিয়ে বন্যার্তদের পাশে এসে দাঁড়িয়েছে। শিশু এসেছে তার মাটির ব্যাংকে জমা করা শখের টাকাগুলো নিয়ে। মা নিয়ে এসেছে তার বাচ্চার অব্যহৃত ও পুরোনো কাপড়। কেউ নিয়ে এসেছে পানি, কেউ নিয়ে এসেছে শুকনা খাবার। এই তালিকা অনেক দীর্ঘ।
এটাতো গেলো দেশের মানুষের কথা। প্রবাসীরা যতই বিদেশে থাকুক তাদের মনটা সবসময়ই পড়ে থাকে দেশে। তারা দেশের যেকোনো প্রয়োজনে তাই অগ্রণী ভূমিকা রেখে চলে। যেমন পাঁচই আগস্টের আগে বিশ্বব্যাপী জনমত তৈরিতে প্রবাসীদের ভূমিকা অগ্রগণ্য। বন্যার সময় তারা আবারও দেশের মানুষদের পাশে এসে দাঁড়ালো। ব্যক্তিগত উদ্যোগ থেকে শুরু করে সামষ্টিক এবং প্রাতিষ্ঠানিকভাবে তহবিল সংগ্রহ করা হলো এবং হচ্ছে। এই প্রথম প্রবাসীরা যেন দেশকে নতুন করে ধারণ করলো। দেশে তার আত্মীয়স্বজন বন্যা আক্রান্ত হোক বা নাহোক ধর্ম, বর্ণ, এলাকা নির্বিশেষে সবাই একজোট হয়ে দেশে মানুষের পাশে এসে দাঁড়িয়েছে। দেশের প্রতি মানুষের এমন ভালোবাসার প্রকাশ দেখতে পারাটাও অনেক সৌভাগ্যের ব্যাপার।
দেশের শিক্ষিত এবং প্রবাসের বন্ধুদের আড্ডায় আমি সবসময়ই একটা কথা বলতাম। সেটা হলো আমরা যারা দেশের সবচেয়ে সুবিধাভোগী শিক্ষিত জনগোষ্ঠি তারা কখনোই দেশকে ওউন করি না। প্রবাসী বন্ধুদের বলতাম আমরা তো আরও বেশি ওউন করি না। কারণ আমরা কখনোই দেশের কোন কাজে আসি না। এইবার দেখলাম ভিন্ন চিত্র। আসলে আমরা সবাই আমাদের মাতৃভূমিকে প্রচন্ড ভালোবাসি এবং ভীষণভাবে ওউন করি। কিন্তু প্রতিকূল পরিবেশের কারণে আমরা সেটা প্রকাশ করতাম না।
এখন যখন দেশের আকাশে মুক্তির বাতাস বইছে তখন আমরা সবাই বুকভরে নিঃশ্বাস নেওয়ার পাশাপাশি বুঝতে পারছি আমরা আসলে দেশকে কতটা ভালোবাসি। আমি স্বপ্ন দেখি এই ভালোবাসা প্রজন্ম থেকে প্রজন্ম ছড়িয়ে পড়বে। আর যে দেশের মানুষ দেশকে এমন গভীরভাবে ভালোবাসে সেই দেশ কখনোই পথ হারাবে না। আমি দেশকে নিয়ে তাই ভীষণভাবে আশাবাদী।
এমআরএম/এএসএম