চব্বিশের চরমপত্র
১৯৭১ সালে স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র খুবই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিল। স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের অনুষ্ঠানসমূহ সম্মুখ সমরের যোদ্ধাদের জন্য টনিক হিসাবে কাজ করতো। তারা সকল দুঃখ শোক কাটিয়ে নিজেদের উজ্জীবিত করতেন। এছাড়াও ছিল বিল্পবী অনেক স্লোগান আর সময়োপযোগী পোস্টার। ২০২৪ সালে এসে স্বৈরাচার পতনের আন্দোলনেও আমরা দেখলাম তরুণদের একই রূপ। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম হয়ে উঠলো স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র। অনেক যুগোপযোগী স্লোগান তৈরি হলো। পোস্টারের জায়গা নিলো গ্রাফিতি এবং নানা ব্যাঙ্গাত্মক কার্টুন। আর চরমপত্রের জায়গা নিলো প্রতিবাদী র্যাপ গান।
আন্দোলনের শুরুই হয়েছিল একটা ব্যাঙ্গাত্মক স্লোগান দিয়ে। যেদিন সরকারপ্রধান আন্দোলনকারীদের ব্যঙ্গ করে রাজাকার উপাধি দিলেন ঠিক সেই মুহূর্তে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা রাজপথ কাঁপিয়ে তুললো ‘তুমি কে আমি কে, রাজাকার রাজাকার’ স্লোগানে। অবশ্য এটাকে সরকারপন্থীরা ভিন্নভাবে ব্যাখ্যা করলো। কিন্তু এরই সঙ্গে জুড়ে দেওয়া ‘কে বলেছে কে বলেছে, স্বৈরাচার স্বৈরাচার’ স্লোগানটার কথা তারা বললো না। এরপর এসেছে আরো অনেক স্লোগান- ‘'তুমি কে আমি কে, সমন্বয়ক সমন্বয়ক’, ‘বাঁশের লাঠি তৈরি করো, বাংলাদেশ স্বাধীন করো’, ‘দড়ি ধরে মারো টান, রানী হবে খানখান’।
শেষে সব স্লোগান এসে মিললো ‘এক দফা একদাবি, স্বৈরাচার তুই কবে যাবি’ স্লোগানে। স্বৈরাচার পতনের পরও তারা থেমে থাকেনি। সংখ্যালঘুদের ওপর সহিংসতা রুখে দিতে তারা স্লোগান দিয়েছে- ‘বাঁশের লাঠি তৈরি করো, সহিংসতা প্রতিহত করো’। এখন চলছে রাষ্ট্র সংস্কারের কাজ। তারা আরও বলছে ‘সমতল থেকে পাহাড়, এইবারের মুক্তি সবার’। তারা চাইছে পুরোনো সব ঝেড়ে ফেলে গণমানুষের সংবিধান যেখানে সকল জাতি, শ্রেণির, লিঙ্গের সমান অধিকারের কথা থাকবে। তারা শহীদের রক্তের সাথে বেঈমানি মানতে নারাজ।
এবারের আন্দোলনের অন্যতম হাতিয়ার ছিল গ্রাফিতি এবং কার্টুন যেটা আসলে একাত্তরের দেয়ালিকা এবং পোস্টারেরই আধুনিক রূপ। গ্রাফিতিগুলো দেশের দেয়ালগুলোকেও আন্দোলনের সাথে যুক্ত করেছিল। বিভিন্ন বর্ণিল রঙে রঞ্জিত দেয়ালগুলো যেন শতকণ্ঠে ছাত্রদের দাবিতে সোচ্চার হয়ে উঠেছিল। কত রকমের সৃষ্টিশীল গ্রাফিতি যে ছাত্ররা এঁকেছিল দেয়ালে দেয়ালে। এখনও সেই ধারা অব্যাহত আছে। নতুন দেশ গড়ার দৃঢ় প্রত্যয় ব্যক্ত হচ্ছে বিভিন্ন গ্রাফিতির মাধ্যমে।
আর কার্টুনগুলো ছিল এক কথায় অসাধারণ। কতশত কার্টুন যে আঁকা হয়েছে এই আন্দোলনে তার হিসাব হয়তোবা কারো কাছে নেই। আকার পর সেগুলো সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। যার ফলে দেশের পাশাপাশি প্রবাসের বাংলাদেশিরাও এই আন্দোলনের সঙ্গে সহজেই যুক্ত হতে পেরেছে। প্রবাসীরা কার্টুনগুলো প্রিন্ট করে নিয়ে বিদেশের রাস্তায় নেমে সে দেশের সরকারের দৃষ্টি আকর্ষণে সক্ষম হয়েছিল। উপরন্তু এগুলো ছিল বাংলা এবং ইংরেজি দুই ভাষাতেই ফলে প্রবাসী দ্বিতীয় প্রজন্মও সহজেই এগুলোর সাথে নিজেকে যুক্ত করতে পরেছিল।
এছাড়াও একাত্তরের চরমপত্রের আদলে রচিত হলো র্যাপ গান। শুরুতেই একাত্তরের চরমপত্রের দিকে একটু নজর দেওয়া যাক। চরমপত্র ছিলো এম আর আখতার মুকুল রচিত ও উপস্থাপিত স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের সবচেয়ে জনপ্রিয় অনুষ্ঠান। অনুষ্ঠানটি স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র চালু হওয়ার দিন ২৫শে মার্চ থেকে শুরু করে ১৬ই ডিসেম্বর বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার দিন পর্যন্ত প্রতিদিন প্রচারিত হয়েছিল। এটি ছিল ব্যাঙ্গাত্মক ও শ্লেষাত্মক মন্তব্যে ভরপুর একটি অনুষ্ঠান। এই অনুষ্ঠান মুক্তিযোদ্ধাদের উৎসাহ ও উদ্দীপনা দানের জন্য রচিত ও পরিবেশিত হতো।
- আরও পড়ুন
ঘুরে দাঁড়ানোর স্বপ্ন সত্যি হবে তো?
প্রবাসী তরুণদের দেশে ফেরার সময় এসেছে
ড. ইউনূস স্যারের কাছে খোলা চিঠি
অন্যদিকে র্যাপের আদি উৎস আফ্রিকার মাটিতে। তাদের কথ্য ঐতিহ্যের মধ্যে। এই গানের ইতিহাস ঘাটলে দেখা যায় গত শতকের সত্তরের দশকে নিউইয়র্কের কৃষ্ণাঙ্গ শ্রমিক শ্রেণি বাদ্যযন্ত্র সহযোগে কবিতার মতো করে একধরনের গান করতো। এ গান তাদের রাজনৈতিক হাতিয়ার হয়ে উঠেছিল। এটি যেমন কালো মানুষের কমিউনিটির গান, স্মৃতি সংরক্ষণের গান, তেমনি ছিল প্রতিবাদেরও গান। এ গান তাদের মধ্যে প্রাণ সঞ্চার করতো।
বাংলাদেশের নামহীন, গোত্রহীন করে রাখা যুবসমাজ, শিক্ষার্থী আর জনতা নানামুখী মার খেতে খেতে যেন দাস জীবনই যাপন করছিল। এই বাস্তবতায় বাংলা র্যাপাররা সেই কালো আফ্রিকার উপনিবেশবিরোধী ঐতিহ্যের গায়নরীতি গলায় ধারণ করে গুলি খেতে থাকা, বারবার মরতে থাকা ছাত্র জনতার জীবনেও প্রাণ সঞ্চার করে দিয়েছিল। জাগিয়ে তুলেছিল বাংলাদেশের হৃদয়। আবু সাঈদ গুলি খাওয়ার পর ১৮ই জুলাই মুক্তি পায় হান্নানের ‘আওয়াজ উডা বাংলাদেশ’ গানটি। যেটি যুদ্ধের দামামা বাজিয়ে প্রবল চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দেয় শাসকদের বিরুদ্ধে। সে বলল, ‘আবু সাঈদরে গুল্লি করলি, অর্ডার দিলি কই থেক্কা?/এইবার রাস্তায় হাজার সাঈদ কইলজা থাকলে ঠেকাগা!’
এরপর র্যাপার হান্নানকে গ্রেফতার করা হয়। দেশে ইন্টারনেট সেবা বন্ধ করে দেওয়া হয়। এরপর ২২শে জুলাই ইন্টারনেট সেবা খুলে দিলে আমাদের চোখে পড়ে র্যাপার সেজানের ‘কথা ক’ গানটি। যার কথাগুলো ছিল এমন ‘এ ৫২-র আর ২৪-এ তফাৎ কই রে? কথা ক’। গানটি দেশে-বিদেশে হাজার হাজার শেয়ার হতে থাকে। শোকার্ত শিক্ষার্থীরা যেন আবার উঠে দাঁড়ানোর শক্তি পায়। এরপর ৩০শে জুলাই আসে ‘চব্বিশের গেরিলা’ গানটি। যেখানে প্রশ্ন তোলা হয়, ‘আমরাই যখন রাজাকার, তাইলে ক তুই রাজা কার?’
এখানে লক্ষণীয় বিষয় হচ্ছে সবগুলো গানই কবিতার মতো অন্তমিল দিয়ে লেখা। আর বিষয়বস্তু ছিল ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলন ও ১৯৭১ মুক্তিযুদ্ধ। হান্নানের গানের শুরুটাই হয়েছিল ৭ মার্চে দেওয়া বঙ্গবন্ধুর ভাষণ দিয়ে যেখানে তিনি বলছেন- ‘তোমাদের যা কিছু আছে তাই নিয়ে প্রস্তুত থাকো। মনে রাখবা, রক্ত যখন দিয়েছি রক্ত আরও দেব। এ দেশের মানুষকে মুক্ত করে ছাড়ব, ইনশা আল্লাহ!’ আর গানটি শেষ হয়েছে- ‘জয় বাংলা, বীর বাঙালি অস্ত্র ধরো, বাংলাদেশ স্বাধীন করো।’ কি চমৎকারভাবেই না এখনকার তরুণেরা বায়ান্ন আর একাত্তরের স্মৃতিকে পূনর্জীবন দিলো তাদের ন্যায্য আন্দোলনের মধ্যে।
বাংলাদেশের হৃদয়কে জাগাতে তরুণেরা এমন এক ভাষা বেছে নিলো, যা কোনো ভদ্রলোকদের কাছে আমল পায় না। এটা আসলে নিছকই খেটে খাওয়া মানুষের মুখের জীবন্ত ভাষা। ঠিক যেমনটা ছিল চরমপত্রের ভাষা। তাই চরমপত্র যেমন খুব দ্রুত সময়ের মধ্যে সবার কাছে প্রিয় হয়ে উঠেছিল ঠিক তেমনি র্যাপ গানগুলো ছড়িয়ে গেলো কোটি প্রাণে। দেশের সাধারণ মানুষ বুঝলো এই তরুণেরা তো আসলে তাদের ভাষায় তাদেরই কথা বলছে। তখন তারাও রাস্তায় নেমে এলো। পতন ঘটলো দীর্ঘ পনের বছরের স্বৈরাচার শাসনের।
আন্দোলনকারী তরুণেরা তাদের জীবদ্দশায় একবারও ভোটাধিকার প্রয়োগ করতে পারেনি। তাই তারা বলতো, ‘আই হেট পলিটিকস’। তারা যেন ভেতরে ভেতরে ফুঁসছিল। দেশের সবচেয়ে উদ্দমী অংশ এই তরুণেরা। তারা যেন নিজেদেরকে সমাজে অপাংতেয় ভাবতে শুরু করেছিল। আমরা তাদের মতামতকে গ্রাহ্য না করে গায়ের জোরে একের পর এক উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়ন করে যাচ্ছিলাম। অবশেষে তারা জেগে উঠল। রাজপথে স্লোগানের পাশাপাশি তারা রচনা করলো কার্টুন এবং কালজয়ী সব গান। অবশেষে এক সাগর রক্তের বিনিময়ে এলো আমাদের নতুন স্বাধীনতা।
এমআরএম/জেআইএম