ড. ইউনূস স্যারের কাছে খোলা চিঠি
পত্রের শুরুতেই সালাম এবং সংগ্রামী শুভেচ্ছা। শুভেচ্ছাটা কেন সংগ্রামী দিলাম সেটা এই পত্রের শেষে পরিষ্কার হবে। শুরুতেই কিছু ব্যক্তিগত স্মৃতিচারণ করে নিই। দেশ ব্যাপারটা ঠিক কীভাবে কখন মাথায় ঢুকেছিল সেটা আর মনে নেই। তবে এটুকু মনে আছে আমাদের সময়ের প্রাথমিকের ‘পরিবেশ পরিচিতি সমাজ’ বইয়ে সুনাগরিকের দায়িত্ব ও কর্তব্য সম্মন্ধে পড়েছিলাম। সেখানে একটা পয়েন্ট ছিল, নিয়মিত ভোটাধিকার প্রদান। তাই নির্বাচনের সময় আসলেই আমি মায়ের শাড়ির আঁচল ধরে টানতে টানতে ভোটকেন্দ্রে নিয়ে যেতাম।
এরপর অনেক বড় হয়ে যাওয়ার পর একদিন জানতে পারলাম আমাদের দেশের একজন নোবেল পুরস্কার পেয়েছেন। শুনে এত ভালো লাগলো। সেদিন অফিস থেকে মনে হয় উড়তে উড়তে বাসায় ফিরলাম। আসার সময় পাড়ার মোড়ের দোকান থেকে মিষ্টি কিনে নিয়ে আসলাম। এরপর বাসায় পৌঁছে সবাইকে মিষ্টি মুখ করালাম। সবার মধ্যেই একটা সুখী সুখী ভাব লক্ষ্য করলাম। এরপর আমি বললাম এতদিন বিশ্ব দরবারে আমাদের দেওয়ার মতো কোনো পরিচয় ছিল না। এখন একটা পরিচয় দেওয়া যাবে। একটা স্বাধীন দেশের মাত্র পঁয়ত্রিশ বছর বয়সে নোবেল পুরস্কারের মতো একটা প্রাপ্তি নিঃসন্দেহে অত্যন্ত আশাব্যঞ্জক হয়ে দেখা দিয়েছিল।
এরপর একদিন অধুনালুপ্ত সাপ্তাহিক ২০০০ এর পাতায় পড়লাম আপনার বিশাল এক সাক্ষাৎকার। অনেক কিছুই তখন প্রথমবারের মতো জানতে পারলাম। সত্যি কথা বলতে কি ক্ষুদ্রঋণ নিয়ে আমার অভিজ্ঞতা সুখকর ছিল না। আমাদের বাড়ি কুষ্টিয়া শহরতলীর বাড়াদী গ্রামে। গ্রামের জনগোষ্ঠির অধিকাংশই দারিদ্রসীমার নিচে বসবাস করতেন। তখন গ্রামে গ্রামে ঋণের কার্যক্রম নিয়ে আসে ব্র্যাক। তারা অবশ্য এসব কার্যক্রমের পাশাপাশি স্কুলও চালাতো। সেখানে আমাদের পাড়ার অনেক ছেলেমেয়ে পড়তো। তাদের পাঠ্যপুস্তক এবং পড়ানোর ধরণটা ছিল খুবই আকর্ষণীয়।
যাইহোক মূল প্রসঙ্গে ফিরে আসি। সাপ্তাহিক ২০০০ এর সেই সংখ্যায় আপনার সাক্ষাৎকারের পাশাপাশি একদম মাঝের দুটো পাতাজুড়ে আপনার যৌবনাকলের একটা দারুণ স্টাইলিশ ছবি ছাপা হয়েছিল। আমি পত্রিকাটা পড়া শেষ করেই ছবিটা নিয়ে নীলক্ষেতে চলে গেলাম। এরপর একটা ফ্রেমে সেটাকে বাঁধাই করে নিয়ে আসলাম। আমার কর্মকাণ্ড দেখে আমার স্ত্রী রীতিমতো অবাক হলো। কারণ আমাদের বাসায় কারো ছবি ফ্রেম বাঁধানো নেই। আমার শ্বশুর এটা দেখে প্রশ্ন করলেন, কেন আমি এটা করলাম। আমি বলেছিলাম, এখন বাংলাদেশি হিসাবে যেখানেই যাবো এই মানুষটার নাম বলে পরিচয় দিতে পারবো। এরপর একবার অফিসের প্রশিক্ষণের কাজে ভারতের গোয়াতে গেলাম। সেখানকার মানুষ আপনার দেশের মানুষ বলে মনে হয় একটু বেশিই আতিথিয়েতা করলো।
এরপর আসলো আওয়ামী লীগের শাসন আমল। আমরা অবাক হয়ে লক্ষ্য করলাম আপনার নামে একের পর এক মামলা হতে লাগলো। সরকারের মন্ত্রী প্রতিমন্ত্রীরাতো আছেনই স্বয়ং সরকার প্রধানও যেন আপনার সাথে এক অঘোষিত যুদ্ধ ঘোষণা করলেন। সেসব বাক্যবাণ একটা সময় ভদ্রতার গন্ডি ছাড়িয়ে গেলো। আমরা বলাবলি করতাম আসলে আমরা সম্মানিত মানুষকে সম্মান দিতে জানি না। সরকারপ্রধান ভুলে গেলেন তার বাবাকে সারাবিশ্বের মানুষ সম্মান করলেও তিনি কিন্তু নিজ দেশের মানুষ দ্বারা নিহত হয়েছিলেন। সেই স্মৃতি থেকেও তো অন্ততঃপক্ষে আপনাকে সম্মান করতে পারতেন। কিন্তু উনার এবং উনার মোসাহেবদের আচরণে এমনটা মনেহতে লাগলো যেন আপনি উনার নোবেলটা কোন দুরভিসন্ধি করে কুক্ষিগত করেছেন।
এরপর ওয়ান ইলেভেনের ঘটনাপ্রবাহে আপনার রাজনৈতিক দল গঠনকে আমার ভালো লাগেনি। আসলে আমাদের দেশের মধ্যবিত্ত সমাজের সবচেয়ে বড় অশিক্ষা হচ্ছে আমরা রাজনীতি সচেতন না। আমরা দিনশেষে নিজেদের সব দুর্ভাগ্যের জন্য রাজনীতিবিদদের দোষারোপ করতে করতে ঘুমাতে যায়। রাজনীতিবিদদের কথাবার্তা থেকে শুরু করে সবই আমাদের বিনোদনের উপরকরণ। কিন্তু আমরা ভুলে যায় আমরাই নেতা তৈরি করি। ভালো লোক রাজনীতি না করলে ক্ষতটা সারাবে কে। এরপরের সময়টা আপনার জন্য আরো কঠিন হয়ে গেলো। দ্রুতই মামলার সংখ্যা বৃদ্ধি পেলো। সেগুলোতে প্রতিদিন আপনাকে হেনস্তা হতে হলো। এত হেনস্তার পরও আপনি দেশের প্রচলিত আইনের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে নিয়মিত আদালতে হাজিরা দিতে লাগলেন। আপনার সংগ্রামী মনোভাব ছাড়া এটা সম্ভব হতো না বলেই আমার বিশ্বাস।
এরপর আগস্টের পাঁচ তারিখে পট পরিবর্তন হলো। সবাই বলাবলি করছিল আপনি অন্তর্বর্তী সরকারের হাল ধরবেন। আমি তাদের দৃঢ়ভাবে জানিয়ে দিলাম আপনি কখনওই রাজি হবেন না। কারণ এর আগে একবার রাজনৈতিক দল গঠন করে যে ভোগান্তি আপনাকে পোহাতে হয়েছে সেটার দাগতো এখনও মেটেনি। কিন্তু আমি ভুল ছিলাম। আপনি ছাত্রদের অনুরোধে রাজি হলেন। আমরা সবাই হাঁফ ছেড়ে বাঁচলাম। আমি ব্যক্তিগতভাবে খুবই খুশি হলাম কিন্তু আপনি দেশে এসে সরকারিভাবে দায়িত্ব না নেওয়া পর্যন্ত মনের মধ্যে কতরকমের যে হিসাব নিকাশ চলছিল তার অন্ত নেই। মনের মধ্যে ঘুরপাক খাচ্ছিল আপনি কেন আরো আগে রওনা দিলেন না।
এরপর অফিস থেকে ফিরেই রাতের খাবার না খেয়ে টেবিলে বসে মোবাইলের ইউটিউবে বিমানবন্দরে আপনার সরাসরি ভাষণটা শুনলাম। আমার চৌদ্দ বছর বয়সী মেয়ে আর নয় বছর বয়সী ছেলে আমার মুখের অভিব্যক্তি দেখে আমাকে কিছু বললো না। অন্যান্য দিন হলে অফিস থেকে ফেরার সাথে সাথে অভিযোগের ফিরিস্তি বর্ণনা করতে শুরু করে। আপনি বললেন, ‘মনে রাখতে হবে, বাংলাদেশ ১৭ কোটি মানুষের দেশ। জনসংখ্যার অধিকাংশ যুব সম্প্রদায়। জীবনে তারা কেউ ভোট দিতে পারেনি। সেই অধিকার ফিরিয়ে দেওয়াই হবে প্রধান কাজ। ওখান থেকেই আমাদের শুরু করতে হবে। তাদের বলতে হবে, গণতন্ত্র ফিরে আসবে। তোমরা সবাই হবে তার অংশীদার।’
আপনি আরও বললেন, ‘১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বরের পর এটা দেশের দ্বিতীয় স্বাধীনতা দিবস। প্রথমটা ছিল পাকিস্তানের দাসত্ব থেকে শৃঙ্খলমুক্ত হওয়া, এবার স্বৈরাচারী সরকারের কাছ থেকে। শুরু হয়েছে এক নতুন যুগের। মানুষ এখন মুক্তির স্বাদ নিচ্ছে।… বাংলাদেশ প্রকৃত অর্থে গণতন্ত্রী হলে দেশের সংখ্যালঘুরাও নিরাপদে থাকবেন। তাদের বক্তব্য প্রাধান্য পাবে। গুরুত্ব পাবে। গ্রাহ্য হবে। সংখ্যালঘুরা ভোট দিতে পারবেন। নিজেদের প্রতিনিধি নিজেরাই বেছে নিতে পারবেন, যেমন ভারতের সংখ্যালঘুরা পান।’
আরও পড়ুন
ভাষণের যে পর্যায়ে আবু সাঈদের কথা বলতে গিয়ে আপনার গলা ধরে এলো তখন আমার দৃষ্টিও ঝাপসা হয়ে এলো। আপনি বললেন, ‘আজকে আবু সাঈদের কথা মনে পড়ছে আমাদের। যে আবু সাঈদের ছবি বাংলাদেশের প্রতিটি মানুষের মনে গেঁথে আছে। এটা কেউ ভুলতে পারবে না। কী অবিশ্বাস্য এক সাহসী যুবক! বন্দুকের সামনে দাঁড়িয়ে আছে। এবং তারপর থেকে কোনো যুবক–যুবতী আর হার মানেনি। সামনে এগিয়ে গেছে। বলেছে, যতগুলো মারো, মারতে পারো, আমরা আছি। যার কারণে বাংলাদেশজুড়ে এই আন্দোলন ছড়িয়ে গেছে। যার কারণেই এই বাংলাদেশ দ্বিতীয়বার স্বাধীনতা অর্জন করলো।’
আমার সব আশঙ্কা তখন অমূলক প্রমাণিত হলো। মনে হলো বুকের ওপর থেকে একটা বোঝা নেমে গেলো। এরপর রাতে আপনি এবং আপনার উপদেষ্টারা শপথ নিলেন। সারাদিনের ক্লান্তিতে ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। রাত দুটোর দিকে ঘুম ভেঙে গেলো। উঠেই মোবাইল হাতে নিয়ে পত্রিকার পাতায় আপনাদের শপথের ছবি দেখে মনটা নেচে উঠলো। মনে মনে বললাম, আমরা একটা ঘোর ক্রান্তিকাল পার করলাম। উপদেষ্টাদের তালিকা দেখে খুবই ভালো লাগলো। এই প্রথম দেখলাম বাংলাদেশের সব শ্রেণি পেশার মানুষ থেকে প্রতিনিধি নেওয়া হয়েছে। সবচেয়ে বড় কথা দেশের বিবেক ছাত্রদের প্রতিনিধি আছে আপনার দলে যাদের বয়স কেবল পঁচিশ বছর।
আমি ভীষণভাবে আশাবাদী আপনার অন্তর্বর্তী সরকার নিয়ে। আমি জানি আপনাদের স্বদিচ্ছার কোনো অভাব নেই। আপনাদের কর্মস্পৃহা অতুলনীয়। কিন্তু বাংলাদেশের মতো একটা দেশে আসলে সৎ গুণাবলীর সাথে সাথে সাধারণ মানুষের মনের ভাবটা পড়তে জানাও জরুরি। আপনারা সেটা পারবেন বলেই আমার বিশ্বাস। তবে একান্ত শুভাকাঙ্ক্ষী হিসাবে কিছু বিষয় আমার ক্ষুদ্র জ্ঞানে মনে করিয়ে দিতে চাই। আমাদের দেশের বয়স মাত্র তেপান্ন বছর। এর আগে আমরা দু’শ বছর ব্রিটিশ শাসন আর প্রায় প্রায় পঁচিশ বছর পাকিস্তানের অধীন ছিলাম। আমাদের মন এবং মননে তাই অন্যের প্রভাব এখনও প্রকটভাবে বিদ্যমান। তাই আমাদের মনস্তত্বের দিকে খেয়াল রাখতে হবে।
আমি আমার ক্ষুদ্র জীবনের অভিজ্ঞতায় দেখেছি আমরা ভীষণভাবে আবেগী। কেউ যতবড় অপরাধীই হোক না কেন যেই সে চোখের আড়াল হয় আমরা সাথে সাথে তার সব অপকর্মের কথা ভুলে যায়। একদল ক্ষমতায় এসে অপকর্ম করে চলে যায়। তখন আমরা ভাবি আগেরজনই ভালো ছিল। এরপর আবার সে এসে আগেরজনের অপকর্মের সব রেকর্ড ভেঙে ফেলে। স্বাধীনতার পর থেকে মোটামুটি এভাবেই চলে আসছে। আর যেই চেষ্টা করেছে এই বলয় ভাঙতে সেই আস্তাকুঁড়ে নিক্ষিপ্ত হয়েছে। আমরা আসলেই খুবই আজব জাতি। আমরা নিজেরাই আসলে কখনওই নিজের ভালো চাইনি। আমাদের অন্য কেউ বলে দেয় সবসময়। এভাবে আমরা গত তেপান্নটা বছর জ্বলন্ত উনুন থেকে ফুটন্ত কড়াইয়ে লাফালাফি করে কাটিয়েছি।
ব্যক্তি অভিজ্ঞতায় দেখেছি আমাদের দেশের প্রশাসনিক ব্যবস্থা থেকে বিচার ব্যবস্থা এমনকি আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী সবকিছুই চলে ব্রিটিশ আইনে। চাকরির বিধিমালা এখনও পড়ে আছে সেই ১৯২১ সালে প্রণয়ন করা নীতিমালাতে। আমাদের সরকারি কর্মকর্তারা তাই আমাদের সংবিধান অনুযায়ী প্রজাতন্ত্রের কর্মচারী না হয়ে মালিক হয়ে উঠেন। দেশের যে আপামর জনসাধারণের টাকায় তাদের বেতন হয় তাদের সাথেই প্রভুর মতো আচরণ করেন। সরকারি অফিস থেকে সামান্য একটা সেবা নিতে গেলেও পদে পদে হেনস্তার শিকার হতে হয়। কোনো উপরি টাকা না দিলে নির্দিষ্ট সেবা পাওয়া যায় না। সরকারি কর্মকর্তাদের অভিযোগ ছিল তাদের বেতন দিয়ে স্বচ্ছলভাবে চলা যায় না। একবার সেই বেতন বাড়ানোও হয়েছে। জানি না এতে অবস্থা কতটা বদলেছে।
সরকারি কর্ম-কমিশনের যে পরীক্ষার কোটা বৈষম্যের জন্য এই আন্দলোন এবং যার পরিণতিতে এই নতুন সরকার সেই জায়গাটাতে অনেক কাজ করার আছে। প্রশ্নপত্র ফাঁস রোধ করতে হবে। আর কীভাবে এই পরীক্ষাকে আরও যুগোপযোগী করা যায় সেটা নিয়েও ভাবতে হবে। আর এই চাকরি একবার পেলে সেটা আর হারানোর ভয় থাকে না তাই সরকারি চাকরিজীবিরা বেপরোয়া হয়ে উঠে। অস্ট্রেলিয়া এখনও ব্রিটিশদের অনেকিছুই অনুসরণ এমনকি অনুকরণ করে কিন্তু এমন স্থায়ী চাকরির কথা এখনও শুনিনি। এখানে প্রতি পদে পদে দক্ষতা এবং যোগ্যতার প্রমাণ দিয়েই সরকারি এবং বেসরকারি চাকরিতে টিকে থাকতে হয়।
আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থায় বিশাল গলদ রয়েছে। আমরা প্রতিদিন অফিসার তৈরি করি কিন্তু আমাদের দক্ষ কর্মী নেই। অস্ট্রেলিয়ায় দেখেছি টাফ (TAFE - Technical and Further Education) বলে একটা প্রতিষ্ঠান আছে যেটা অনেকটা বাংলাদেশের কারিগরি শিক্ষাবোর্ডের মতো। এখানে দৈনন্দিন কাজগুলো হাতে-কলমে শিখিয়ে দক্ষ কর্মী তৈরি করা হয়। এখন সারাবিশ্বেই দক্ষ কর্মীর বিশাল চাহিদা রয়েছে। এভাবে প্রশিক্ষিত কর্মী বাহিনী গড়ে তুলতে পারলে একদিকে যেমন আমরা তাদের দেশের উন্নয়নে কাজে লাগাতে পারবো অন্যদিকে তাদের বিদেশে রপ্তানি করে অনেক বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করতে পারবো। তখন সত্যিকার অর্থেই আমাদের জনসংখ্যা জনসম্পদে রূপান্তরিত হবে। কারণ বর্তমান বিশ্বে জনসংখ্যা আসলে বোঝা নয় সম্পদ।
আমি সবসময়ই বলে এসেছি আমাদের দেশের অর্থনীতি টিকে আছে তিনটা বিষয়ের ওপর-তৈরি পোশাকশিল্পের মেয়েগুলোর রক্তপানি করা শ্রম, কৃষকের অবিশ্রান্ত শ্রম আর প্রবাসীদের কঠোর পরিশ্রম। কিন্তু জীবনমানের দিকে তাকালে দেখা যায় সমাজে অনেক বৈষম্য বিদ্যমান। এটা নিয়ে গবেষণা জরুরি। একজন মানুষ বিদেশে যেতে গেলে জন্ম নিবন্ধন থেকে শুরু করে পাসপোর্ট বানানো পর্যন্ত যে পরিমাণ ভোগান্তির মধ্যে দিয়ে যেতে হয় সেটা অবর্ণনীয়। আর আমাদের এয়ারপোর্টে তাদের সাথে যে আচরণটা করা হয় সেটা আমরা আমাদের বাড়ির পোষা কুকুরের সাথেও করি না। এটা খুব দ্রুত ঠিক করা দরকার। একজন প্রবাসী বৈধপথে দেশে টাকা পাঠাতে গেলেও ভোগান্তির শিকার হন তাই বাধ্য হয়ে হুন্ডির মাধ্যমে টাকা পাঠান। এটা রোধ করা গেলে আমাদের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ কখনওই কমবে না।
আমাদের দেশের ব্যবসায়ীদের নিয়ে অভিযোগ অনেক পুরোনো। একদিকে আমরা অভিযোগ করি তাদের অতি মুনাফালোভী মানসিকতার দিকে। অন্যদিকে তারা বলেন ব্যবসার প্রত্যেকটি ধাপে চাঁদাবাজির শিকার হতে হয় তাই সেবা বা পণ্যের দাম অবধারিতভাবেই বেড়ে যায়। এই জায়গাটা নিয়ে কাজ করে ভোক্তা এবং ব্যবসায়ীর মধ্যে দূরত্ব কমিয়ে আনতে হবে। আমি ভীষণভাবে আশাবাদী আপনার উপেদষ্টাদের তালিকা দেখে। তাদের মধ্যে সবচেয়ে নবীন সদস্য নাহিদ ইসলাম এবং আসিফ মাহমুদকে নিয়ে আমি বেশি স্বপ্ন দেখি। তাদের বয়স কম হলেও তারা একটা আন্দোলনের মধ্যে দিয়ে তৈরি হয়েছে। তাই আমি আশাকরি তারা যেকোনো সমস্যাকে দেখবে একেবারে মূল থেকে। আর আপনারা যারা বয়োজ্যেষ্ঠ তারা সেটার অস্থায়ী সমাধান না দিয়ে বরং স্থায়ী সমাধান দেবেন। এভাবেই আপনাদের মধ্যে ক্ষমতার ভারসাম্য রক্ষা হবে বলে আমার ধারণা।
দেশে বর্তমানে একটা অরাজক পরিস্থিতি বিরাজ করছে কিন্তু আশার কথা হচ্ছে দেশে একটা গণজাগরণ সৃষ্টি হয়েছে। মানুষ জেগে উঠেছে। পাড়ায় পাড়ায় মানুষ দলবেঁধে রাত জেগে পাহারা দিচ্ছে। কোনো জরুরি অবস্থা দেখা দিলে মসজিদের মাইকে সাবধান করে দেওয়া হচ্ছে। ছাত্রছাত্রীরা পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতা থেকে শুরু করে ট্রাফিক নিয়ন্ত্রণের কাজ করছে। কি চমৎকার একটা সামাজিক সাম্য কাজ করছে। আমি নিশ্চিত নিয়মিত বাহিনী কাজ শুরু করলে দুর্বৃত্তরা আর সাহস পাবে না। এভাবেই সবার আন্তরিক প্রচেষ্টায় দেশটা একটা সময় সত্যিকার সোনার বাংলা হয়ে উঠবে।
পত্র অনেক বড় হয়ে যাচ্ছে। আপনার কথা দিয়ে পত্রটা শেষ করি, ‘এই স্বাধীনতার সুফল প্রতিটি মানুষের ঘরে পৌঁছে দিতে হবে। তা না হলে এই স্বাধীনতার কোনো দাম নাই। এই স্বাধীনতাকে পৌঁছানোই হলো আমাদের শপথ, আমাদের প্রতিজ্ঞা। ঘরে ঘরে পৌঁছাতে হবে। মানুষ যেন জানে যে বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার অর্থ হলো তার নিজের পরিবর্তন, ব্যক্তির পরিবর্তন, সুযোগের পরিবর্তন। ছেলেমেয়ের ভবিষ্যতের পরিবর্তন। এটা যেন প্রত্যেকে বুঝে নেয়। আমরা একটা পরিবার। যেন আমাদের গোলযোগ না হয়। আমরা যেন একযোগে, একসাথে চলতে পারি। আমরা তড়িতগতিতে একটা সুন্দর বাংলাদেশ গড়ার পথে এগিয়ে যেতে পারি, সেটাই আমাদের কামনা।’
এমআরএম/এএসএম