দুর্নীতি শুধু অর্থনৈতিক ক্ষতি করে না, মূল্যবোধও দুর্বল করে

রহমান মৃধা
রহমান মৃধা রহমান মৃধা
প্রকাশিত: ০৫:১২ পিএম, ২৮ মে ২০২৪
রহমান মৃধা

বাংলাদেশ, দক্ষিণ এশিয়ার একটি উন্নয়নশীল দেশ, যেখানে গত কয়েক দশকে আর্থিক ও সামাজিক উন্নয়ন অনেকাংশে সাধিত হয়েছে। তবে, এই অগ্রগতির পাশাপাশি দুর্নীতি এবং অমানবিক আচরণ বড় সমস্যা হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে। এই সমস্যা এতই ব্যাপক এবং গভীর যে, সমাজের প্রতিটি স্তরে এর প্রভাব পরিলক্ষিত হচ্ছে এবং মানুষের মধ্যে মনুষ্যত্ববোধ ক্রমশ বিলীন হতে শুরু করেছে।

বাংলাদেশ পুলিশের সাবেক মহাপরিদর্শক বেনজীর আহমেদ, তার স্ত্রী, বড় মেয়ে এবং ছোট মেয়ের বিরুদ্ধে অবৈধ সম্পদ সংগ্রহের অভিযোগে তদন্ত করে প্রয়োজনীয় আইনি ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য দুর্নীতি দমন কমিশনকে (দুদক) অনুরোধ করা হয়েছে। একইসাথে, বাংলাদেশের সাবেক সেনাপ্রধান জেনারেল (অব.) আজিজ আহমেদের যুক্তরাষ্ট্রে প্রবেশে নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হয়েছে এবং তার পরিবারের সদস্যদেরও যুক্তরাষ্ট্রে প্রবেশে অযোগ্য ঘোষণা করা হয়েছে।

ইদানিং দুর্নীতিগ্রস্ত ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের নাম উঠে আসছে। ক্ষমতার অপব্যবহারের কারণে এই ধরনের দুর্নীতির বিরুদ্ধে কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে না, যখন তারা কার্যরত অবস্থায় এবং সক্রিয়ভাবে দুর্নীতি করছে। এটি একটি সামাজিক ও রাজনৈতিক সমস্যা যা দক্ষিণ এশিয়ার অন্যান্য দেশগুলোতেও বিদ্যমান।

ক্ষমতা এবং চাকরিতে থাকাকালীন দুর্নীতির তদন্ত না হওয়া এবং ক্ষমতা চলে গেলে তথ্য ফাঁস হওয়ার প্রধান কারণ হলো ক্ষমতার অপব্যবহার ও রাজনৈতিক প্রভাব। এই অপব্যবহারের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ নেওয়া জরুরি এবং এটি যে সমস্যার মূল কারণগুলোর সঙ্গে সামাজিক ও নৈতিক স্তরে মেলানোর প্রয়োজন, সেদিকে গুরুত্ব দেওয়া আশু প্রয়োজন, কারণ দুর্নীতি একটি সর্বগ্রাসী সমস্যা।

দুর্নীতি বাংলাদেশের জন্য নতুন কোনো সমস্যা নয়। সরকারি, বেসরকারি, এবং সামাজিক সবস্তরেই দুর্নীতি ব্যাপকভাবে বিস্তৃত। সরকারি কর্মকর্তাদের ঘুস গ্রহণ, সরকারি তহবিলের অপব্যবহার, এবং প্রকল্প বাস্তবায়নে অনিয়ম, এসবই দুর্নীতির পরিচিত রূপ।

এছাড়া, নির্বাচন প্রক্রিয়ায় দুর্নীতির ছোঁয়া, প্রভাবশালী রাজনৈতিক দলের দুর্নীতিপূর্ণ কার্যকলাপ সব মিলিয়ে এক ভয়াবহ চিত্র তুলে ধরে। দুর্নীতি কেবল অর্থনৈতিক ক্ষতি করে না, এটি সামাজিক মূল্যবোধকেও দুর্বল করে দেয়। জনগণের মধ্যে বিশ্বাসহীনতা সৃষ্টি হয় এবং সুশাসনের প্রতি আস্থা হারিয়ে ফেলে। এর ফলে, নাগরিকরা আইনের প্রতি শ্রদ্ধা হারিয়ে ফেলে এবং নিজেদের স্বার্থে অমানবিক ও অসামাজিক আচরণ করতে শুরু করে।

দুর্নীতির একটি ভয়াবহ দিক হলো ভোট চুরি এবং জনগণকে ভোট দিতে না দেওয়া। নির্বাচনী প্রক্রিয়ায় ভোট জালিয়াতি, ব্যালট বাক্স ছিনতাই এবং ভোটারদের ভোটদান থেকে বিরত রাখা এসবই গণতান্ত্রিক অধিকারকে হরণ করে। রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে প্রভাবশালী ব্যক্তিরা তাদের ক্ষমতা ধরে রাখার জন্য এসব অপকর্ম করে থাকে। এর ফলে গণতন্ত্রের মূল ভিত্তি নষ্ট হয়ে যায় এবং জনগণের মতামত প্রতিফলিত হতে পারে না।

গণতন্ত্রকে গলা টিপে হত্যা করা অর্থাৎ জনগণের মতামত ও অধিকারকে উপেক্ষা করা, গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলোর দুর্বলতা এবং আইনের শাসনের অনুপস্থিতি একটি বড় সমস্যার রূপ নিয়েছে। এ ধরনের দুর্নীতি সমাজের অবক্ষয় ঘটায় এবং ন্যায়বিচারের পথ রুদ্ধ করে।

অমানবিক আচরণ

অমানবিক আচরণ বাংলাদেশের আরেকটি বড় সমস্যা হিসেবে দেখা দিয়েছে। শ্রমিকদের অধিকার লঙ্ঘন, নারী ও শিশুদের প্রতি সহিংসতা, এবং সংখ্যালঘুদের প্রতি নির্যাতন, এসবই অমানবিক আচরণের উদাহরণ। গার্মেন্টস শিল্পে শ্রমিকদের অমানবিক পরিশ্রম করানো হয়, যেখানে নিরাপত্তার কোনো ব্যবস্থা নেই এবং মজুরিও ন্যায্য নয়।

নারীদের ওপর পারিবারিক নির্যাতন, শিশু শ্রম এবং মানব পাচারের ঘটনা প্রতিনিয়ত ঘটছে। সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের প্রতি বৈষম্য ও নির্যাতন, বিশেষ করে হিন্দু, বৌদ্ধ, এবং খ্রিস্টান সম্প্রদায়ের ওপর আক্রমণ, তাদের সম্পত্তি ধ্বংস এবং জোরপূর্বক ধর্মান্তরকরণ, সমাজে বিভেদ ও অস্থিরতা সৃষ্টি করে।

সমাধানের পথে

দুর্নীতি এবং অমানবিক আচরণ মানুষের মনুষ্যত্ববোধকে ক্রমশ ক্ষীণ করে দিচ্ছে। সাধারণ মানুষ নিজেদের স্বার্থের জন্য অন্যের প্রতি সহানুভূতি হারিয়ে ফেলছে। সমাজে এক ধরনের অসুস্থ প্রতিযোগিতা শুরু হয়েছে, যেখানে একে অপরকে পরাজিত করে নিজেকে ওপরে তোলাই প্রধান লক্ষ্য।

ফলে, সহানুভূতি, সহমর্মিতা, এবং সহানুভূতির মূল্যবোধ হারিয়ে যাচ্ছে। মানবিক মূল্যবোধের এই অবক্ষয় রোধ করতে হলে প্রয়োজন সুশাসন, ন্যায়বিচার এবং সামাজিক সচেতনতা বৃদ্ধি। দুর্নীতি প্রতিরোধে কঠোর আইন এবং তার কার্যকর বাস্তবায়ন, শিক্ষা ব্যবস্থায় নৈতিক শিক্ষা এবং সামাজিক আন্দোলন জরুরি। জনগণের মধ্যে মানবিক মূল্যবোধের উন্নয়ন করতে হবে, যেন তারা একে অপরের প্রতি সহানুভূতিশীল হয়ে উঠতে পারে এবং সমাজে শান্তি ও ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা পায়।

আন্তর্জাতিক মূল্যায়নে প্রভাব

জাতি হিসাবে বিশ্বে আমাদের পাসপোর্টের গুরুত্ব, অর্থনীতি এবং মূল্যায়নে দুর্নীতি মারাত্মকভাবে নেগেটিভ প্রভাব বিস্তার করছে। পাসপোর্ট আমাদের আন্তর্জাতিক পরিচয় ও স্বাধীনতা প্রকাশের মাধ্যম। এটি প্রত্যেক দেশের নাগরিকের প্রতি অন্যদের বিশ্বাস ও বিনম্রতা দেখায়।

পাসপোর্টের গুরুত্ব হিসেবে নিজের দেশ এবং বিশ্বের মধ্যে সম্পর্ক ও প্রভাবের বিশ্বাসযোগ্য প্রতীক হয়ে উঠে। পাসপোর্টের মাধ্যমে আমরা অন্য দেশে ভ্রমণ করতে পারি, বিদেশি শিক্ষা অর্জন করতে পারি, ব্যবসা করতে পারি এবং বিভিন্ন অনুষ্ঠানে অংশ নিতে পারি। কিন্তু বাংলাদেশের পাসপোর্ট সেই সুযোগগুলো জাতিকে সঠিকভাবে দিতে পারছে না, দুর্নীতি এবং অনীতির কারণে।

জাতি হিসাবে বিশ্বের মধ্যে অর্থনৈতিক অবস্থা এবং উন্নতি মূল্যায়ন করা হয় দেশের উৎপাদন ক্ষমতা, বাজারের প্রবৃদ্ধি, আয় ও সঞ্চয়ের মানদণ্ড, বেতন এবং মজুরির স্তর, প্রযুক্তিগত উন্নতি, মানুষের জীবনধারা, ইত্যাদি অনেক পারিপার্শ্বিকতার সঙ্গে। প্রত্যেক দেশের অর্থনীতির পরিসংখ্যানিক তথ্য এবং সুস্থ প্রার্থনা ব্যবস্থা মাধ্যমে তা মূল্যায়ন করা হয়। এটি কোনো দেশের সক্ষমতা ও স্থিতিশীলতা মূল্যায়নের অগ্রগতি ও বিকাশের পরিসংখ্যানিক মূল্যায়ন করে দেখায়।

বাংলাদেশের দুর্নীতি এবং অমানবিক আচরণের সমস্যা এতই ব্যাপক যে এটি মনুষ্যত্ববোধকেও ক্ষতিগ্রস্ত করছে। ভোট চুরি এবং গণতন্ত্রের হুমকি সমাজের ন্যায়বিচার এবং সুশাসনের পথে বড় বাধা সৃষ্টি করছে। এই অবস্থা থেকে উত্তরণের জন্য প্রয়োজন সম্মিলিত প্রচেষ্টা, কঠোর আইন প্রয়োগ এবং মানবিক মূল্যবোধের পুনর্জাগরণ। শুধুমাত্র তখনই আমরা একটি সুষ্ঠু, শান্তিপূর্ণ এবং ন্যায়ভিত্তিক সমাজ গড়ে তুলতে সক্ষম হবো।

রহমান মৃধা, সাবেক পরিচালক, ফাইজার, সুইডেন।
[email protected]

এমআরএম/জেআইএম

প্রবাস জীবনের অভিজ্ঞতা, ভ্রমণ, গল্প-আড্ডা, আনন্দ-বেদনা, অনুভূতি, স্বদেশের স্মৃতিচারণ, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক লেখা পাঠাতে পারেন। ছবিসহ লেখা পাঠানোর ঠিকানা - [email protected]