অস্ট্রেলিয়ার ব্রিসবেনে বৈশাখী মেলা

প্রবাস ডেস্ক
প্রবাস ডেস্ক প্রবাস ডেস্ক
প্রকাশিত: ০৪:৩৫ পিএম, ২৮ মে ২০২৪

মামুন আ. কাইউম, অস্ট্রেলিয়া

দেশ থেকে পড়তে আসা বেশিদিন হয়নি, দুই বছর হবে। তবে আমাদের আশপাশে কোথাও জাতীয় সঙ্গীত, লাল-সবুজের পতাকা, বাংলা ভাষায় কথা শুনলে বুকের মধ্যে কেমন একটা নিজের নিজের অনুভূতি হয়। নিশ্চয়ই এটি বেশিরভাগ প্রবাসীরই হয় বলে আমার ধারণা।

প্রতিদিন দেশে থাকা পরিবারে-বন্ধু বা সমাজের কারো সঙ্গে কথা না বলতে পারলে ‘ঘরকুনো’ আমাদের দিনটা ঠিক ‘দিন’ হয়ে ওঠে না। তেমন একটি প্রেক্ষাপটে যখন ভীনদেশে বৈশাখী মেলার কথা শুনি, যেখানে অন্তত হাজারখানেক বাংলাদেশি মানুষ পুরোটা দিন পরিবার নিয়ে কাটাবে, নিজের প্রাণের ভাষায় নাচ-গান, গল্প, কবিতা, আড্ডা, খাইদাই হবে ভাবতেই মাসখানেক আগে মোবাইলের ক্যালেন্ডারে বুকিং করে রেখেছিলাম।

শুধু নিজের নয়, ছোট্ট কমিউনিটিতে যাদের সঙ্গে বেশি দেখা-আড্ডা হয়, তারাও যেন মিস না করেন সেদিকেও খেয়াল রাখছিলাম। কেনোনা, হাজার মানুষ থাকলেও পরিচিতদের একসঙ্গে রাখা গেলে সেটির আনন্দটা কয়েকগুণ বেড়ে যায় বটে।

মঙ্গল শোভাযাত্রার প্রস্তুতি

বৈশাখটা এ বছর রোজার মধ্যে পড়ায় বিভিন্ন সংগঠন ছোট পরিসরে ব্রিসবেনে উদযাপন করলেও বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন ইন ব্রিসবেন (ব্যাব) সম্ভবত একটু বেশিই সময় নিয়ে ফেলেছিল। অবশ্য সেটাই স্বাভাবিক ছিল কারণ, স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের বছরের একটি ‘সিগনেচার’ অনুষ্ঠানের সফলতার জন্য অনেক প্রস্তুতি আর প্রচারের বিকল্প ছিল না।

শনিবার (২৬ মে) স্প্রিংফিল্ড সেন্ট্রালের রবেলে ডোমেইন পার্কে দিনব্যাপী মেলাটা জমে উঠেছিল। বেলা ১১টায় শুরুর কথা থাকলেও দিনের শুরুতে হাল্কা বৃষ্টি ঘণ্টাদেড়েক পেছাতে বাধ্য করে। মেলায় যে শুধু বাংলাদেশিদেরই উপস্থিতি ছিল তা নয়, স্থানীয় স্পিকার, এমপি, সিটি কাউন্সিলের প্রতিনিধি, পুলিশ বাহিনীর প্রতিনিধি, বিভিন্ন দেশের দূতাবাসের কর্মকর্তাদের উপস্থিতি ও মঙ্গলশোভাযাত্রায় তাদের অংশগ্রহণ অনুষ্ঠানটিকে বহুজাতিক-বহুমাত্রিক করে তুলেছিল।

মেলায় নারী-পুরুষের-শিশুদের রঙিন পোশাকগুলো আর বিভিন্ন পসরা নিয়ে বসা সারি সারি স্টলগুলোর বেচা-কেনা সত্যিই দেশের পহেলা বৈশাখের আমেজ এনেছিল। দূর-প্রবাসের এ আয়োজনে বাংলাদেশ ও অস্ট্রেলিয়ার জাতীয় সঙ্গীতসহ শিশুদের পরিবেশনা, মঙ্গল শোভাযাত্রা, আতশবাজি, স্টলগুলোর ঐতিহ্যবাহী খাবার, লাইভ কনসার্ট, লেজার শো সবই ছিল এককথায় অসাধারণ।

বাংলাদেশি জাতীয় সংগীতের পাশাপাশি আমাদের শিশুরা দরাজকণ্ঠে অস্ট্রেলিয়ার জাতীয় সংগীতও গাইলো। এ সময় দেশি-বিদেশি সবাই দাঁড়িয়ে কণ্ঠ মিলিয়ে অংশ নিয়েছিলেন সবাই। এমনকি সে সময় স্টলগুলোতে বিক্রিও বন্ধ ছিল।

অস্ট্রেলিয়ার ব্রিসবেনে বৈশাখী মেলা

মেলার স্টলে পিঠা-পুলি

এক প্রবাসী জানান, মেলায় পরিচিত ত্রিশ-চল্লিশটি পরিবারের সাথে দেখা হয়ে মনটা ভরে গেছে। অনুষ্ঠানের তালে তালে ফ্লাক্সে করে নেওয়া চা শেষ করে আবার মেলা থেকে কেনা আরেক ফ্ল্যাক্স চা শেষ করলাম। শুধুই কি চা! চায়ের সঙ্গে কলিজার সিঙ্গারা, ফুচকা-চটপটি, পেঁয়াজু, পুলি-পিঠা কোনোটাই বাদ যায়নি। আর বাড়ি ফেরার পথে মেজবানি খাবার নিয়ে বাসায় আসলাম। স্ত্রী-ছেলে, বউদিরা সবাই মিলে হাওয়ায় মিঠাইয়ের স্বাদ নিতে ভোলেনি।

তিনি জানান, দেশের অনেকের মনে হতে পারে, খাবারের গল্প এত দেবার কিইবা আছে? একটিবার ভাবুন, আপনি যেখানে আছেন, আশপাশে অনেককিছুই আছে কিন্তু প্রতিবারই ভাবতে হচ্ছে সেগুলো আমার সংস্কৃতির বা স্বাদের সাথে যাচ্ছে কি না? চাইলেও টং দোকান পাচ্ছেন না, রাস্তার ধারে গরম গরম চা-বিস্কুট-পেঁয়াজুর তালে গল্প জমে ফেলবেন এমন জায়গাও পাচ্ছেন না- তাহলে কেমন লাগবে! বাড়িতে নিজে রান্না করাটাই যেখানে ভরসা, সেখানে এত দেশি স্বাদের খাবার একসাথে স্বাদ নেওয়ার সুযোগ প্রবাসে খুব কমই আসে।

অস্ট্রেলিয়ার ব্রিসবেনে বৈশাখী মেলা

হাওয়া মিঠাই পাবার আনন্দ

মামুন আ. কাইউম বলেন, এবারের মেলাটা মিস না করতে চাওয়ার অন্যতম উদ্দেশ্য ছিল আমার গবেষণার বিষয়। আমি কুইন্সল্যান্ড ইউনিভার্সিটি অব টেকনোলজির ডিজিটাল মিডিয়া রিসার্চ সেন্টারে যে বিষয়ে পিএইচডি করছি সেখানে অস্ট্রেলিয়ায় বাংলাদেশি শিশুরা নিজেদের সংস্কৃতি ধরে রাখার ক্ষেত্রে কীভাবে ডিজিটাল মিডিয়া ব্যবহার করছে সেটিও একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ হিসেবে আছে।

তিনি বলেন, শিশুদের প্রাণবন্ত উপস্থিতি, অনুষ্ঠানের বিভিন্ন অংশে অংশগ্রহণ বিশেষ করে বাংলা ভাষায় নাচ-গান-আবৃত্তি, উপস্থাপনার পারফর্ম দেখে আমি সত্যিই অভিভূত। বিশেষ করে দূর-পরবাসে শিশুরা নিজের সংস্কৃতিকে হারিয়ে ফেলবে কি না এমন দুশ্চিন্তায় থাকা অভিভাবকদের আশার আলোয় রূপ নিতেই পারে। মেলা কর্তৃপক্ষকেও ধন্যবাদ, কারণ তারা এবার শিশুদের প্রবেশ ফি মওকুফ করেছে। আবার বড়দের প্রবেশ ফিও গতবারের তুলনায় অর্ধেক করেছে, যেটি আমাদের সংস্কৃতির সাথে খুব একটা দেখা যায় না! দেশে তো কোনো জিনিসের দাম বাড়লে আর কমে বলে শোনা যায় না।

jagonews24

মেলায় শিশুদের উপস্থাপনা

সবশেষে রাতে ব্যান্ডদল স্টিল বাফারিং, রাফ সান আর দেশি ব্যান্ড তারকা তানজীর তুহিনের গানগুলো উপভোগ্য ছিল। গানের তালে তালে অনেকেই নেচে গেয়ে বাজিমাত করেছেন। পরে অবশ্য ব্যাবের নিজেদের শিল্লীদের ‘তুমি বন্ধু কালাপাখি’, ’বাদলা হাওয়ার তরে’, ‘তুমি চেয়ে আছো তাই’ সহ পরিচিত জনপ্রিয় গানগুলোর তাল অনেককেই নাচিয়ে ছেড়েছিল!

পড়াশোনা বা পেশার তাগিদে দেশান্তরী হয়ে বিদেশে বসবাস করলেও প্রবাসীরা সবসময় দেশকে মিস করে। এভাবেই দেশ থেকে যতদূরেই থাকুক না কেন, ঐতিহ্য-সংস্কৃতির আবর্তে দেশ ও কমিউনিটির অস্তিত্বকে ধারণ করে একসাথে বাঁচুক সবাই- এমনটাই প্রত্যাশা রইলো। আর ‘নিজের খেয়ে বনের মোষ’ তাড়ানোর মতো অসম্ভব ’পাগলামি (ভালোবাসা অর্থে) দেখিয়ে ব্রিসবেনের বাংলাদেশি কমিউনিটিকে নির্মল আনন্দ আয়োজনের জন্য সংগঠন ব্যাব-কে অনেক ধন্যবাদ জানাচ্ছি।

লেখক- মামুন আ. কাইউম, পিএইচডি গবেষক, কুইন্সল্যাল্ড ইউনিভার্সিটি অব টেকনোলজি, ব্রিসবেন, অস্ট্রেলিয়া।

এমআরএম/জেআইএম

প্রবাস জীবনের অভিজ্ঞতা, ভ্রমণ, গল্প-আড্ডা, আনন্দ-বেদনা, অনুভূতি, স্বদেশের স্মৃতিচারণ, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক লেখা পাঠাতে পারেন। ছবিসহ লেখা পাঠানোর ঠিকানা - [email protected]