সাধারণের রবীন্দ্রনাথ

মো. ইয়াকুব আলী
মো. ইয়াকুব আলী মো. ইয়াকুব আলী
প্রকাশিত: ১১:২১ এএম, ০৮ মে ২০২৪
ছবি সংগৃহীত

গিন্নিকে বললাম রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের জন্মবার্ষিকী উপলক্ষে লিখতে চাইছি। আমার কথা শুনে গিন্নি শংকিত দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে বললেনঃ উনাকে নিয়ে লেখার লোকের অভাব নেই তাই আপনাকে না লিখলেও চলবে। গিন্নির উত্তর শুনে আমার মনেও একই ভাবনা তৈরি হলো তাই ব্যস্ততার অজুহাতে আর উনাকে নিয়ে লেখার সাহস করলাম না।

আসলে রবীন্দ্র ভক্ত বা অনুসারী যাই বলি না কেন তারা রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে যুগযুগ ধরে এমনভাবে সংরক্ষণ করে চলেছেন যেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর শুধুই তাদের সম্পত্তি। নিচু জাতের মানুষের জন্য রবীন্দ্রনাথ নয়। নিচু জাতের লোক ছুঁয়ে দিলে রবীন্দ্রনাথ অশুচি হয়ে যাবেন। এভাবেই একটা সময় উনার মৃত্যুবার্ষিকীও চলে আসলো।

এভাবেই প্রতি বছর রবীন্দ্র জন্মবার্ষিকী এবং মৃত্যুবার্ষিকী আসে এবং চলে যায়। আবার এর মধ্যেই শুরু হয়েছিল জাতীয় সংগীত নিয়ে বিতর্ক। তখন মনে হয়েছিল আমার মতো ক্ষুদ্র একজন মানুষের রবীন্দ্র ভাবনা সবার সাথে শেয়ার করা যেতেই পারে কিন্তু সময়ের অভাবে আর লেখা হয়ে উঠে না। এইবার ভাবলাম লিখেই ফেলা যাক।

শুরুতেই বলে রাখা ভালো আমি বেড়ে উঠছি কুষ্টিয়ার শহরতলীর একটা গ্রাম বাড়াদিতে। শহরের পৌরসভার সীমানা যেখানে শেষ হয়েছে সেখান থেকে আমাদের গ্রাম শুরু হয়েছিল এখন অবশ্য পৌরসভার অন্তর্ভুক্ত। প্রাথমিকের পাঠে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সাথে পরিচয় হয়েছিল প্রথম ‘আমাদের ছোট নদী’ কবিতার মাধ্যমে। তখনও জানা ছিল না কুষ্টিয়াতেই রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কুঠিবাড়ি এবং কাচারি বাড়ি আছে এবং কবিতাটা কুষ্টিয়ারই একটা নদীকে দেখে লেখা।

পরে জানতে পারলাম। আমাদের ছোট নদী আসলে কুষ্টিয়ার গড়াই নদী যেটা আসলে পদ্মা নদীর একটা শাখা নদী। কুষ্টিয়ার তালবাড়ির নিকট জায়গা থেকে শাখাটা বের হয়ে কুষ্টিয়া শহরের কোল ঘেঁষে দক্ষিণে চলে গেছে। এছাড়াও শিলাইদহতে উনার কুঠিবাড়িতে গিয়ে দেখেছি উনি যে বারান্দায় বসে লেখালেখি করতেন সেখান থেকে পরিষ্কারভাবে পদ্মা নদী দেখা যায়। এরপর উনার লেখা ‘বীর পুরুষ’ আর ‘আষাঢ়’ কবিতা দুটো পড়া হয়েছিলো কিন্তু উনার সম্মন্ধে সেইভাবে তেমন কিছুই জানতাম না।

উনি কতবড় মাপের কবি বা সাহিত্যিক সেই বিষয়ে বিন্দু বিসর্গও ধারণা ছিলো না বরং গ্রাম্য পরিবেশে বেড়ে ওঠা মানুষদের কাছ থেকে উল্টোটাই শুনতাম। সেটা হলো উনি নাকি কাজী নজরুল ইসলামের লেখা চুরি করে নোবেল নামের একটা দামি পুরস্কার পেয়েছিলেন।

এরপর মাধ্যমিকের বাংলা বইয়ের সাথে পড়া বাড়তি গল্পের বই দ্রুতপঠনে পড়া কাবুলিওয়ালা গল্পটার কথা স্মরণ হয় শুধু। মাধ্যমিকের গন্ডি পেরিয়ে উচ্চমধ্যমিকের বাংলা পাঠ্যবইয়ের হৈমন্তী গল্পটা আমাদের সিলেবাসে ছিল তাই পড়া হয়েছিলো। হৈমন্তীর কাহিনির গুণেই গল্পটা হৃদয়ে দাগ কেটেছিলো। হয়তোবা হৈমন্তীর করুণ পরিণতি আমার কিশোর মন নিতে পারেনি।

এরপর আর রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সাথে পরিচয় হওয়ার সুযোগ ঘটেনি। তবে মাঝে মধ্যে কাউকে ধীরলয়ের রবীন্দ্র সংগীত শুনতে দেখলে ঠাট্টা করে বলতাম আপনার বয়স বেড়ে গেছে। আপনি প্রৌঢ় হয়ে গেছেন। রবীন্দ্র সংগীত হচ্ছে সেই বয়সের গান যেই বয়সে মানুষের আর কিছুই করার থাকে না। তখন বারান্দায় ইজি চেয়ারে বসে মৃদু মৃদু দুলবে আর সারাদিন ধরে রবীন্দ্র সংগীত শুনবে। আর রবীন্দ্র সংগীতকে আমার কেন জানি প্যাকপ্যাকে প্রেমের গান মনে হতো। বাস্তব জীবনের ক্ষুধা দারিদ্র্যের স্থান সেখানেই নেই তাই আরও বেশি বিরক্ত হতাম।

পশ্চিম বাংলার আনন্দমেলা পত্রিকা আমাদের খুবই প্রিয় ছিল। সেই পত্রিকার মাধ্যমেই অন্য অনেক লেখকের সাথে পরিচয় হলেও রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সাথে পরিচয় হয়নি। আর গোয়েন্দা উপন্যাস, বিজ্ঞান কল্পকাহিনী বা থ্রিলারধর্মী বইগুলোই বরাবর আমাকে বেশি টানে তাই সাহিত্য খুব একটা পড়া হয়নি। আর পশ্চিম বাংলার আর্থ সামাজিক অবস্থা নিয়ে বাংলাদেশে যে গল্পগুলো প্রচলিত আছে সেকারণেই আমি কখনওই সমসাময়িক সাহিত্যগুলোকে পড়তে আগ্রহ পেতাম না।

আমার বারবার মনে হতো যেহেতু ওপারের সাথে এপার বাংলার মানসিকতার অনেক তফাৎ তাই ওদের সাহিত্যে আমাদের জীবনের ছোয়া খুব একটা পাওয়া যাবে না। তার চেয়ে এপারের বাংলা সাহিত্য পড়ায় শ্রেয়। যদিও বাড়িতে আমাদের মেজো ভাই ইউনুস সমসাময়িক পশ্চিম বাংলার সাহিত্যের সব বই পড়ে শেষ করে ফেলেছিল।

ওর কাছেই একদিন দেখলাম ‘প্রথম আলো’ নামের ঢাউস আকৃতির একটা বই। যদিও জানি এই বই পড়ে শেষ করার মতো ধৈর্য্য আমার নেই তবুও হাতে যেহেতু অন্য কোনো বই নেই তাই সময় পার করার জন্য পড়তে শুরু করলাম। কিছুদূর পড়ার পরই বইটা আমাকে চুম্বকের মতো আটকে ফেললো। সংসারের কাজকর্ম করবো না কি এই বই পড়ে শেষ করবো। আবার আমি যেহেতু অনেক ধীরে ধীরে পড়ি তাই পড়াটাও সেইভাবে আগাচ্ছিলো না।

ধীরে ধীরে পড়ার কারণে বই পড়ার সময় আমার চোখের সামনে বইয়ের চরিত্রগুলো চলাফেরা শুরু করে। এটা আমি খুবই উপভোগ করি। এমনকি বই পড়া শেষ হয়ে গেলেও বইয়ের চরিত্রগুলো মাথার মধ্যে থেকে যায়। এই বইটা যদিও উপন্যাস আকারে লেখা তাই লেখককে অনেক কল্পনার আশ্রয় নিতে হয়েছে তবুও রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে নিয়ে পড়া আমার প্রথম এবং এখন পর্যন্ত শেষ বই। ভবিষ্যতে উনার উপরে লেখা আরো কোনো ভালো বই হয়তোবা পড়া হবে।

এরপর রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের প্রতি এক ধরনের শ্রদ্ধা কাজ করতে শুরু করলো। একজন মানুষ পুরোপুরি সমাজ সংসার সেই সাথে জমিদারি পরিচালনা করে কীভাবে এত কিছু লিখে গেছেন। এরপর এক আত্মীয়ের বাসায় উনার লেখা গল্পগুচ্ছ পেয়ে বাসায় নিয়ে আসলাম। যতবারই ততবারই মুগ্ধ হই। উনি এত সহজ ভাষায় ছোটগল্পও লিখে গেছেন। এরপর নাগরিক ব্যস্ততায় উনার আর কোনো লেখা তেমন একটা পড়া হয়নি কিন্তু মনের মধ্যে ক্ষুধা তৈরি হয়ে আছে উনার লেখা পড়ার।

একদিন পত্রিকা মারফত জানতে পারলাম পাঠক সমাবেশ নামে একটা প্রকাশনা সংস্থা রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের প্রকাশিত অপ্রকাশিত সকল রচনা, চিত্রকর্ম এমনকি চিঠিপত্রের সমাহারে পঁচিশ খন্ডের রবীন্দ্রসমগ্র বের করতে যাচ্ছে। বিজ্ঞাপনটা দেখে খুবই খুশি হলাম কিন্তু আবার দমেও গেলাম কিছুটা কারণ সমগ্র পঁচিশ খণ্ডের দাম রাখা হচ্ছে পাঁচ হাজার টাকা। একটা তারিখ উল্লেখ করে দিয়ে যোগাযোগ করতে বলা হয়েছে। গিন্নিকে বললাম বুকিং দেওয়ার জন্য কিন্তু তিনি রাজি হলেন না আর আমিও ভুলে গেলাম।

এরপর দেখি আবার সেই একই বিজ্ঞাপন। বুকিং দেওয়ার মেয়াদ বাড়ানো হয়েছে। এইবার গিন্নিকে রাজি করিয়ে ফেললাম। এবং এক ছুটির সকালে আজিজ সুপার মার্কেটে যেয়ে বুকিং দিয়ে আসলাম। এরপর থেকে পত্রিকার পাতায় চোখ রাখতাম কবে থেকে বের হওয়া শুরু হয় সেটা জানার জন্য। প্রথম খন্ড বের হওয়ার পর দ্রুতই যেয়ে সেটা সংগ্রহ করে আনলাম এবং বইয়ের আলমারিতে একটা খোপ উনার জন্য আলাদা করে ফেললাম।

সেই খোপে শুধুই উনার বই রাখা হবে। একটা করে খন্ড বের হয় আর পত্রিকা মারফত সেই খবর পাওয়া মাত্রই সেটা সংগ্রহ করে আনি। দেশ ছেড়ে আসার আগ পর্যন্ত যতদূর মনেপড়ে আঠারো খন্ড বের হয়েছিলো এরপর বাকি খন্ডগুলো বের হয়েছে এবং আমার শ্যালক সেগুলো নিয়ে এসেছে। এরপর পঁচিশ খন্ডের দাম বেশ কয়েক ধাপে বেড়ে গিয়ে বর্তমানে সেটা দাঁড়িয়েছে পঁয়তাল্লিশ হাজারে। এখন মনে হয় ভাগ্যিস তখন বুকিং দিয়েছিলাম নাহলে জীবনেও রবীন্দ্রসমগ্র আমার কেনা হতো না। এখন রাস্তা খুঁজতেছি কিভাবে কম খরচে পঁচিশ খন্ডকে বাংলাদেশ থেকে অস্ট্রেলিয়ায় নিয়ে আসা যায়।

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সাথে বাংলাদেশের প্রকৃতি থেকে শুরু করে আর্থ সামাজিক প্রেক্ষাপট অঙ্গাঙ্গিকভাবে জড়িত। উনি শুধু আমাদের জাতীয় সংগীতের রচিয়তায় নন উনার গান ছাড়া বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় সাংস্কৃতিক উৎসব পহেলা বৈশাখ পালন করা অসম্ভব। যদিও এখন জাতীয় সংগীত এমনকি উনার পহেলা বৈশাখ নিয়ে রচিত গানেরও বিভিন্ন ধরনের ব্যাখ্যা খুঁজে বের করা হচ্ছে। খুঁজে বের করা হচ্ছে উনি বাংলাদেশের সর্ববৃহৎ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠার উনি পক্ষে না বিপক্ষে ছিলেন।

এই সবগুলো ব্যাপারই খুবই দুঃখজনক হলেও আমার কাছে অবাক লাগেনি কারণ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে কখনওই জনমানুষের কাছে সেইভাবে পৌঁছাতে দেওয়া হয়নি। পাকিস্তানিরা সেটা করেছিল আইন করে আর স্বাধীন বাংলাদেশে সেটা করা হয়েছিল শুদ্ধতার দোহায় দিয়ে। এখানে পথে ঘটে অলিতে গলিতে মমতাজের মতো সংগীত শিল্পীর চটুল ছন্দের এবং সুরের অশ্লীল গান বাজতে শোনা গেলেও রবীন্দ্র সংগীত বাজতে শোনা যায় না হয়তোবা রবীন্দ্র সংগীতের ধীরলয়ের কারণে।

পহেলা বৈশাখের সবচেয়ে বড় উৎসব রমনার বটমূলের সাংস্কৃতিক পরিবেশনায় হামলা ছিল অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশে সবচেয়ে বড় আঘাত। এরপর থেকে বাংলাদেশের সমাজ ব্যবস্থায় ধীরে ধীরে একটা আমূল পরিবর্তন এসেছে। আমি জানি না আমাদের সমাজ গবেষকরা সেদিকটা খেয়াল করেছেন কি না? বটমূলে হামলার পর মুসলিম সংখ্যা গরিষ্ঠের দেশে সবাই হঠাৎ করে উপলব্ধি করতে শিখলো যে পহেলা বৈশাখ পালন আসলে হিন্দুয়ানী একটা ব্যাপার।

নব্বই শতাংশের ওপরে যে দেশের জনগোষ্ঠী মুসলিম সেখানে এইসব বিদাতি কাজকর্ম বরদাস্ত করা হবে না যদিও অধিকাংশ মুসলিম অনেক বেশি উদারনৈতিক মানসিকতা সম্পন্ন। এরপর একদল দাঁড়িয়ে গেলো পহেলা বৈশাখের গানটার ব্যবচ্ছেদ করতে। তাদের অনেকগুলো ব্যাখ্যার একটি হচ্ছে ‘অগ্নিস্নানে শুচি হোক ধরা’ কথাটার মানে হচ্ছে অগ্নি পূজা করা। যেহেতু হিন্দুরা অগ্নি পূজা করে তাই তারা অগ্নি স্নানে এই পৃথিবীকে পবিত্র করতে চাইছে। ব্যাখ্যাটা অদ্ভুত শোনালেও অশিক্ষিত, অর্ধ শিক্ষিত মানুষ ছাড়াও অনেক শিক্ষিত মানুষ মনেমনে এই ব্যাখ্যাটা মেনে নিয়েছে।

এছাড়াও এখন রমনার বটমূলের সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান থেকে শুরু করে চারুকলার মঙ্গল শোভাযাত্রাটা হয় পুলিশি পাহারায়। একবার রমনার বটমূলের অনুষ্ঠান শেষে সানজিদা খানম খুব দুঃখ ভরাক্রান্ত হৃদয়ে পুলিশি প্রহরার ব্যাপারটা বললেন। উনি বললেন এভাবে ধরে বেঁধে করা এই সমস্ত অনুষ্ঠানে আর যায় থাকুক প্রাণের পরশ থাকে না আর যেখানে প্রাণের পরশ থাকে সেটা কখনওই জনমানুষের অনুষ্ঠান হয়ে উঠে না। একই মত আমারও। ওরা এই কর্মকান্ডগুলোকে জনবিচ্ছিন্ন করতেই হামলাটা চালিয়েছিল এবং তারা সর্বাংশে সফল হয়েছে। আমি বেশ কয়েকবার মঙ্গল শোভাযাত্রায়ও গিয়েছি। সেখানেও দেখেছি আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর কড়াকড়ি।

অনেকটা চিড়িয়াখানার পশুকে খাঁচায় ভরে জনগণের সামনে প্রদর্শন করার মতো। আমার কথা হচ্ছে হামলার ভয়ে এই অনুষ্ঠানগুলোর আয়োজনে কোনো প্রকার কড়াকড়ি আরোপ না করাই ভালো। তাতে করে জনমানুষের অংশগ্রহণ অনেক বাড়বে আশা করি। যেমন বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ যদি শুধু সেনাবাহিনী বা প্রশিক্ষিত যোদ্ধাদের দিয়ে লড়া হতো তাহলে বাংলাদেশ আদৌ স্বাধীন হতো কি না আমার সন্দেহ আছে।

বাংলাদেশের স্বাধীনতার বিষয়টা বাংলাদেশের আপামর জনসাধারণ সবাই অনুভব করেছিলেন এবং যার যার সামর্থ্য অনুযায়ী এগিয়ে এসেছিলেন বলেই আমরা বাংলাদেশ নামে একটা স্বাধীন রাষ্ট্র পেয়েছিলাম। ঠিক একইভাবে এখন এইসব গোড়ামির বিরুদ্ধে বাংলাদেশের বৃহত্তর জনগোষ্ঠীকে সোচ্চার করতে না পারলে অনুষ্ঠানগুলো যেমন একদিকে সৌন্দর্য হারাবে অন্যদিকে আমার কেনজানি মনে হয় একসময় এগুলো বন্ধ করে দেবে বাংলাদেশের সরকার কারণ রাজনৈতিক দলগুলো মূল্যবোধের চেয়ে ভোটারের সংখ্যাকেই প্রাধান্য দেয় বেশি।

এছাড়াও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠার উনি বিরোধিতা করেছিলেন এটাও অনেকে মনে করেন। এই তথ্যটা আমি প্রথম জানতে পারি উচ্চমাধ্যমিক দিয়ে ভর্তি কোচিংয়ের সময়টাতে। সবাই ঢাকাতে কোচিং করতে গেছে। আমার সামর্থ্যে কুলায় নাই বলে আমি যেতে পারিনি। একদিন এক বন্ধুর মাধ্যমে খোঁজ পেলাম কুষ্টিয়াতে সাকসেস নাম একটা কোচিং সেন্টার আছে যেটা বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্র শিবিরের ছেলেরা চালায়। প্রথম দুটো ক্লাস ছিলো ফ্রি। সেই ফ্রি ক্লাসের এক আলোচনায় সেখানকার একজন শিক্ষক এই তথ্যটা দিয়েছিলেন।

এরপর আর আমি সেই কোচিং সেন্টারে যাইনি। আর বর্তমানে চলছে জাতীয় সংগীত নিয়ে বিতর্ক। অনেকেই জাতীয় সংগীত রচনার প্রেক্ষাপট নিয়ে পড়েছেন আবার অনেকেই বিষয়বস্তু বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে কতখানি প্রাসঙ্গিক সেটা নিয়ে ভাবছেন। আমি অবাক হয়ে সেইসব আলোচনা অনলাইনের ফোরামগুলোতে দেখি আর স্তব্ধ হয়ে যায়। হাতেগোনা কিছু মানুষ সেটার প্রতিবাদ করলেও আমজনতার ব্যাপারটা অনেকটা নিমরাজি ধরনের কারণ তাদের নিজেদের কোন মতামত নেই।

তাদের আপনি কোনো জিনিস গেলাতে চাইলে তার সাথে এক ফোটা ধর্মের রস মিশিয়ে দেন। দেখবেন কি সুন্দর গিলে ফেলছে। আমার রাগ বা দুঃখটা হচ্ছে রবীন্দ্রনাথের মতো একজন সাহিত্যিককে আমরা মূল্যায়ন করতে পারিনি বা করতে চাইনি। আর উনার গানের বা কবিতার সৌন্দর্য হরণ হয়ে যাবে বলে কিছু অতিমাত্রায় শিক্ষিত জনগোষ্ঠী সেটাকে নিজেদের সম্পদ হিসেবে কুক্ষিগত করে রেখেছে। অবশ্য শান্তি নিকেতনের বিধিনিষেধের পর অনেকেই রবীন্দ্র সংগীত নিয়ে কাজ করছেন এবং সেগুলো আমাদের তরুণ প্রজন্ম শুনছেও সেটাই আসার কথা।

একবার যখন সেটা শুনবে তখন সে সেটার উৎস অনুসন্ধান করবে এবং একসময় অরিজিনাল ভার্সনটাই শুনে ফেলবে। তখন সিদ্ধান্তের ব্যাপারটা তার উপরই ছেড়ে দিতে হবে সে কোনটা শুনবে বা ধরে রাখবে কিন্তু শুরুতেই যদি আমি বিধি নিষেধের জালে বেঁধে ফেলি তাহলে সেটা আর শোনা হবে না। প্রবাস জীবনেও রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে গোষ্ঠীভিত্তিক কাজ হলেও সামগ্রিক কোনো কাজ হচ্ছে না তাই দেশের মতো প্রবাসে রবীন্দ্রনাথ কিছু মানুষের উত্তরাধিকার হয়ে রয়ে গেছেন।

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সমগ্র হয়তোবা একসময় পড়তে অশুরু করলে উনার মেধার আরো অনেক দিকের সন্ধান পাবো কিন্তু আমার একসময় ধারণা ছিলো উনি শুধুমাত্র আঁতেল জনগোষ্ঠীর জন্যই লিখে গেছেন। আমার এই ধারণা ভুল প্রমাণ করে দিয়েছেন আমাদের প্রতিবেশী নাজমুল ভাই। উনি একদিন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের একটা কবিতা আবৃত্তি করে শোনালেন। শুনে আমি খুবই খুশি হলাম কিন্তু তখনও জানতাম না যে এমন লেখাও রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর লিখে গেছেন। পাঠকের জন্য লেখাটা এখানে হুবহু তুলে দিচ্ছে আশাকরি সবাই বর্তমান বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সর্বজনীনতার একটা উদাহরণ পেয়ে যাবেন।

‘ভালো মানুষ নই রে মোরা ভালো মানুষ নই–
গুণের মধ্যে ওই আমাদের, গুণের মধ্যে ওই॥
দেশে দেশে নিন্দে রটে, পদে পদে বিপদ ঘটে–
পুঁথির কথা কই নে মোরা, উল্টো কথা কই॥
জন্ম মোদের ত্র্যহস্পর্শে, সকল অনাসৃষ্টি।
ছুটি নিলেন বৃহস্পতি, রইল শনির দৃষ্টি।
অযাত্রাতে নৌকো ভাসা, রাখি নে, ভাই, ফলের আশা–
আমাদের আর নাই যে গতি ভেসেই চলা বই।’

এমআরএম/এএসএম

প্রবাস জীবনের অভিজ্ঞতা, ভ্রমণ, গল্প-আড্ডা, আনন্দ-বেদনা, অনুভূতি, স্বদেশের স্মৃতিচারণ, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক লেখা পাঠাতে পারেন। ছবিসহ লেখা পাঠানোর ঠিকানা - [email protected]