নারী ‘দ্য বস’
বেশ অনেক বছর ধরেই ৮ই মার্চ পালিত হচ্ছে আন্তর্জাতিক নারী দিবস হিসেবে। আজও একটা সেমিনার ছিলো মেলবোর্ন সিটিতে, নারীকে সাবলম্বী করার প্রেক্ষিতে নারীর অধিকারগুলোকে দিবস এলেই আলোচিত হচ্ছে বেশ জোর গলায়। প্রায়শই কানে আসে নারীর অধিকার বা নারী পুরুষের সম অধিকার নিয়ে বিভিন্ন ধরনের কথা। চুপচাপ শুনি, নিজের মতো করে ভাবি, এরপর আরো চুপ হয়ে যাই, না হয়ে কোনো উপায় নেই, কারণ যা বলতে ইচ্ছে করে তা অনেকের কাছেই বোধগম্য হয় না।
আচ্ছা যদি বলি, সম অধিকার বিষয়টা আসলে কি?
যে কাজ কোনো রকমের সমস্যা ছাড়াই যদি কোনো পুরুষ সম্পন্ন করতে পারে, সেই একই কাজ নারীও কোনো সমস্যা ছাড়াই সম্পন্ন করতে পারাটাই সমঅধিকার হওয়া উচিত। আসলেই কি তাই হয় কখনো? হতে দেওয়া হয়?
উদাহরণ তো ভুরিভুরি দেওয়া যায়, কোনটা ছেড়ে কোনটা দেবো!
নারী-পুরুষ আসলেই কী সমান? কখনোই না। কিছু ক্ষেত্রে এবং গুণাবলীতে নারী পুরুষের চেয়ে যোজন যোজন গুণ বেশি এগিয়ে আবার কিছু ক্ষেত্রেও গুণাবলীতে পুরুষ এগিয়ে। নারী পুরুষের বিভেদ প্রকৃতি নিজেই সুনিদিষ্টভাবে করেছেন স্রষ্টার ইচ্ছেতে, এখানে কারোরই কিছু করার নেই। প্রাকৃতিকভাবেই নারী কিছুটা বেশি আবেগপ্রবণ এবং নমনীয়, সর্বোপরি মায়ের জাতি। শুধু এই একটা কারণেই নারীকে সর্বোচ্চ সম্মান দেওয়া হয়েছে, তবুও সমাজে নারীরা প্রতিটি ক্ষেত্রেই হেনস্তার শিকার। অন্যদিকে পুরুষেরা শারীরিকভাবে সামর্থবান হওয়ায় সবকিছুতেই নিজেদের বেশি সামর্থবান ভাবতে শুরু করে। শুরু হয় মনস্তাত্ত্বিক দ্বন্দ্ব এরপরে আরো অনেক কিছুরই সূত্রপাত...
ইদানীং কোমলমতি নারীরা তাই কঠোররূপে অবিভূত হয়েছেন, নিজেদের নিরাপত্তা, অধিকার আদায়ে মুখ খুলেছেন, আয়োজন করে নারী দিবস, বিভিন্ন কর্মসূচি এবং নানা ধরনের আলোচনা সভা হচ্ছে। তাতে করে কি নারীর অধিকার বেড়েছে? নিরাপত্তা বেড়েছে? স্বাধীনতা বেড়েছে? স্বাধীনতা শব্দটাই তো একেকজনের ক্ষেত্রে একেকরকম।
নারীর অধিকার আদায়ের লক্ষ্যে প্রধান অন্তরায় আসলে কী? মাঝে মধ্যে কানে আসে নারীরাই নারীর প্রধান শত্রু, আসলেই কি তাই? নাকি তারাও সমাজের কতিপয় পুরুষের সুতো ধরা পুতুল হয়ে কাজ করে যায় মাত্র।
একটি ভয়ঙ্কর রকমের তিতা সত্য হলো অল্পসংখ্যক পুরুষ ছাড়া সমাজের বেশিরভাগ পুরুষই চান না নারীরা তাদের সম্মান, অধিকার নিয়ে বাঁচুক, বরং অধীনস্ত করে রাখতে তুচ্ছ তাচ্ছিল্য করে রাখতে বেশি স্বাচ্ছন্দ বোধ করেন। নারীকে পণ্য বানানো, নারীর অধিকার নিয়ে ট্রল করা, নারীকে ছোট করে বার্তা প্রতিনিয়ত চোখে পড়ে। এমনিতেই নারীদের পথে পথে কাঁটা ছড়ানো থাকে কিন্তু কান পাতলেই কানে বাজে এসব কাঁটা সর্বপ্রথম নারীদের পরিবার থেকেই শুরু হয়। প্রথমত বাবা, ভাই, পরবর্তীতে প্রেমিক, স্বামী, শ্বশুর, ভাসুর, দেবর কর্মক্ষেত্রে পুরুষ সহকর্মী ইত্যাদি কারো না কারো আবার অনেক সময় সবার দ্বারাই নারী হয় ব্যথিত, নিষ্পেষিত, অবহেলিত।
নারীরা ঘরে বাইরে প্রতি পদে পদে বাঁধার সম্মুখীন হয় সর্বপ্রথম কাছের পুরুষ দ্বারাই, সেখানে সংগ্রাম করে এগিয়ে যাওয়া মোটেই সহজ কোনো বিষয় নয়, সবাই ঘরে শান্তি চায়। জীবন দুর্বিসহ হয়ে দেয়ালে পিঠ না ঠেকা পর্যন্ত নারীরা আসলে সমঝোতাই করে, খুব একটা বিদ্রোহী হয় না।
তাহলে নারী দিবসে নারীর অধিকার নিয়ে চিল্লাচিল্লি করে কি লাভ? আগে তো সমাজের পুরুষদের মানসিক সুস্থতা কামনা করা উচিত যে তারা কেন নারীকে নিয়ে হীনমন্যতায় ভোগেন? কেন প্রতিযোগী ভাবেন? কেন নারীকে একে অপরের পরিপূরক ভাবতে পারেন না? কেন স্বার্থহীন ভালবাসতে জানেন না!
নারী দিবসে আলোচনার বিষয়বস্তু হওয়া দরকার কি করে পুরুষরা আরো মানবিক এবং সহনশীল এবং উদার হবেন। কীভাবে পুরুষেরা নারীদের প্রতি ভদ্র সামাজিক আচরণ ও আবেগীয় আচরণ করা শিখবেন। কীভাবে পুরুষেরা বুঝবেন যে শারীরিক শক্তি, গলার জোর ইত্যাদি কখনোই মানবিক মানুষের পরিচয় বহন করে না। মন চাইলেই সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে কটূ, চটুল বা অশালীন মন্তব্য করে নারীদের ছোট করতে গিয়ে যে নিজেরাই ছোট হন, ওনারা এসব কবে বুঝবেন! কোনো উপায় জানা আছে কি?
আমি আগেও বলেছি আবারো বলছি আমি কিন্তু সব পুরুষের কথা বলছি না, কতিপয় বলেছি তবে এই সংখ্যা অবশ্যই বেশি সংখ্যক। সমাজের কম সংখ্যক পুরুষদের মধ্যে অবশ্যই মানবিক গুণাবলী রয়েছে, যেকোনো বিষয়বস্তু নিরপেক্ষভাবে চিন্তা করার মতো বিবেচনা বুদ্ধি রয়েছে, সেজন্য এখনো কিছু সম্পর্ক সাবলীলভাবে চলমান।
হুট করে একা একা অবশ্যই সমাজ বদলানো যায় না, কিন্তু সদিচ্ছা থাকলে নিজ পরিবার থেকে বদলের চেষ্টা শুরু করা যায়। জীবনে নারী হয়ে জন্মিয়ে যেসব নারীদের প্রতিনিয়ত বাধার সম্মুখীন হতে হয়েছে এবং দৃঢ় মনোবল সম্পন্ন নারীরা একটা সময় সেগুলো পেরিয়ে গেছেন একটার পর একটা। আগামী প্রজন্মের নারীদেরও যেন সেই দুর্ভোগ পোহাতে না হয়, তারা যেন একটা স্বাভাবিক সমাজ, সুস্থ মানবিক বোধ সম্পন্ন পুরুষ পরিবারে ও কর্মক্ষেত্রে দেখতে পায় সেই দায়িত্ব কিন্তু খানিকটা আপনাদের মত মানসিকভাবে শক্তিশালী নারীদের ওপর বর্তায়।
তাই লেখা শেষ করছি যেসব নারীদের ছেলে সন্তান রয়েছে, তাদের প্রতি একটি অনুরোধ রেখে...
আপনার ছেলে সন্তান যেন সমাজের এবং পরিবারের কোনো মেয়ের দুঃখের বা ক্ষতির কারণ হয়ে না দাঁড়ায়। ছোটবেলা থেকেই আপনার ছেলে সন্তানদের নিরপেক্ষ দৃষ্টিভঙ্গি, সঠিক আচরণ, শিক্ষা, বিবেচনা বোধ দিয়ে বড় করুন যেন আপনার ঘরে বড় হওয়া ছেলেটা অন্তত অন্য নারীদের কাছে নিরাপদ মানব হিসেবে চিহ্নিত হয়। ছেলে সন্তানের ‘মা’ হিসেবে এর থেকে গর্বের আর কিছু হতে পারে বলে আমার মনে হয় না।
নয়তো নারী দিবসে নানা অধিকার নিয়ে যতই গলা ফাটান ফলাফল আদতে শূন্যই।
এমআরএম/এএসএম