ভালোবাসার গল্প ‘এলিয়েন’

শায়লা জাবীন
শায়লা জাবীন শায়লা জাবীন
প্রকাশিত: ১১:০৭ এএম, ১৫ ফেব্রুয়ারি ২০২৪
ছবি সংগৃহীত

ঐন্দ্রিলা বুঝে উঠতে পারছে না, ছেলেটা আসলে কি চায়...! ফ্রেন্ডলিস্টে আছে বছরখানেক, বয়সে এক দুই বছরের বড় তার থেকে। কখনো উল্টোপালটা কিছু বলেনি বা পাঠায়নি, ইদানীং মেসেঞ্জারে দু চারটে গানের লিঙ্ক পাঠায়। তবে কিছু বলে না, গানগুলো সে তার নিজের ওয়ালেও শেয়ার করে, তাহলে আলাদা করে তাকে পাঠাতে হবে কেন? ছেলেটা দেখতে হ্যান্ডসাম প্রচুর বন্ধুবান্ধব আছে, হৈ হুল্লর করে বেড়ানো টাইপ, দিন দুনিয়ায় কিছু একটা হলেই সেটা নিয়ে স্ট্যাটাস দিয়ে বসে, ভাইরাল বিষয় আরো ভাইরাল করে।

দুইদিন পরপর নিজের ছবি আপলোড করে, কিছু মেয়ে আবার সস্তা টাইপের গলে যাওয়া কমেন্ট করে সেখানে। মাঝে মধ্যে দু’চারটে কবিতাও পোস্ট করে নিজেকে কিছুটা সাহিত্য অনুরাগী বোঝাতে যদিও ঐন্দ্রিলার সেগুলো বড়শীর টোপ ছাড়া বেশি কিছু মনে হয় না। চাকরি-ব্যবসা কিছু একটা করে মনে হয় ঠিক জানে না সে। আজ হঠাৎ বেশ অর্থবোধক একটা গান পাঠিয়েছে... আগেরগুলোরও অর্থ ছিল কিন্তু সেভাবে না ভাবলেও চলতো, আজকের গানটা ভাবাচ্ছে...

অতনু অনেকক্ষণ তাকিয়ে থেকেও কিছুতেই নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারছে না, ঠোঁটের কিনারার হাসি সুবিস্তৃত হলো, দুপাটি দাঁত বেরিয়ে গেলো খুশিতে! চিৎকার করে তার বলতে ইচ্ছে করছে ইয়াহু... কত মিনিট কত ঘণ্টা কত সময় সে অপেক্ষা করছে এই দিনটার জন্য।

এখন তার খুব ভেবে চিন্তে আগাতে হবে, একটু ভুল করলেই বিপদ হয়ে যাবে। অতনু মনোযোগ দিয়ে তাকিয়ে আছে মেসেঞ্জারে আসা টেক্সটার দিকে..., ঐন্দ্রিলা নাম মেয়েটার, কেমন যেনো সম্মোহনী করে ফেলার মতো চেহারা এবং চাহনি
নিয়ে জন্মেছে সে। অতনুর সাথে ফেসবুকে আছে প্রায় এক বছর, দুজনেই কম বেশি গান গায়, সেই সূত্রে এক মিউচুয়াল ফ্রেন্ড রায়হানের শেয়ার করা পোস্টের কমেন্ট এ প্রথম পরিচয়। ওখানে অতনু এবং ঐন্দ্রিলা দুইজনেই বেশ হাসির কমেন্ট করেছিল, এরপর প্রোফাইল পিকচারটা দেখেই কেমন উদাস হয়ে গিয়েছিল অতনু, দিন সাতেক অনেক কিছু চিন্তা করার পর ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট পাঠিয়েছিল, প্রায় দিন তিনেক পার হবার পর অতনু যখন সব আশা ছেড়ে দিয়েছিল তখন ঐন্দ্রিলা ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট একসেপ্ট করেছিল।

এরপর থেকে শুধু ফেসবুক ফ্রেন্ড হয়েই থেকে যাওয়া, কখনো কোনো কথাবার্তা হয়নি। অতনু ভেবে পাচ্ছে না এই মেয়ের সাথে কীভাবে কথা শুরু করবে! মেয়েটা পাত্তা না দিলে তো কথা আগানো যাবে না। অতনু অতটা গায়ে পরা ছ্যাঁচড়াও হতে পারছে না যে আগ বাড়িয়ে কথা শুরু করবে। এত্ত এত্ত মেয়ে তার পিছে লাইন দিয়ে থাকে কিন্তু সে আটকালো এমন এক জায়গায় যে কোনো কূল কিনারা নাই। এই এক মেয়ে যে তার মাথায় সারাক্ষণ ঘোরে, কতদিন কত কিছু ভাবছে সে তাকে নিয়ে... ছবি খুবই কম দেয় ফেসবুকে ঐন্দ্রিলা , যে কয়টা দিয়েছে সেগুলোতে দেখেছে অতনু খুব খুল্লামখুল্লা টাইপের না, চটকদার ও না, কিন্তু খুবই স্নিগ্ধ একটা চেহারা, গভীর কালো চোখ, পরিমিত হাসি কিন্তু বেশ শান্তি শান্তি ভাবের একটা মুখশ্রী...দেখলেই মনে হয় কত চেনা, কত আপন!

এমনও হয় নাকি? কিন্তু কিন্তু আশ্চর্য বিষয় হচ্ছে এমনটাই হচ্ছে। প্রথমে ভেবেছিল প্রেমে পড়েছে এখন মনে হচ্ছে বিষয়টা আরও জটিল, মেয়েটাকে কি সে ভালোবেসে ফেলেছে? নাকি মায়ায় আটকে গেছে! মায়া আবার আসে কোত্থেকে কথাই তো হয়নি কোনদিন!অদ্ভুত একটা বিষয়...কিন্তু ভয়ে কিছু বলতে পারছে না। না করে দিলে মরেই যাবে সে... ধুর, মরে যাওয়া কি এত সোজা নাকি? এমন সব সাতপাঁচ ভাবতে ভাবতে মাসখানেক আগে অতনু একটা গানের লিঙ্ক পাঠিয়েছিল মেসেঞ্জারে, ঐন্দ্রিলা ১৪ ঘণ্টা পর সিন করেছিল কিন্তু কোনো রিপ্লাই দেয় নাই, অতনু আবার দুটো গানের লিংক পাঠালো। ঐন্দ্রিলা প্রায় ১০ ঘণ্টা পর সীন করেছিল এবং লাইক বাটনে প্রেস করে বরাবরের মতই চুপ হয়ে গেলো।

আচ্ছা এখন কি করবে সে? ঐন্দ্রিলা তো টেক্সট করেছে, " কেমন আছেন ?" কি উত্তর দিবে!!! অতনুর পাঠানো
গানের লিঙ্কটাতে রিঅ্যাক্ট করেছে নীল হৃদয় দিয়ে! নীল কেন ? নীল তো বেদনার রং

অনেক ভেবেচিন্তে অতনু রিপ্লাই দিল, ‘এইতো...আছি আমি, তুমি কেমন?’

ঘণ্টা দুয়েক পর ঐন্দ্রিলা টেক্সট দেখে মুচকি হেসে রিপ্লাই দিলো, আমি ভালো আছি, সাবস্ক্রাইব করতে হবে? youtube এ এটা আপনার চ্যানেল?

অতনু কপাল কুচকে ফেলল, মেয়েটা কী কিছু বুঝতে পারেনি? এতটা বোকা তো মনে হয় না, নাকি এড়িয়ে গেলো!
রিপ্লাই দিলো ‘আরে না, তোমাকে গান শোনার জন্য দিয়েছিলাম’

ঐন্দ্রিলা রিপ্লাই দিলো, ‘আমাকে কেন?’

এমনিতেই, ‘আমি অনেকেই গান পাঠাই শোনার জন্য’

‘ওহ, আমি তাহলে ওই অনেকের লিস্টে ঢুকে গেছি?’

‘নাহ, তা হবে কেন? তুমিও গান করো ভাবলাম গানটা তোমার ভালো লাগবে...’

‘গান তো একটা না, পরপর কয়েকটা পাঠিয়েছেন’

‘ঐ একটা চিন্তা থেকেই পাঠানো’

‘আমি ছাড়া এই গানগুলো আর কতজনকে পাঠিয়েছেন?’

‘বেশ কয়জন’

‘তারা সবাই গান করে?’

‘মোটামুটি গান করে বা শুনতে পছন্দ করে’

ওহ, তা আপনি ভালো নেই কেন? কী হয়েছে?

‘কে বললো ভালো নাই?’

‘আপনি তো বললেন, জিজ্ঞাসা করেছিলাম, কেমন আছেন? বললেন ‘এইতো আছি’ ভালো তো বলেননি’

‘ওহ এমনিতেই বলছি...’

‘নাহ, এমনিতেই বলেননি, আপনি আসলেই ভালো নাই, কতদিন থেকে এমন?’

‘কেমন? কি বলো এসব...’

‘আচ্ছা থাক, কিছু না, তবে আজকের গানটা তো শুধু আমাকে পাঠিয়েছেন অন্য কাউকে না এবং কয়দিন আগের পাঠানো গানটাও, এর আগেরগুলো অবশ্য জানি না।

‘খালি তোমাকে পাঠিয়েছি কে বললো, আরো কয়েকজনকে পাঠিয়েছি তো...’

‘শুধু শুধু মিথ্যা বলার দরকার নাই, আমি মিথ্যা বুঝতে পারি’

অতনু ঢোক গিললো, এখন কী রিপ্লাই দেবে ভাবছে...

‘আর কী বুঝতে পারো?’

‘সেটা আপনাকে বলবো কেন? আচ্ছা যাই এখন, একটু কাজ আছে, ভালো থাকবেন, বাই’

ঐন্দ্রিলা চলে গেলো, অতনুর মনে হলো সে একটা হার্টবিট মিস করলো, অনেকক্ষণ ধরে বাই লেখাটার দিকে তাকিয়ে থাকলো। ইস মেয়েটা নিষ্ঠুর! এভাবে হুট করে কেউ চলে যায়... অতনু ঐন্দ্রিলার শেষ রিপ্লাইতে লাল হৃদয়ের রিএক্ট দিয়ে মন মরা হয়ে বসে থাকলো।

এভাবে আরো কয়েকদিন কেটে গেলো হবে হয়তো পাঁচ দিন সাত দিন এমন কিছু, অতনু আর গানের লিংক পাঠাতে পারে না, সারাক্ষণ মনে হয় ধরা পরে যাবে... কিন্তু এখন অস্থিরতা আরো বেড়েছে, কী করবে সে, ফোন নম্বর চাইবে? সেটা কি ভালো দেখায়? একদিন বাইরে কোথাও দেখা করতে চাই এটা বললে কেমন হয়? বন্ধুদের কাউকে বলতেও পারছে না, অতনুকে বাইরে থেকে যতই খোলামেলা উচ্ছল মনে হোক মন বিষয়ক ব্যাপার-স্যাপার এ সে একটু চাপা ভেতরে সে একটু চাপা। সহজে কাউকে কিছু বলতে পারে না, কিন্তু বলতে যে তাকে হবেই....

ঠিক তখনই মেসেঞ্জারে মেসেজ আসার শব্দ, অতনু দেখতে নিলো কে পাঠিয়েছে? সে অবাক হয়ে দেখে ঐন্দ্রিলা, কি কাকতালীয় সে এতক্ষণ ঐন্দ্রিলার কথাই ভাবছিল। লিখেছে...

‘কেমন আছেন? মন ভালো?

হ্যাঁ, ভালো আছি তুমি?

আমিও ভালো আছি, গান শোনা ছেড়ে দিয়েছেন?

না, ছেড়ে দেব কেন?

‘তাহলে কী বুঝে ফেলেছেন যে আমি বুঝে গিয়েছি?’

‘কী বুঝে গিয়েছো?’

‘কিছু না, আপনি কী সবার সাথেই এমন বোকা টাইপের আচরণ করেন? নাকি শুধু আমার সাথে?’

‘আশ্চর্য তো, তুমি এসব কি বলছ?’

‘আমি বলছি সূর্য আজকে পূর্ব দিকে উঠেছে পশ্চিমে ডুববে’

‘হ্যাঁ সেটা তো রোজই হয়, চিরন্তন সত্য।’

‘জ্বী, এইতো ধরতে পেরেছেন, আমি চিরন্তন সত্য বলেছি’

‘কেমন?’

‘কাউকে বিব্রত করতে চাই না, আচ্ছা তাহলে যাই, বাই’

অতনুর মনে হলো নিজের চুল নিজে ছিড়ে ফেলে, ঐন্দ্রিলা তো আবারো চলে গেলো! এখন উপায়? কেন সে কিছু বলতে পারেনা! সাত দিন ধরে সে কি ভয়ংকর অপেক্ষা!! কত কিছু প্ল্যান করছে মনে মনে যে বলবে... ধ্যাততারিকা ছাই!

ঐন্দ্রিলা ভাবছে ছেলেটা এমন কেন? একটু তার ছেড়া...

আরো কয়দিন গেলো এভাবেই, ফেসবুকে কবিতা আপলোড বাড়লো...মেয়েদের কমেন্ট এর বন্যা বয়ে গেলো, কে সে?

ঐন্দ্রিলা চুপচাপ, অতনু ইতস্তত স্তব্ধ।

দিন দশেক শেষ, এগারো দিনের মাথায় আবার একটা গান পাঠালো ঐন্দ্রিলাকে, এর বেশি সে আর কিছু পারছে না, কথা শুরু করতেও ভয়।

ঐন্দ্রিলা নীল হৃদয় দিয়ে রিএক্ট করলো কিছু বলল না

অতনু সাহস করে লিখলো, ভালো আছো?

‘হ্যাঁ, কিছু বলবেন?’

‘না, আমাকে তুমি তুমি বলতে পারো’

‘কেন?’

‘এমনিতেই’

‘ও আচ্ছা এমনি এমনি! আমরা কি একদিন বাইরে কোথাও দেখা করতে পারি?’

‘কেন?’

‘এমনিতেই আপনাকে কখনো দেখিনি...’

‘আমিও তোমাকে দেখিনি’

‘কিন্তু প্রায়ই তো আমার অ্যালবাম ঘেটে পুরনো ছবিগুলো দেখেন...’

‘জানলে কী করে?’

‘দেখা হলেই বলি’

‘আচ্ছা, বিকেল পাঁচটায় গ্লোরিয়াতে’

‘উহু, সাড়ে পাঁচটায় প্লিজ’

‘আচ্ছা ঠিক আছে।’

‘বৃহস্পতিবার বিকেল টা ৩০ মিনিটে গ্লোরিয়া জিন্স’

অতনু গ্লোরিয়া জিন্সের সামনে দাঁড়িয়ে আছে, হালকা নীল রঙের ফুল শার্ট পরা, ধূসর কালো প্যান্ট, জুতো। শার্টের হাতা কনুই এর নিচ পর্যন্ত গুটানো, হাতে মোবাইল, কিছুটা ঘামছে সে...

ঐন্দ্রিলা গাড়ো নীল রঙের একটা শাড়ি পরে এসেছে, গলায় ছোট মুক্তার মালা, হাতে মুক্তার আংটি, মুক্তার ব্রেসলেট, মুক্তা রঙের ব্যাগ ও স্যান্ডেল। অতনুকে দেখে মুক্তার দাঁত দিয়ে হাসলো...

অতনু হাসার চেষ্টা করলো এরপর দরজা দেখিয়ে ভেতরে ঢুকলো, এত স্নিগ্ধ দেখতে একটা মেয়ে, চোখ এত গভীর, তাকাতেও লজ্জা লাগে, মনে হয় সব বুঝে ফেলবে! ওরা দুজনের মুখোমুখি একটা টেবিলে বসলো, বসতেই ওয়েটার মেনু বুক দিয়ে গেলো...

কী খাবেন?

‘একটা কিছু হলেই হয়... তুমি কী নিবা?’

‘কোল্ড কফি, mocha’

‘আচ্ছা তাহলে আমিও তাই নেই’

‘আপনাকে একটু নার্ভাস দেখাচ্ছে, অবশ্য প্রেমে পড়লে এমন হয় শুনেছি’

‘কে প্রেমে পরছে?’

‘আমি না এখনো,’

‘তাহলে?’

ঐন্দ্রিলা শান্ত চোখে অতনুর দিকে তাকিয়ে বললো, তুমি।

অতনু ভাবছে..., কি শান্ত কিন্তু সাংঘাতিক মেয়ে, মুখে বললো এতই যদি বোঝো তাহলে এত সময় নিলে কেন?

কোথায় আমি সময় নিলাম? আজকে দেখাতো আমিই করতে চেয়েছি, তোমার কষ্ট দেখতে আর ভালো লাগছিল না, অনেক দিন ধরেই তো দেখছি!

ওয়েটার আসলো অর্ডার নিতে...

অর্ডার বুঝিয়ে দিলো ঐন্দ্রিলা, তার জন্য লাটে আর অতনুর জন্য ক্যাপেচিনো, এরপর অতনুর দিকে তাকিয়ে দেখে অতনু তাকিয়ে আছে তার দিকে আছে,

জিজ্ঞাসা করলো, তুমি কি অন্তর্যামী?

মিষ্টি হেসে ঐন্দ্রিলা উত্তর দিলো: না, এলিয়েন।

অতনু তার সর্ব সাহস দিয়ে ফ্যাসফ্যাসে গলায় বললো, তোমার হাতটা একটু ধরি?

‘ধরো’

আর যদি না ছাড়ি?

আচ্ছা, শক্ত করে ধরে রেখো।

‘এবার একুশে বইমেলায় প্রকাশিত ভালোবাসার গল্প সংকলন ‘ণ-ত্ব বিধান ষ-ত্ব মায়া’ বইটিতে এই গল্পটি স্থান পেয়েছে। পাওয়া যাচ্ছে কণ্ঠস্বর প্রকাশনীর ৫৫৪ নম্বর স্টলে এবং রকমারি ডট কমে।’

এমআরএম/এএসএম

প্রবাস জীবনের অভিজ্ঞতা, ভ্রমণ, গল্প-আড্ডা, আনন্দ-বেদনা, অনুভূতি, স্বদেশের স্মৃতিচারণ, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক লেখা পাঠাতে পারেন। ছবিসহ লেখা পাঠানোর ঠিকানা - [email protected]