সালতামামি ২০২৩
জীবন থেকে হারিয়ে গেছে ‘আট আনার জলি আচার’
ফাঁটা ভাঙা শিশি বোতলের বিনিময়ে হাওয়াই মিঠাই দেনেওয়ালা অনেক আগেই হারিয়ে গেছে গ্রামের সর্পিল মেঠো পথ ধরে, বিদায় নিয়েছে শহুরে অলিগলিতে ঘণ্টি বাজিয়ে ঘুরে ফেরা আইসক্রিমওয়ালা যার কাছে সিকি আধুলির বিনিময়ে পাওয়া যেত রঙ বেরঙের মিষ্টি বরফ।
জীবন থেকে মিলিয়ে গেছে পড়ন্ত দুপুরে মিহি সুরে ডেকে যাওয়া লেইস ফিতা বলে ডাক ছেড়ে ধীর লয়ে হেঁটে যাওয়া লেইসফিতাওয়ালা সেই কবেই আট আনার জলি আচারের সঙ্গে। বিলীন হয়েছে পুরনো ছিট কাপড়ে বানানো নতুন পুতুলগুলো... হারিকেন, হ্যাজাকবাতির সাথে।লুণ্ঠন হয়ে গেছে নানাবাড়ি, দাদাবাড়ি, সাদা কালো টেলিভিশন আর চিন্তাভাবনাহীন শৈশব।
মাঝে মাঝেই ওসব কেবলই উঁকিঝুঁকি দেয় মস্তিষ্কের আর্কাইভ থেকে স্মৃতি নামক আনন্দ বেদনার ককটেল হয়ে। সেখানে চলতি একটা বছর চলে যাওয়া কি আসলেই ভীষণ কিছু?
জগতে কিছু ঘটনা বা স্মৃতি ইতিহাস হয়ে যায় কিন্তু সেগুলো ইতিহাস হতেও সময় নেয়, সময়ের উত্তাল স্রোতে আমাদের মস্তিস্ক তার মর্জিমত কিছু অনাবশ্যক ঘটনা মুছে ফেলবে, কিছু আজীবন সংরক্ষণ করে রাখবে আর কিছু ঝাপসা করে যখন তখন বিদিক ফাপড় দিয়ে যাবে। তো ‘মাথা মশাই’ মনের যোগসাজসে যেটাই করুক সেটা বুঝে উঠতে বেশ ক’বছর সময় দিতে হবে, কেবল তখনই বোঝা যাবে ২০২৩ আসলে কেমন ছিল?! এখন তো বলবার সময় আসেনি...
তবুও রিক্যাপ, সালতামামি বা আঁতলামি, বাঁদরামি, পাগলামি যেটাই বলি না কেন অণুবীক্ষণ যন্ত্র ছাড়া বিশ্লেষণ করলে ২০২৩ সাল ভালোই গেছে, আলহামদুলিল্লাহ। অণু-পরমাণুর হিসেবে না যাই, ওটা সবারই আলাদা।
দুনিয়ার আর সবার মতোই আনন্দ, বেদনা, প্রাপ্তি, অপ্রাপ্তি, অপেক্ষা, কষ্ট, হতাশা, খুশি সব মিলিয়েই একটা আপাত দ্রুত গতিতে কেটে যাওয়া বছর ২০২৩ যেখানে আজ পর্যন্ত সূর্য পূর্বে উঠেছে এবং পশ্চিমে ডুবেছে। ভরা পূর্ণিমা আর অমাবস্যা সাথে করে চব্বিশ ঘণ্টায় একদিন আর ৩৬৫ দিনেই বছরের হিসেব এগিয়েছে...। কারো জীবনে উপরওয়ালার হেদায়েত প্রাপ্তি হয়েছে কারো হয়নি তবে হবে আর কারোর হয়তো হবে না এসব নিয়েই দিন রাত গড়িয়ে শেষপ্রান্তে।
সদ্যজাত শিশু কান্না, খাওয়া, ন্যাপি ভেজানো ছাড়া বাকি সময় ঘুমিয়েছে, টিনএজরা টিন টিন, টিকটক আর ইউটিউব ঘেটে গেছে, যুবক যুবতীরা প্রেম ভালোবাসা কী? তা বোঝার আগেই গুটি কয়েক ব্রেকআপ ঝুলিতে ভরে ক্যারিয়ার কে প্রাধান্য দিয়ে সামনে এগিয়েছে, মধ্যবয়স্করা ঠিক মধ্যবিত্তের মতো মনের যাবতীয় টানাপোড়েন ঢাকতে বিবিধ উপায়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের ব্যবহার করেছেন।স্থিরতা এসেছে কেবল বয়োজ্যেষ্ঠদের জীবনে, নিরবিচ্ছিন্ন অবসর...
পুরো বছর কমবেশি টানা বর্ষণসহ ভারী বৃষ্টি, ভূমিকম্প, জলোচ্ছ্বাস, আবেগ, বিবেকের আনাগোনা দেখা গেছে ফাটা কলসিদের সাথে সাথে। খুবই স্বাভাবিক গতিতে বয়স ও পাকা চুল বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে যুদ্ধবিগ্রহ, হিন্মন্যতা, হিংসা, সিদ্ধান্তহীনতা, দ্রব্যমূল্য, অসুস্থতা ও মায়া বৃদ্ধি পেয়েছে। কিন্তু কমেছে নিখাদ ভালোবাসা, আস্থা, নির্ভরতা, বিশ্বাস, স্বস্তি, মানবতা, গাছপালা, আর আয়ু।
এর চেয়ে বেশি কিছু বলবার সময় এখনো আসেনি, হয়তো একদিন আসবে, আয়ু থাকলে হয়তো তখন লেখা হবে, ততক্ষণ ক্ষান্ত দেই এবং আশা করি আজ ৩১শে ডিসেম্বর ২০২৩, পূর্বে উদিত হওয়া সূর্য পশ্চিমেই ডুববে, অন্যথা হবে না।
ওহ, আমাক জিজ্ঞাসা করলে এই বছরে পরিবর্তন অবশ্য দুটো: আগের বছরগুলোর তুলনায় এই বছর অনেক অনেক বেশি সেলফি তোলা হয়েছে, আর কারোর প্রতি আমার কোনো অভিযোগ নেই।
নতুন বছর সবার জীবন সুস্থ, স্বাভাবিক, সাবলীল, সুন্দর, হাস্যোজ্জ্বল, অর্থবহ হোক, মুছে যাক দুঃখ, কষ্ট, ব্যথা এটাই প্রতাশা।
এমআরএম/জেআইএম