অংশু আকাশ থেকে পড়লো!

প্রবাস ডেস্ক
প্রবাস ডেস্ক প্রবাস ডেস্ক
প্রকাশিত: ১০:৪৯ এএম, ২৫ নভেম্বর ২০২৩

অমিয় দাশ, যুক্তরাষ্ট্র

হ্যাঁ, প্রতিটি মানুষের মূল্য আলাদা আলাদা। তোমাকে একটি উদাহরণ দেই। ধরো, তুমি তোমাদের বাড়িতে একটি ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যানকে দাওয়াত দিলে। দ্বিতীয়তঃ, উপজেলা চেয়ারম্যানকে দাওয়াত দিলে। তৃতীয়তঃ, তুমি একজন সংসদ সদস্যকে দাওয়াত দিলে। চতুর্থতঃ, তুমি একজন মন্ত্রীকে দাওয়াত দিলে। পঞ্চমত, তুমি প্রধানমন্ত্রীকে দাওয়াত দিলে। এই দাওয়াতগুলোর প্রতিটি ক্ষেত্রে তুমি কিন্ত একই রকম আয়োজন করবে না’।

বাধঁন টু শব্দ ও করছে না, যেন গোগ্রাসে অংশুর কথা খাচ্ছে। অংশু আবার শুরু করলো, ‘তুমি ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান এর জন্য যে আপ্যায়ন করবে, উপজেলা চেয়ারম্যানের এর জন্য তার চেয়ে ভালো আয়োজন করবে, আবার উপজেলা চেয়ারম্যান চেয়ে প্রধানমন্ত্রীর জন্য অনেক বেশি আয়োজন করবে।

কারণ, তুমি জানো যে ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যানকে ঘরে দাওয়াত করে এনে যে পরিমাণ মূল্য পাবে বা অনুভূত উপযোগিতা পাবে সে সাময়িক হবে। তার তুলনায় উপজেলা চেয়ারম্যানের কাছ থেকে বেশি অনুভূত মূল্য পাবে। সাংসদ হলে আরও বেশি, মন্ত্রী হলে তার চেয়ে বেশি, প্রধানমন্ত্রী আরো অনেক বেশি অনুভূত উপযোগিতা পাবে’।

‘আমি জানি আমি কোনো চেয়ারম্যান বা এমপি নই। কিন্তু তাই বলে আমার মূল্য ৫ টাকা কীভাবে হলো? আজকাল ৫ টাকায় একটা দিয়াশলাইও পাওয়া যায় না’।

মনে হলো বাধঁন বেশ রাগত স্বরেই প্রতিবাদ করলো। অংশু জিজ্ঞেস করলো, ‘৫ টাকার কথা আসছে কেন?’
‘আমাকে একজন বলেছে যে আমার মূল্য নাকি ৫ টাকা’।

‘হ্যাঁ ,সেটা জানি যে তুমি চেয়ারম্যান বা এমপি নও। তবে তোমাকে কি ধরনের মানুষের সঙ্গে তুলনা করবো, তুলনা করা আদৌ ঠিক হবে কি না তাই ভাবছি’।

‘আপনি যা খুশি তার সাথে তুলনা করতে পারেন, আমি সেটাই জানতে চাচ্ছি আমি কি ধরনের মেয়ের সাথে তুলনীয়’।
‘হাত নাড়িয়ে অংশু বাধঁনকে থামানোর ভঙ্গিতে বলল, আমি আসলে তোমাকে কিছুর সাথে তুলনা করতে চাইনি’। না ঠিক আছে’।

বলে মাথা নাড়িয়ে বাধঁন সায় দিলো।
এবার একটু রসিকতার ভঙ্গিতে হাসি হাসি মুখে অংশু বাধঁন কে বলল, ‘তুমি কি জানো বিভিন্ন দেয়াশলাইয়ের দাম বিভিন্ন রকম হয়?’
‘তাই?’
বাধঁন বিস্ময় প্রকাশ করে।
‘হ্যাঁ তাই। জানো কোন কোন দেয়াশলাই দিগুণ দামেও বিক্রি হয়’। ‘কীভাবে?’

‘এই যেমন এক রকম দিয়াশলাই কাগজের, কার্ডবোর্ড দিয়ে বানানো। কাগজের ওই খাপের মধ্যে বাতাস বা জলীয়বাস্প ঢুকে দেয়াশলাইয়ের কাঠি উদায়ে যায়। অনেক বার দিয়াশলাইয়ের গায়ে কাঠি ঘষলেও আগুন জ্বলে না’।
‘আপনি সিগারেট খান?’

‘হঠাৎ এ রকম অপ্রাসঙ্গিক প্রশ্ন করছো কেন?’
‘দেয়াশলাই জ্বালাতে আপনার অভিজ্ঞতার বিবরণ শুনে না জিজ্ঞেস করে পারলাম না বলেই হা হা কোরে হেসে উঠলো বাঁধন।
‘হ্যাঁ, মাঝে মধ্যে মন উদাস হলে তখন খাই’
‘মন উদাস কমে সিগারেট খেলে?’

‘না। তবে সিগারেট খাওয়া খারাপ এটা মনে হলে মন আরও উদাস হয়ে যায়। মাঝে মাঝে মনে হয় আমি আর সিগারেট খাবো না, মায়ের বাধ্য ছেলের মতো হয়ে যাবো। সবাই আমাকে পছন্দ করবে। বলবে, অংশুর মতো অমায়িক ছেলে হয় না। এমনকি বিড়ি-সিগারেট পর্যন্ত খায় না’।

‘বাধ্য ছেলেদের সবাই পছন্দ করে, এই কথাটি ঠিক না। মায়ের বাধ্য ছেলে, তার বউ এর কাছে ভালো না’।
বাধঁন প্রতিবাদ করলো।

‘হুম, বুঝলাম না’। বলেই অংশু অন্য মনস্ক হলো ক্ষণিকের জন্য।
বাঁধন প্রসঙ্গ পরিবর্তন করে বলল, ‘বলুন দিয়াশলাইয়ের বিষয়টা’।
সম্বিত ফিরে পেলো অংশু বাধঁনের আবদার মেশানো প্রশ্নে, ‘বলুন দিয়াশলাইয়ের বিষয়টা। দিয়াশলাইয়ের বিষয়টা বলতে বলতে থামলেন কেন?

‘ও হ্যাঁ, মনে করো যদি কাগজের বাক্সওয়ালা দিয়াশলাই, যার গায়ে দিয়াশলাইয়ের বারুদ লাগানো কাঠি দিয়ে ঘষলেও আগুন জ্বললো না। আবার প্রায় কাগজের মতো পাতলা করে কাটা শিমুল গাছের কাঠ দিয়ে বানানো দিয়াশলাই যা জলীয় বাষ্প রোধ করে, এ রকম কাঠের দিয়াশলাইয়ের মধ্যে রাখা বারুদ মাখানো কাঠের কাঠি দিয়ে বাক্সের গায়ে ঘষা দিলেই স্বতঃস্ফূর্ত ভাবে কাঠিতে আগুন জ্বলে উঠলো। এক্ষেত্রে কাঠের বাক্সওয়ালা দিয়াশলাইয়ের মূল্য কাগজের খাপের দিয়াশলাইয়ের তুলনায় বেশি হবে’।

দ্বিতীয় পর্ব পড়ুন এখানে

‘এই তুলনা করাটাই আমাকে প্রতিনিয়ত কুরে কুরে খায়’।
অংশু ভয়ে ভয়ে বাঁধনের দিকে তাকালো। ভাবলো, এই বোধহয় একটা ঝামেলা বেধে গেল। চুপ হয়ে গেলো কয়েক মুহূর্ত।
বাঁধন বললো, ‘আমি কখনো সজীবকে কারো সাথে তুলনা করিনি’। সজীব ওর বিয়ের পর থেকেই আমাকে সবসময় তুলনা করে। কিন্তু আমার কাছে ওতো অমূল্য। ওকে যে আমি অনেক লভ করি’।

আজকাল ছেলেমেয়েরা প্রকৃত ভালোবাসাকে ‘লভ’ বলে। লভ শব্দটা টেনে একটু লম্বা করে বলে, ইংরেজী শব্দ লাভ আরকি। যার মানে ‘ভালোবাসা’ সেটার গভীরতম একটা অবস্থা। এসব বিষয়গুলো অংশু খুব মনোযোগ দিয়ে শোনে, কারণ বাহ্যিকভাবে ভালোবাসা, প্রেম, লভ, লাভ, ইত্যাদির মানে একই হলেও ইদানিং প্রকৃতভাবে প্রতিটি শব্দ উচ্চারণ ভঙ্গির ওপর নির্ভর করে শব্দটির মানে ও গভীরতা। অংশুভাবে শেক্সপিয়ার বা রবীন্দ্রনাথের সময়কালে এই শব্দার্থের পার্থক্য হলে নিশ্চয়ই তারা কবিতার ছন্দে শব্দগুলোর মর্মার্থ বুঝিয়ে দিতেন।

‘বিয়ের পর থেকে, মানে কি?’ অংশু যেন আকাশ থেকে পড়লো। বাধঁন চোখ নিচু করে টেবিলের দিকে তাকিয়ে আছে। মাথাটা নিচু করে হাতের পরা স্বর্ণের ব্রেসলেটটি নিয়ে আনমনে নাড়াচাড়া করছে।
অংশু আবার কৌতূহলী স্বরে জিজ্ঞেস করলো, তোমরা কি বিয়ে করেছ?’
‘আরে না, ও আরেকটা মেয়েকে বিয়ে করেছিল’।

অংশু কি বলবে ঠিক বুঝতে পারলো না। বাধঁনের সাথে প্রায় বছর খানেক মাঝে মধ্যেই দেখা হয়েছে, কথা হয়েছে, আড্ডা মেরেছে, কিন্তু এরকম একটা বিষয় কখনো সে আকার- ইঙ্গিতেও বলেনি। অবশ্য কারো মুখ দেখে তার ভেতরে কি হচ্ছে বোঝা কষ্টসাধ্য ব্যাপার। অপারগ হয়ে অংশু বলল, ‘বাধঁন, তুমি একটু ঝেড়ে না কাশলে আমি কিছুই বুঝতে পারছি না’ বলেই চুপ হয়ে গেলো। কেউ একটা কথাও বলছে না। বাধঁন মাথা ঝুকিয়ে হাতের ওপর থুতনি ঠেশ দিয়ে টেবিলের দিকে তাকিয়ে বসে আছে।

অংশু বসে আছে চেয়ারে হেলান দিয়ে, বাধঁনের দিকে তাকিয়ে একটু বিরক্তি অংশুকে স্পর্শ করছে বলে মনে হচ্ছে। এই বিরক্তি যে কিসে তা অংশু নিজেও বুঝতে পারলো না। বিরক্তিটা এতক্ষণ বকবক করার জন্য নাকি, বাধঁন এর বিষয়টা এতদিন বুঝতে না পারার জন্য?

বাধঁন মাথা তুললো। বলতে শুরু করলো, ‘আমার সাথে সজীবের পরিচয় সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম, ফেসবুকের মাধ্যমে। আমি যে বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়েছি, ওখানকার ছাত্র ছাত্রীদের যারা শিল্প ও সংস্কৃতিপ্রেমী তাদের একটি গ্রুপ আছে। মাঝে মধ্যেই আমাদের চ্যাটিং রুমে কথোপকথন হত, আলোচনা হতো। সেই গ্রুপে সজীবও একজন সদস্য ছিলো। আলাদাভাবে আমি সজীবকে কোনো কথা লেখার বা বলার প্রয়োজন অনুভব করিনি। যেহেতু সবাই সংস্কৃতিমনা তাই বিভিন্ন কবিতার বই, উপন্যাস, রবীন্দ্রনাথ, নজরুল, হলিউড, বলিউড, বাংলা সিনেমা, এসব নিয়ে কথোপকথন হতো।

‘সজীব কি তোমার একই বয়সী?’
বলেই অংশু চুপ করে বাধঁনের মুখের দিকে তাকিয়ে থাকল।

চলবে...

লেখক: অমিয় দাশ, ফার্মাসিস্ট, ওষুধ প্রস্তুতকারক। বোকা রেতন, যুক্তরাষ্ট্র
[email protected]

এমআরএম/জেআইএম

প্রবাস জীবনের অভিজ্ঞতা, ভ্রমণ, গল্প-আড্ডা, আনন্দ-বেদনা, অনুভূতি, স্বদেশের স্মৃতিচারণ, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক লেখা পাঠাতে পারেন। ছবিসহ লেখা পাঠানোর ঠিকানা - [email protected]