কানাডায় বাংলাদেশি অভিবাসীদের ভয়াবহ চিত্র!
সাইফুল্লাহ মাহমুদ দুলাল, কানাডা থেকে
একদিকে কানাডার অর্থনৈতিক অবস্থা চরম অবনতি ঘটছে, অন্যদিকে দেশটিতে বিদেশি নাগরিক এসে হিমশিম খাচ্ছে। প্রতিদিনই বাড়ছে অভিবাসীর সংখ্যা। এদের মধ্যে শীর্ষ ১৫ দেশের তালিকায় রয়েছে বাংলাদেশ। চলতি বছর শরণার্থী আবেদন করেছেন প্রায় দেড় হাজার জন।
কানাডার ইমিগ্রেশন অ্যান্ড রিফিউজি বোর্ডের তথ্য মোতাবেক, চলতি বছর শরণার্থী সুরক্ষা চেয়ে বাংলাদেশ থেকে এসে কানাডায় আবেদন করেছেন ১ হাজার ৪২৩ জন। ২০১৬ সালে শরণার্থী হিসেবে বাংলাদেশিদের আবেদনের সংখ্যা ছিল ৪৫৩টি। ২০১৭ সালে এ সংখ্যা বেড়ে দাঁড়ায় ৭০৫টি। অন্যদিকে গত বছর এ সংখ্যা দাঁড়ায় ১ হাজার ২৯৪টিতে।
জানা গেছে, ২০১২ সালের ১৫ ডিসেম্বরের পর থেকে নতুন পদ্ধতিতে রিফিউজি প্রটেকশন ক্লেইমের (আরপিডি) তথ্য হালনাগাদ করছে কানাডা। তাতে ২০১৩ থেকে চলতি বছরের জুন পর্যন্ত মোট ৪ হাজার ৬৪২ জন বাংলাদেশি এ শরণার্থী হিসেবে আবেদন করেছে। এর মধ্যে ১ হাজার ৩০৬ জনের আবেদনের নিষ্পত্তি হয়েছে। তাদের মধ্যে শরণার্থী হিসেবে আবেদন গৃহীত হয়েছে ৯২৪ জনের। বাতিল হয়েছে ৪৬০ জনের। অপর্যাপ্ত তথ্য দিয়ে আবেদন হয়েছে ১৯টি। এছাড়া স্বেচ্ছায় প্রত্যাহার ও অন্যান্যের আওতায় রয়েছে ১০১টি আবেদন।
আরও পড়ুন: স্কুলিং ভিসায় শিশুর সঙ্গে যেতে পারবেন বাবা-মাও
সম্প্রতি কানাডার উদার ভিসানীতির প্রেক্ষিতে দেশে এবং বিদেশের ভুয়া ইমিগ্রেশন চক্র, রিক্রুট এজেন্সি এবং প্রতারক আদম ব্যবসায়ীদের খপ্পরে পা দিয়ে দশ থেকে বিশ লাখ টাকা খরচ করে দশ বছরে মাল্টিপোল ভিসা নিয়ে প্রচুর ভিজিটর অ্যাসাইলাম নিয়েছেন এবং নিচ্ছেন। বেশিরভাগই বিরোধীদলের নেতাকর্মী হিসেবে এবং কেউ কেউ ভুয়া সমকামি দাবি করেও রিফুজি ক্লেইম করেছে বলে জানা গেছে। টরন্টোস্থ ড্যানফোর্থের বাংলা টাউনে গেলে নবাগতদের নানান কাহিনি শোনা যায় এবং চিত্র চোখে পড়ে।
টরন্টো শহরের ফুটপাতে এবং বাসস্ট্যান্ডে উদ্বাস্তদের আশ্রয়স্থল
আরও পড়ুন: স্টুডেন্ট ভিসায় কানাডা যেতে চান, জেনে নিন ১৬ উপায়
এর মধ্যে পিয়ারসন এয়ারপোর্ট থেকে তিন বাংলাদেশি পরিবারকে কানাডায় ঢুকতে না দিয়ে ফেরত পাঠিয়ে দিয়েছে। কারণ, এদের অফার লেটার ছিল জাল অথবা কেউ কেউ ইমিগ্রেশনে সঠিক জবাব দিতেও পারেননি, ইংরেজিতে অদক্ষতার কারণে।
যারা ভিজিট ভিসায় এসে শরণার্থী হিসেবে আবেদন করেছেন, তাদের অবস্থা খুবই শোচনীয়। কানাডায় গেলেই চাকরি, বাসস্থান, বেকার ভাতা, পি আর কার্ডের স্বপ্ন নিয়ে যারা এসেছেন, তারা এখন থাকা-খাওয়া-বাসস্থান-চিকিৎসা-চাকরির চরম সংকটে পড়ে ফুড ব্যাংক থেকে খয়রাতি খাবার নিচ্ছেন। সরকারের দেওয়া মাত্র কয়েক মাসের জন্য প্রদত্ত মাত্র সাতশ’ ডলারে বেকার ভাতায় বাসা ভাড়াও হচ্ছে না। এই দুঃসহ এবং উদ্বাস্তু জীবন যাপন করে সর্বস্ব খুইয়ে কেউ কেউ এরই মধ্যে দেশে ফিরে যেতে বাধ্য হয়েছেন।
আরও পড়ুন: কানাডায় প্রবাসীদের দুর্ভোগ-হয়রানি বন্ধে সরকারের হস্তক্ষেপ কামনা
চলতি বছর কানাডায় শরণার্থী হিসেবে সবচেয়ে বেশি আবেদন এসেছে আফ্রিকার নাইজেরিয়া থেকে, ১৪ হাজার ১৬০টি। এছাড়া দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্য থেকে ভারত থেকে ৮ হাজার ১৭৯ জন, পাকিস্তান থেকে ৩ হাজার ৮২২, শ্রীলঙ্কা থেকে ১ হাজার ১৫৩, আফগানিস্তান থেকে ৭৭৫, নেপাল থেকে ২৯৯ ও ভুটান থেকে দু’জন আবেদন করেছেন। বর্তমানে কানাডায় বাংলাদেশ থেকে শিক্ষার্থী হিসেবে গমনের সংখ্যাও অনেক বেড়েছে।
এছাড়াও বিগত ক’বছরে শিরিয়া, আফগানিস্তান, ইউক্রেইন থেকে সরকার হাজার হাজার শরণার্থী আমন্ত্রণ জানিয়ে নিয়ে এসেছে। ফলে বড় বড় শহরগুলোতে বাসস্থানের ব্যবস্থা চরম সংকটে পরিণত হয়েছেন। টরন্টো শহরে সেন্টার এমন কি গির্জায়ও জায়গা হচ্ছে না। টরন্টোতে হোমলেসেরা স্টেশন, ফুটপাত, বাসস্ট্যান্ড দখল করে নিয়েছেন।
অন্যদিকে যুক্তরাষ্ট্র থেকে আসা শরণার্থীদের স্রোত কমাতে— এ বছর দেশটির সঙ্গে একটি চুক্তি করে কানাডা। এ চুক্তির পর যুক্তরাষ্ট্রের সীমান্ত দিয়ে কানাডায় শরণার্থী প্রবেশের সংখ্যা অনেক কমে যায়। উল্লিখিত চুক্তির ফলে কানাডায় শরণার্থীদের স্রোত অনেকটা থামানো গেছে।
আরও পড়ুন: কানাডার ভিসা দেওয়ার কথা বলে টাকা হাতিয়ে নিতেন বিল্লাল
এদিকে, আগামী দুই বছরে ৯ লাখ ৮৫ হাজার বিদেশি নাগরিককে স্থায়ী বাসিন্দার স্বীকৃতি দিতে যাচ্ছে কানাডা। ২০২৪ সালে ৪ লাখ ৮৫ হাজার ও ২০২৫ সালে ৫ লাখ মানুষকে তারা এই স্বীকৃতি দিচ্ছে। সম্প্রতি এক সংবাদ সম্মেলনে এ তথ্য নিশ্চিত করেছেন দেশটির অভিবাসন, শরণার্থী ও নাগরিকত্ব বিষয়ক মন্ত্রী মার্ক মিলার।
ইমিগ্রেশন পরামর্শকেরা মনে করেন, যারা কানাডায় আসতে চান, তারা ভুয়া আদম ব্যবসায়ীদের ফাঁদে পা না দিয়ে সঠিক নিয়ম-নীতি মোতাবেক ইমিগ্রেশন নিয়ে আসা উচিত। কারণ, মাল্টিপোল ভিজিট ভিসা আর অভিবাসী ভিসা এক ক্যাটাগরি নয়। আগামী দুই বছরে ৯ লাখ ৮৫ লোক নেবে; তার মানে এই নয় যে, সব নাগরিক শুধুমাত্র বাংলাদেশ থেকে নেবে! এ বিষয়টিও কানাডায় ইমিগ্র্যান্ট ইচ্ছুকদের জানা একান্ত জরুরি।
এমআরএম/এমএস