চিরঞ্জীব সালমান শাহ

মো. ইয়াকুব আলী
মো. ইয়াকুব আলী মো. ইয়াকুব আলী
প্রকাশিত: ০৮:৪৬ এএম, ০৬ সেপ্টেম্বর ২০২৩

সালমান শাহ! নামটার মধ্যেই তার পরিচয় নিহিত। তাকে আর আলাদাভাবে পরিচয় করিয়ে দিতে হয় না। আমরা যারা গত শতকের সত্তর বা আশির দশকের প্রজন্ম তাদের কাছে তিনি ছিলেন স্টাইল আইকন। তার মতো করে পোশাক পরা, তার মতো করে কথা বলা, তার মতো করে মনের মানুষকে নিজের মনের কথা বলা এমন আরও কত রকমের নেশা ছিল আমাদের। আমরা তখন সবে প্রাথমিকের ধাপ পেরিয়ে মাধ্যমিকে ভর্তি হয়েছি। তখন পর্যন্ত ভারতের হিন্দি বা বাংলা সিনেমার নায়কেরাই আমাদের স্বপ্নের নায়ক ছিল।

এরপর ‘কেয়ামত থেকে কেয়ামত’ চলচ্চিত্রের মাধ্যমে বাংলাদেশে হাজির হয়েছিলেন সালমান শাহ। কেয়ামতের পর যেমন সৃষ্টিকর্তা আবার সবকিছু নতুন করে সৃষ্টি করবেন, লিখবেন নতুন এক ইতিহাস। সালমান শাহও যেন লিখলেন বাংলাদেশের চলচ্চিত্রের নতুন ইতিহাস। আমরা তখন অষ্টম শ্রেণীতে পড়ি। তখন কুষ্টিয়ার বাণী সিনেমায় এসেছিল সেই ছবি। যে মানুষ একবার সেই ছবি দেখেছেন সেই মানুষ বারবার সেই ছবি দেখেছেন এবং নিজেদের মধ্যে আলাপ করেন কে কতবার দেখেছেন।

আমার যতদূর মনে পড়ে এই একটা সিনেমা চলেছিল প্রায় দেড় মাসব্যাপী। আমাদের ছোটদের হলে যাওয়ার কোনো উপায় ছিল না। তাই আমরা বড়দের মুখে গল্প শুনতাম আর মনে মনে সেই নায়কের ছবি আঁকতাম। এর কিছুদিনের মধ্যেই বের হয়ে গেল সালমান শাহ’র বিভিন্ন ধরনের ভিউকার্ড। সেই ভিউকার্ড দেখে আমরা তাকে চিনেছিলাম। সেই নায়কের সবকিছুই কেন জানি আমাদের কাছে একেবারে আনকোরা মনে হত।

সালমান শাহ’কে এরপর দেখেছিলাম ভিসিআরের পর্দায়। তখন বুঝেছিলাম সারাদেশের মানুষ কেন তার অভিনয়ে মজেছে। সালমানের সবকিছুই ছিল অন্যন্য। ভিসিআরের পর্দায় দেখে দেখে তখন সব ছেলেই নিজেকে কমবেশি সালমানে রূপান্তর করতে উঠে পড়ে লেগেছিল। আমার মনে আছে তখন রাস্তাঘাটে প্রায়ই তার মতো করে কপালে রুমাল বাঁধা যুবক বা কিশোরের দেখা মিলতো। অনেকেই তার মতো করে মাথায় হ্যাট বা চোখে সানগ্লাস পরতো।

আমার মনে আছে আমাদের এক সহপাঠিনীকে আমাদের স্কুলেরই এক বড় ভাই সালমানের মতো করে প্রেম নিবেদন করেছিলেন। এমনকি সালমানের কোনো একটা ছবির মতো করে তিনি তার বুকের বাঁপাশে খোদাই করে আমাদের সেই সহপাঠিনীর নামও লিখেছিলেন। আমি একবার তার বুকের ওপর সেই নাম দেখেছিলাম। সেখানে ঘাঁ হয়ে গিয়েছিল।

তখন রাস্তা ঘাটে কিশোর যুবক নির্বিশেষে সবাই তার গানের কলি গাইতেন। অনেক প্রেয়সীর চাহিদা ছিল তার প্রেমিক পুরুষটি হোক সালমানের মতো স্টাইলিস্ট। প্রেমিকেরা তাদের প্রেমিকাদের সালমানের ভিউকার্ড উপহার দিতেন। সে এক উন্মাদনার সময়। পুরো বাংলাদেশ যেন মজেছিল সালমানের জাদুতে। তার প্রত্যেকটা সিনেমা যেন ছিল এক একটা জোয়ারের মতো। সেই জোয়ারে ভেসে যেত পুরো বাংলাদেশের জনতা। সারারাত জেগে ভিসিআরে উনার সিনেমা দেখা আমাদের যেন নেশা হয়ে দাঁড়িয়েছিল। তার সিনেমা চলাকালীন ঘরের মধ্যে পিন পতন নীরবতা বিরাজ করতো। সবাই যেন নিঃশ্বাস নিতেও ভুলে যেত।

সালমান শাহ নামের সূর্যের উদয় হয়েছিল সেই ১৯৯৩ সালে। আর এখন পৃথিবীতে ২০২৩ সাল। এর মধ্যে গড়িয়ে গেছে ত্রিশটি বছর। কিন্তু সালমানের আবেদন যেন একটুও কমেনি। বরং সময়ের সাথে সাথে বেড়েছে। এখনও অনলাইনে এবং অফলাইনে সালমানকে নিয়েই সবচেয়ে বেশি মাতামাতি করে বাংলাদেশের সব বয়সের মানুষ। এখনকার তরুণ প্রজন্ম যারা সালমানের সিনেমা সরাসরি দেখেনি তারাও ফেসবুক, ইউটিউবের কল্যাণে দেখে সালমান শাহ’র সিনেমা আর চমৎকৃত হয়।

এখনও ইউটিউবে তার প্রায় সব সিনেমায় প্রচার তালিকার শীর্ষে আছে। তার স্টাইল এখনও ফিরে ফিরে আসে আমাদের চলচ্চিত্র, আমাদের জীবনে। প্রবাসের এই যান্ত্রিক জীবনেও আমরা দুদণ্ড শান্তির আসায় কানে হেডফোন লাগিয়ে শুনি তার সিনেমার সব কালজয়ী গান। আমাদের পরিবারে এখনও সপ্তাহান্তের প্রায় প্রত্যেকটা সকাল শুরু হয় তার সিনেমার গান বাজিয়ে। এখনও তার ‘সত্যের মৃত্যু নেই’ ছবির ‘চিঠি এল জেলখানাতে অনেকদিনের পর’ যখন বাজে নিজের অজান্তেই চোখ দুটো ঝাপসা হয়ে আসে।

আর মনের পর্দায় ভেসে উঠে তার সেই আবেগী মুখটা। এখনও যখন বেজে উঠে তার ‘স্বপ্নের ঠিকানা’ সিনেমার ‘এইদিন সেইদিন কোনদিন’ গানটা তখন আবার মনটা খুশিতে ভরে উঠে। এ এক অদ্ভুত অনুভূতি। একজন নায়কের অভিনয় মানুষকে ঠিক কতটা মন্ত্রমুগ্ধ করতে পারে এগুলো তার প্রকৃষ্ট উদাহরণ।

এখনও যখন বেজে চলে তার ‘বিক্ষোভ’ সিনেমার ‘বিদ্যালয় মোদের বিদ্যালয় এখানে সভ্যতারই ফুল ফোটানো হয়’ তখন নিজের অজান্তেই হাতের আঙ্গুলগুলো মুষ্টিবদ্ধ হয়ে আসে। আবার যখন বেজে উঠে ‘আশা ভালোবাসা’ সিনেমার ‘অবহেলা যতই করো, যতই রাখো দূরে কণ্ঠ আমার গেয়ে যাবে নিজের আপন সুরে’ তখন অভিনেতা গোলাম মোস্তফার মতো আমাদেরও মুখটা হা হয়ে আসে। আমাদের ঠোঁট কেঁপে উঠে। আবার যখন ‘এই ঘর এই সংসার’ সিনেমার ‘আমাদের ছোট নদী চলে বাঁকে বাঁকে’ বেজে উঠে তখন যেন আমরা আমাদের শৈশবকে ফিরে ফিরে পাই। ‘অন্তরে অন্তরে’ সিনেমার ‘ভালোবাসিয়া গেলাম ফাঁসিয়া’ বেজে উঠলে আমরা আবার নিজের অজান্তেই যেন হেসে উঠি।

‘সুজন সখি’ সিনেমাতে যখন তিনি গেয়ে উঠছেন ‘সব সখিরে পার করিতে নেব আনা আনা, তোমার বেলা নেব সখি তোমার কানের সোনা’ তখন যেন নিজের অজান্তেই আমরাও সখিদের আবিষ্কার করি মনের কল্পনার ঘাটে। ‘প্রিয়জন’ সিনেমায় আবার যখন তিনি গাইছেন ‘এ জীবনে যারে চেয়েছি আজ আমি তারে পেয়েছি’ তখন যেন আমরা আমাদের বাস্তব জীবনের চাওয়া এবং পাওয়ার মানুষটার কথা মনে করি। ‘তোমাকে চাই’ সিনেমায় তিনি যখন গাইছেন ‘তোমাকেই চাই শুধু তোমাকেই চাই, এ জীবনে আর কিছু পাই বা না পাই’ তখন মনে হয় প্রিয়জনকে পেলেই মনে হয় জীবনটা একটা অর্থ খুঁজে পেত। আবার একই সিনেমায় যখন গাইছেন ‘বাজারে যাচাই করে দেখিনি তো দাম’ তখন মনে হয় আসলেই প্রেম অমূল্য।

‘আশা ভালোবাসা’ সিনেমায় যখন গাইছেন ‘প্রেম প্রীতি আর ভালোবাসা, ছোট ছোট কিছু ভীরু আশা’। আহা এ যেন আমাদেরই মনের কথা। তিনি আবার ‘স্বপ্নের ঠিকানা’তে নীল সাগর পার হয়ে প্রিয় মানুষের কাছে আসার কথাও বলছেন। ‘অন্ধ শত্রু’ সিনেমায় আবার বলছেন ‘তুমি আমার এমনই একজন, যারে এক জনমে ভালোবেসে ভরবে না এ মন’ আসলেই তো প্রিয় মানুষকে ভালোবাসার জন্য একটা জন্ম আসলেই অনেক ছোট সময়। আবার যখন ‘মায়ের অধিকার’ সিনেমায় হুমায়ুন ফরিদীর সাথে গাইছেন ‘পিঁপড়া খাবে বড়লোকের ধন’ তখন যেন আমরা ধনী লোকেদের জন্য একধরনের অনুকম্পা অনুভব করি। আমি এখানে তার অভিনীত সিনেমার গানগুলোকে তার গাওয়া বলে উল্লেখ করেছি কারণ আমার মনহয়েছে তিনি ঠোঁট মিলিয়েছিলেন বলেই হয়তোবা গানগুলো অমরত্ব পেয়েছে।

সালমান শাহ তার প্রথম চলচ্চিত্র ‘কেয়ামত থেকে কেয়ামত’র প্রথম গানে গিটার হাতে গিয়েছিলেন ‘বাবা বলে ছেলে নাম করবে’। আসলেই তিনি বাংলা চলচ্চিত্রে নাম করলেন। এমনই নাম করলেন যে সেটা যুগ যুগ ধরে তাকে বাংলা ভাষাভাষী মানুষের মনের মনিকোঠায় জায়গা করে দিলো। তিনি যেন ছিলেন বাংলা চলচ্চিত্রের ধূমকেতু। ধূমকেতু যেমন হঠাৎ আকাশে উদিত হয় তিনিও তেমনি উদিত হয়েছিলেন। আবার ধূমকেতু দেখে আমাদের ঘোর না কাটতেই তিনি যেন বিদায় নিয়েছিলেন। এখনও তাই আমরা তার ‘তোমাকে চাই’ চলচ্চিত্রের সুরে গেয়ে উঠি ‘ভালো আছি ভালো থেকো, আকাশের ঠিকানায় চিঠি লিখো’।

এমআরএম/এমএস

প্রবাস জীবনের অভিজ্ঞতা, ভ্রমণ, গল্প-আড্ডা, আনন্দ-বেদনা, অনুভূতি, স্বদেশের স্মৃতিচারণ, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক লেখা পাঠাতে পারেন। ছবিসহ লেখা পাঠানোর ঠিকানা - [email protected]