কুয়েত

২১ হাজার টাকা বেতনের ভিসা কেন ৭ লাখ টাকা?

জিসান মাহমুদ
জিসান মাহমুদ জিসান মাহমুদ , কুয়েত প্রতিনিধি কুয়েত থেকে
প্রকাশিত: ০৯:৫৩ এএম, ২৭ মে ২০২৩
ফাইল ছবি

মধ্যপ্রাচ্যের অন্যতম ধনী দেশ কুয়েত। জীবন জীবিকার তাগিদে ছুটে যাওয়া, দেশটিতে এখন আড়াই লাখেরও বেশি বাংলাদেশির বসবাস। তাদের বেশিরভাগই আখুদ আকামাধারী ভিসায় (সরকারি প্রজেক্ট) পাড়ি জমিয়েছেন।

প্রবাসে যাওয়ার আগে খুব কম সংখ্যক মানুষ আখুদ ভিসা সম্পর্কে ধারণা রাখেন। অধিকাংশ ক্লিনার কোম্পানিতে কাজ করেন। যাদের বেতন মাত্র ৭৫ দিনার। বাংলাদেশি অর্থে এই টাকার পরিমাণ মাত্র ২১ হাজার।

২০১৮ সালে কুয়েতের একটি ক্লিনিং কোম্পানিতে কাজ করতে যান লক্ষ্মীপুরের বেলাল উদ্দিন (ছদ্মনাম)। জানতেন না তিনি আসলে কি ভিসায় গেছেন সেখানে। দালালের ফাঁদে ঋণ নিয়ে তার প্রবাসযাত্রা।

ক্লিনার ভিসাতে যারা যান তাদের বেশিরভাগই পার্টটাইম কাজ করেন। যারা এই পার্টটাইমের সুযোগ পান না তাদের বছরের পর বছর ঋণের বোঝা মাথায় নিয়ে চলতে হয়। নিজের শখ পূরণ করা তো দূরের কথা পরিবারের চাহিদাও ঠিকমতো পূরণ করতে পারেন না।

দেশ থেকে গিয়ে ৮ মাস বসেছিলেন। কোম্পানি খবরও নেয়নি। কোম্পানির ব্যারাকে (আবাসস্থল) ছিলেন বলে থাকার চিন্তা না করলেও খাওয়ার চিন্তা ঠিকই ছিল। সেই খরচ যোগাতে ফের ধার-দেনা করতে হয়। পরে একটা পার্টটাইম কাজ ব্যবস্থা করে নেন। এরপর কিছুটা স্বস্তি পান। তিনমাস পর করোনার হানা। পার্টটাইম বন্ধ হয়ে গেলো। এবার তার ঘুম হারাম। বেলাল উদ্দিন এভাবেই তার কষ্টের কথা তুলে ধরে বলছিলেন, এত টাকার ঋণ কীভাবে কি করবো’ বুঝে উঠতে পারছিলাম না!

তিনি আরও বলেন, করোনায় কাজ বন্ধ হয়ে গেলে হয়তো আত্মহত্যা করা ছাড়া উপায় থাকতো না তার। বাড়ি থেকে আর কত টাকা নেবেন। একদিকে নিজের খরচ অন্যদিকে ঋণ পরিশোধ। বাড়িতে টাকা পাঠানো তো অনেক দূরের কথা। সব মিলিয়ে হতাশায় দিন কাটছিল তার। বিদেশ গিয়ে যেন মহাপাপ করেছেন। করোনার সময় অনেক কষ্ট করে চলেছেন। যেটা ভাষায় প্রকাশ করা সম্ভব না তার পক্ষে।

বেলাল উদ্দিন বলেন, করোনার প্রকোপ কমার পর পুনরায় পার্টটাইম কাজ শুরু করেন। এই কোম্পানিতে কাজ করা অনেকের অবস্থা তারই মতো। কেউ কেউ তো পার্টটাইম করতে গিয়ে ধরা খেয়ে দেশে ফেরেন। আবার অনেকে ছুটিতে এসে আর যেতে পারেননি। সাড়ে চার বছর হয়ে গেছে এখনো সেই ঋণের বোঝা মাথায় নিয়ে চলতে হয় তাকে।

বেলাল উদ্দিনের মতো হাজারো প্রবাসীর অভিযোগ, কেন বাংলাদেশ থেকে কুয়েত যেতে তাদের ৭ থেকে ১০ লাখ টাকা খরচ হবে? যেখানে কি না ভারতীয় ও নেপালিরা যান মাত্র ৫০ হাজার থেকে দেড় লাখ টাকার মধ্যে।

কুয়েতে কোম্পানিগুলো নামমাত্র টাকা নিয়ে ভিসা দেয়। বাংলাদেশিদের জন্য সেই ভিসার দাম হয়ে যায় ৭ লাখ টাকা। বাকি সব টাকা চলে যায় দালালের পকেটে। অথচ সরকারের এ ব্যাপারে কোনো পদক্ষেপ নেই।

কুয়েতের সরকারিভাবে বাংলাদেশিদের জন্য সব ভিসা বন্ধ। লামানা পদ্ধতি ছাড়া ভিসা বের করা সম্ভব হয় না। সেখানে বাংলাদেশিদের ভিসা বের করার জন্য মন্ত্রী বরাবর দরখাস্ত করতে হয়। সেটাও আবার অনেক দালালদের মাধ্যমে। এভাবে ভিসার দাম ৭ থেকে ১০ লাখ টাকায় পৌঁছায়। ভিসা পেতেও অনেক ভোগান্তির শিকার হতে হয়। আবার একটা ভিসা বের করতে বছরের পর বছর চলে যায়।

ক্লিনার কোম্পানিগুলোর বেতন কম হওয়ায় বাংলাদেশিরা কুয়েতে প্রায় ৯০ শতাংশ লোক বৈধ আকামা পাসপোর্ট ভিসা থাকা সত্ত্বেও অবৈধভাবে পার্টটাইম কাজ করেন, যা স্পষ্টভাবে আইনের লঙ্ঘন। ৮ ঘণ্টা কোম্পানির অথবা মালিকানায় কাজ করার পর অনেকে কোম্পানির বাইরে বিভিন্ন কাজ করেন, যেমন গাড়ি পরিষ্কার করা, সবজি বিক্রি করা, বিভিন্ন মার্কেটে, অফিসে, দোকানে ফ্যাক্টরিতে কাজ করা, যা দেশটির আইনে সম্পূর্ণ নিষেধ। যেহেতু পার্টটাইম ছাড়া উপায় নেই সেহেতু আইনভঙ্গ করে কাজ করেন অনেকে। 

‘কয়েকদিন আগে শুনলাম কুয়েতের বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতার জন্য ১৯০ দিনার বেতনে ভারত থেকে কর্মী নিচ্ছে। তাদের ভিসা একদম ফ্রি। শুধু নামমাত্র খরচ হবে। একই ভিসায় একই কাজে তো আমরাও কুয়েতে। তাহলে কেন আমাদের বেতনের এতো বৈষম্য? আমাদের কেন ৭ লাখ টাকা দিয়ে আসতে হয়? এমন হাজারো প্রশ্ন বিচলিত করে কুয়েত প্রবাসী বেলাল উদ্দিনকে। 

চলবে...

এমআরএম/এসএনআর/এমএস

প্রবাস জীবনের অভিজ্ঞতা, ভ্রমণ, গল্প-আড্ডা, আনন্দ-বেদনা, অনুভূতি, স্বদেশের স্মৃতিচারণ, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক লেখা পাঠাতে পারেন। ছবিসহ লেখা পাঠানোর ঠিকানা - [email protected]