ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরীর প্রয়াণ এবং একজন প্রবাসীর ভাবনা
ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরীকে নিয়ে সর্বপ্রথম একটা লেখা পড়েছিলাম ‘মুক্তিযুদ্ধ, গণস্বাস্থ্য, ডা. জাফরুল্লাহ ও মাছ চোর’। লিখেছিলেন গোলাম মোর্তোজা। সেটা ছিল ২০১৮ সালের ঘটনা। তখন তার নামে অনেকগুলো মামলা দেওয়া হয়েছে। তিনি জমি দখল করেছেন, চাঁদাবাজি করেছেন এমন বেশ কয়েকটি মামলা হয়েছে তার নামে। তিনি ফল চুরি করেছেন, মাছ চুরি করেছেন তেমন মামলাও হয়েছে। তারপরই এই লেখাটা লিখেছিলেন গোলাম মোর্তোজা।
সেই প্রথম বিস্তারিত জানতে পারলাম তার সম্পর্কে এবং গণস্বাস্থ্য কেন্দ্র সম্পর্কে। লেখাটা পড়ে যারপরনাই মুগ্ধ হলাম। এই যুগেও যে এমন একজন মানুষ জীবিত আছেন জেনে খুবই ভালো লাগলো। এরপর তার মৃত্যুর পর একই লেখকের আরেকটা লেখা পড়লাম ‘সংশপ্তক ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী’ শিরোনামে। এসব লেখা থেকেই জানলাম তিনি ১৯৬৪ সালে ঢাকা মেডিকেল থেকে এমবিবিএস পাস করে এফআরসিএস পড়তে গিয়েছিলেন লন্ডনে।
চার বছরের এফআরসিএস কোর্স শেষের দিকে। তিনি তখন প্রাইমারি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়েছেন, সপ্তাহখানেক পরেই ফাইনাল পরীক্ষা। এরই মধ্যে শুরু হয়ে গেলো বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ। সেই সময় লন্ডনে প্রবাসী বাংলাদেশিদের বিভিন্ন প্রতিবাদ সভা-সমাবেশ হচ্ছিল। লন্ডনের প্রখ্যাত হাইড পার্কে এ রকম একটি সমাবেশ চলছিল। সমাবেশের এক পর্যায়ে পাকিস্তানের অত্যাচারের প্রতিবাদে প্রকাশ্যে তিনি পাকিস্তানি পাসপোর্ট ছিঁড়ে ফেললেন। এরপর ট্রাভেল পারমিট জোগাড় করে বাংলাদেশের উদ্দেশ্যে রওয়ানা দেন।
১৯৭১ সালের মে মাসের শেষে তিনি এবং ডা. মবিন পৌঁছালেন আগরতলায় মুক্তিযুদ্ধের ২ নম্বর সেক্টরে। সেখানেই গড়ে তুললেন একটি হাসপাতাল। সেই হাসপাতালটিই স্বাধীন বাংলাদেশে জন্ম নিলো গণস্বাস্থ্য কেন্দ্র নামে। যার আদি জন্ম ১৯৭১ সালে ভারতের মাটিতে, আগরতলার বিশ্রামগঞ্জে। যুদ্ধে আহত মুক্তিযোদ্ধাদের চিকিৎসার জন্য গড়ে তোলা হয়েছিল প্রতিষ্ঠানটি। নাম দেওয়া হয়েছিল ‘বাংলাদেশ ফিল্ড হাসপাতাল’। ছন-বাঁশ দিয়ে নির্মাণ করা হয়েছিল ৪৮০ শয্যার হাসপাতাল, অপারেশন থিয়েটার। যুদ্ধে গুরুতর আহত মুক্তিযোদ্ধাদের জটিল অপারেশনও করা হতো বাঁশের তৈরি এই হাসপাতালে।
স্বাধীনতা পরবর্তীকালে সেটাই গণস্বাস্থ্য কেন্দ্র নামে পরিচালিত হয়ে আসছে। গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রে কর্মী সংখ্যা প্রায় ২ হাজার ৫০০, এর মধ্যে অন্তত ৪০ শতাংশ নারী। এখানকার সকল কর্মকর্তা এবং কর্মচারীকে পালাক্রমে খেতে কৃষি কাজ করেন। তারা কেউ প্রতিষ্ঠিত ডাক্তার, কেউ ইন্টার্নশিপ করছেন। সঙ্গে থাকেন প্রতিষ্ঠানের অন্য বিভাগের কর্মীরাও। তাদের সাথেই মাঠে নেমে পড়েন স্বয়ং প্রতিষ্ঠাতাও। এটা শুধু শখ করে নয়, কৃষি কাজ তাদের নিয়মিত কাজেরই অংশ।
এগুলোতো গেলো দৈনন্দিন কাজকর্ম। এর বাইরে তিনি বাংলাদেশের জন্য যুগান্তকারী কিছু কাজ করে গেছেন। বাংলাদেশের সমস্যা অথবা সম্ভাবনা দুটোর নামই জনসংখ্যা। তাই সেই জনসংখ্যার চিকিৎসাসেবা বাংলাদেশের আর্থসামাজিক প্রেক্ষাপটে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। স্বাধীন বাংলাদেশের ওষুধের বাজার ছিল বহুজাতিক কোম্পানির নিয়ন্ত্রণে। অনেক অপ্রয়োজনীয় ওষুধসহ প্রায় সাড়ে চার হাজার ওষুধ ছিল বাজারে।
কিছু তারা উৎপাদন করতেন, অধিকাংশই বিদেশ থেকে আমদানি করে আনতেন। স্বাধীনতার পর থেকেই দেশীয় ওষুধ শিল্প গড়ে তোলার স্বপ্ন দেখছিলেন ডা. জাফরুল্লাহ। ১৯৮২ সালে সরকারিভাবে ওষুধ নীতি করাতে সক্ষম হন। সাড়ে ৪ হাজার ওষুধ থেকে প্রায় ২ হাজার ৮০০ ওষুধ নিষিদ্ধ করা হয়।
ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরীর দুটি কিডনিই ছিল প্রায় অকেজো। সপ্তাহে তিনদিন ডায়ালাইসিস করতে হতো। তার আমেরিকান ডাক্তার বন্ধুরা তাকে আমেরিকায় নিয়ে ট্রান্সপ্লান্ট করে দেওয়ার উদ্যোগ নিলেন। এতে তার কোনো অর্থ ব্যয়ের ব্যাপার ছিল না। তিনি রাজি হননি। কারণ বাংলাদেশে কিডনি ট্রান্সপ্লান্ট আইন পরিবর্তনের জন্য তিনি আন্দোলন করছিলেন। পরবর্তীতে তিনি গণস্বাস্থ্য নগর হাসপাতালে ১০০ শয্যার একটি সর্বাধুনিক কিডনি ডায়ালাইসিস সেন্টার গড়ে তোলেন।
ভারতেও এত বড় কিডনি ডায়ালাইসিস সেন্টার নেই। এটাই দক্ষিণ এশিয়ার সবচেয়ে বড় এবং উন্নত যেকোনো দেশের সঙ্গে তুলনীয় কিডনি ডায়ালাইসিস সেন্টার। কিন্তু খরচ অবিশ্বাস্য রকমের কম। বাংলাদেশের একটা তথ্য লক্ষণীয়। ইউএসএআইডির পরিসংখ্যান অনুযায়ী এখনো বাংলাদেশে প্রায় ৬০ শতাংশ সন্তান প্রসব হয় ধাত্রীদের হাতে। এটার মাধ্যমে বাংলাদেশের চিকিৎসাসেবার বাস্তব অবস্থা সম্পর্কে একটা ধারণা পাওয়া যায়।
বাংলাদেশের গ্রামীণ জনগোষ্ঠীর বেশিরভাগেরই কোনো জন্মনিবন্ধন নেই। আমাদের পরিবারে আমরা কারো জন্মদিনই জানতাম না। আসলে গ্রামীণ জীবনে এগুলোর তেমন দরকারও নেই। স্কুলে মাধ্যমিকের পরীক্ষার আগে নিবন্ধনের সময় স্যারেরা ব্যাক ক্যালকুলেশন করে একটা জন্মতারিখ নির্ধারণ করে দেন। বাকি জীবন সেটা দিয়েই কাজ চলে যায়। এখন অবশ্য জাতীয় পরিচয়পত্র বানাতে জন্মদিন লাগে। তখন ইউনিয়ন পরিষদ অফিসে যেয়ে কর্মচারীদের টাকা দিয়ে জন্ম নিবন্ধন সনদ নিতে হয়।
এমন একটা দেশের মানুষের জন্য চিকিৎসা ‘বাণিজ্য’ নয়, সত্যিকার অর্থেই ‘সেবা’ দেয় গণস্বাস্থ্য কেন্দ্র। এমনকি স্বাস্থ্যবীমা চালু করেছে, সেই সূচনালগ্ন থেকে। গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের ঢাকার হাসপাতালে সন্তান প্রসবের মোট খরচ ২ হাজার টাকা। সাভারে আরও কম। সিজারিয়ানের প্যাকেজ ১২ থেকে ১৪ হাজার টাকা। ডাক্তার, ওষুধ, প্যাথলজিক্যাল পরীক্ষার নামে অন্য কোনো বাড়তি খরচ নেই। সাধারণ প্রসবকে উৎসাহিত করা হয়।
জটিলতা দেখা না দিলে সিজার করা হয় না। অন্য হাসপাতাল বা ক্লিনিকগুলোতে সাধারণ প্রসব নেই বললেই চলে। সিজারিয়ানের প্যাকেজ সর্বনিম্ন ৬০ হাজার থেকে ২ বা ৩ লাখ টাকা পর্যন্ত। সকল রকম প্যাথলজিক্যাল পরীক্ষার খরচ ঢাকার মাঝারি মানের হাসপাতাল, ক্লিনিকের চেয়ে অর্ধেকেরও কম। সন্তান প্রসবের দক্ষ কারিগর ধাত্রীদের সঙ্গে নিবিড় সম্পর্ক রেখে চলে গণস্বাস্থ্য কেন্দ্র। তাদের প্রশিক্ষণের উদ্যোগ নিয়েছে সূচনালগ্ন থেকে।
এমন আরও হাজারটা উদাহরণ দেওয়া যাবে তার বিস্তৃত কর্মপদ্ধতির। কিন্তু সবকিছু ছাড়িয়ে তার যে বিষয়টা আমাকে মুগ্ধ করেছে সেটা হলো অনাড়ম্বর জীবন আর সরল জীবনপদ্ধতি। যেটাকে ভদ্রলোকেরা ‘ডাউন টু আর্থ’ বলে থাকেন। তিনি একই শার্ট পরছেন ত্রিশ বছর ধরে কারণ সেটা এখনও ছিঁড়ে যায়নি। একটা প্যান্ট পরছেন সেও বহুদিন ধরে। চড়েন একটা ভাঙাচোরা গাড়িতে।
ইনিই সেই লোক যিনি লন্ডনে বানানো স্যুট পরতেন যারা প্রিন্স চার্লসের স্যুট বানাতেন। নিজের প্রাইভেট জেট চালানোর লাইসেন্স পর্যন্ত ছিল। একটা সার্থক জীবনের জন্য এই উপলব্ধিটা খুবই জরুরি। জীবনের জন্য কোনটা প্রয়োজন আর কোনটা চাহিদা সেই তফাৎটা এখনকার যুগে আমরা কেউই ধরতে পারি না বিশেষ করে প্রবাসীরা। কারণ প্রবাসের ঘড়ির কাটার সাথে তাল মিলিয়ে চলা জীবনের ভাবনার অবসর নেই বললেই চলে।
একবার রিকশা করে ফেরার সময় কথা প্রসঙ্গে রিকশাওয়ালাকে বলেন, দেশ ছেড়ে চলে যাবেন। ততক্ষণে রিকশাওয়ালা জেনেছেন তিনি পেশায় ডাক্তার। উত্তরে রিকশাওয়ালা বলেন, আপনারা না হয় চলে যাবেন কিন্তু আমরা কোথায় যাবো? এরপর আর তিনি দ্বিতীয়বার বিদেশে আসার কথা ভাবেননি। এই বিষয়টা আমাকে খুবই তাড়িত করছে। আমরা রাষ্ট্রের সাধারণ মানুষের দেওয়া ট্যাক্সের টাকায় প্রায় বিনামূল্যে উচ্চ শিক্ষা গ্রহণ করি। এরপর অজুহাত খুঁজতে থাকি বিদেশে পাড়ি জমাবার। দেশেও যে আমরা খুব খারাপ ছিলাম তা কিন্তু না। তবুও আমাদের উচ্চাকাঙ্ক্ষার শেষ নাই।
আর্থিক এবং সামাজিক নিরাপত্তার অজুহাত তুলে দেশ ত্যাগ করি। আর দেশে কোনো খারাপ কিছু ঘটলেই শাপ শাপান্ত করি। আসলেই তো বাংলাদেশের প্রকৃত অধিবাসী এই খেটে খাওয়া মানুষগুলো। তারা রাষ্ট্রের কাছ থেকে যতটুকু সেবা পায় সেটা নিয়েই সন্তুষ্ট থাকে। আর বাকিটা অদৃষ্টের হাতে ছেড়ে দেয়।
কোনো কিছু না পেলে কপালে নেই বলে নিজেকে সান্ত্বনা দেয়। কি সহজ সাধারণ জীবনবোধ। তারা শুধু মাথার ঘাম পায়ে ফেলে তিনবেলার অন্ন সংস্থান করার চেষ্টা করেন। তাদের না আছে আবাসের ঠিকানা, না আছে শিক্ষার ঠিকানা, না আছে ভালো পোশাক বা চিকিৎসার ঠিকানা। কেউ অকালে চিকিৎসা বা ওষুধের অভাবে মারা গেলে সেটাকে নিয়তি বলেই ধরে নেয়।
একটা দেশ আসলে কখনও ভালো হয় না। তাকে ভালো বানাতে হয়। আর তরুণ প্রজন্মই পারে সেই কাজটা করতে। কিন্তু বর্তমানের অর্থ-সামাজিকতায় তরুণেরা কোনোভাবে দেশ ছাড়তে পারলেই যেন বেঁচে যায়। একটা বিষয় মনে রাখা দরকার এতো ছোট ভৌগোলিক আয়তনের দেশে এত জনসংখ্যা বোধহয় বিশ্বের আর কোন দেশে নেই। আর আমাদের দেশের বয়সও সবে বায়ান্ন বছর।
মাত্র তার শৈশব পেরিয়ে কৈশোরে পা দিয়েছে। এর মধ্যেই অনেক রকমের অর্জনও আছে। বাকিগুলোও হয়তোবা সময়ের সাথে সাথে অর্জিত হবে। আর বিদেশে যাওয়াটা সবসময়ই খারাপও নয়। কারণ বাংলাদেশের অর্থনীতির অন্যতম চালিকাশক্তি বৈদেশিক মুদ্রা যেটা প্রবাসীদের রক্ত পানি করা পয়সা। কিন্তু এখানে একটা ফাঁক আছে। এই বৈদেশিক মুদ্রাগুলোর সিংহভাগই আসে মধ্যপ্রাচ্যের শ্রমশক্তি থেকে। যাদের দেশে এবং এয়ারপোর্টে বিভিন্ন ভোগান্তির মধ্যে দিয়ে যেতে হয়।
আর শিক্ষিত প্রবাসীরা শুধু দেশ থেকে নিয়েই যান প্রতিদানে তেমন কিছুই দেন না। তারা বিদেশে এসে দেশের সহায় সম্পত্তিও হুন্ডির মাধ্যমে বিদেশে নিয়ে আসেন। আর নিজের আয়ের প্রায় পুরোটাই বিদেশেই বিনিয়োগ করেন। ছুটির সময়গুলোতে তারা দেশে না গিয়ে অন্যান্য উন্নত দেশে বেড়াতে যান। কারণ তাদের ছেলেমেয়েদের না কি দেশের আবহাওয়া, খাদ্য এবং পানীয় সহ্য হয় না।
এমন কথা শুধু বাংলাদেশিদের পক্ষেই বলা সম্ভব অবশ্য হাতেগোনা কিছু ব্যতিক্রম আছে। মজার ব্যাপার হচ্ছে আমাদের পাশের দেশ ভারত, পাকিস্তান এমনকি নেপালের প্রবাসীরাও দেশকে এতটা দোষারোপ করেন না। আমি স্বপ্ন দেখি একদিন বাংলাদেশের প্রবাসীরাও বাংলাদেশকে নিয়ে একটা সময় গর্ব করবেন। দেশের বিপদে আপদে এগিয়ে আসবেন। ঠিক যেমন ডা. জাফরুল্লাহ বিদেশের ডিগ্রি এবং আয়েশের জীবন ফেলে এসে মুক্তিযুদ্ধে যোগ দিয়েছিলেন।
এমআরএম/এএসএম