ড. জাফর ইকবাল কেন টার্গেট?
মো. মাহমুদ হাসান
বরেণ্য শিক্ষাবিদ, লেখক, গবেষক অধ্যাপক ড. জাফর ইকবালকে নিয়ে টানাটানি চলছে। ভীষণ টানাটানি! মনে হয় সামনে পেলে কিছু মানুষ উনাকে টেনে হিঁচড়ে খাদে ফেলতেন। এদের ক্ষোভ, জাফর ইকবাল সম্পাদিত সপ্তম শ্রেণির বিজ্ঞান বইয়ে প্লাজারিজম হয়েছে। বাংলায় আমরা যাকে নকল বলি, পশ্চিমাদের ভাষায় এটি-ই প্লাজারিজম।
তবে পূর্ব পশ্চিমে এর ব্যবহার আর ব্যখ্যা বিশ্লেষণে বিরাট ফারাক। আমার দেশে এক পরীক্ষার্থী, আরেক পরীক্ষার্থীর খাতা দেখে কপি করলে সেটি আইনের দৃষ্টিতে অপরাধ হিসেবে বিবেচিত হয়। আশ্চর্য জনকভাবে একই নোট মুখস্থ করে, একশ জন পরীক্ষার্থী যদি একই রকম উত্তরপত্র জমা দেয়, সেটি নকল হিসেবে বিবেচিত হয় না। পাশ্চাত্যে এক পরীক্ষার্থীর উত্তরপত্রের দুটো লাইন যদি আরেক পরীক্ষার্থীর উত্তরপত্র বা কোনো লেখকের লেখার সংগে হুবহু মিলে যায় সেটি-ই প্লাজারিজম। আর একজন শিক্ষার্থীকে সাড়া শিক্ষাজীবন এ প্লাজারিজমের শাস্তি বয়ে বেড়াতে হয়। অনেক সময় শিক্ষা জীবন শেষে কর্ম জীবনেও এর রেশ টানতে হয়।
প্লাজারিজম একটি শিক্ষার্থীর স্বপ্নকে ধূলিসাৎ করে দেয়। সৃজনশীলতা আর সৃষ্টিশীলতার পথে এর চেয়ে বড় কোনো অন্তরায় নেই। পশ্চিমা সমাজ বিশ্বাস করে, একবার যদি কোনো শিশু প্লাজারিজমে অভ্যস্ত হয়ে উঠে, তবে তার নৈতিক মানদণ্ড দুর্বল হয়ে যায়। ফলশ্রুতিতে আরও অনৈতিক কর্মকাণ্ডের প্রতি তাদের উৎসাহ উদ্দীপনা বৃদ্ধি পেতে পারে। তাই এলিমেন্টারি বা প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকেই শিশুদের ন্যায়, অন্যায় আর ভালো মন্দের পার্থক্য নিরূপণে বাস্তবমুখী শিক্ষা দেওয়া হয়।
শিশুকাল থেকেই শিক্ষার্থীরা প্লাজারিজমের মর্মার্থ বুঝে যায়। প্রতিটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে প্লাজারিজম নিয়ে ক্লাস, সেমিনার, সিম্পোজিয়ামর আয়োজন করা হয়। ‘প্লাজারিজম’ শব্দটি শুনলেই যেন শিক্ষার্থীদের মনে এক রকম বিতৃষ্ণা আর ঘৃণা বোধের জন্ম হয়। যদি কোনো শিক্ষার্থী জানতে পারে তার কোনো সহপাঠী প্লাজারিজমের আশ্রয় নিয়েছে, পারতপক্ষে সবাই তাকে এড়িয়ে চলে।
দুর্ভাগ্য বা সৌভাগ্য কিনা জানি না, কানাডার মতো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানেও আমি স্বচক্ষে প্লাজারিজমের সংশ্লিষ্টতা দেখেছি। এমন ঘৃণ্যতম অপরাধে জড়িতদের কেউ বা জেনে শুনে প্লাজারিজমের আশ্রয় নিয়েছিলেন, আবার কেউবা ধারণাগত ভুলের বশবর্তী হয়ে অনৈতিকতায় জড়িয়ে ছিলেন। তবে কোনো মাধ্যমিক বা উচ্চ মাধ্যমিক পর্যায়ে নয়, উচ্চ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে। আর এ অনৈতিক কর্মকাণ্ডে জড়িতদের সংখ্যা একেবারেই নগন্য যা কোনোভাবেই শতকরা হিসেবের আওতায় পড়ে না। তবে মজার ব্যাপার হচ্ছে, এরা কেউই প্লাজারিজম করে সফল হতে পারেনি।
তদন্ত প্রক্রিয়ার কঠোরতায় সত্য উদঘাটনেও সময় লাগেনি। যারা জ্ঞান আর যথাযথ তথ্যের অভাবে এই অশুভ কর্মে জড়িয়েছিলেন তাদের দীর্ঘমেয়াদি শুদ্ধিকরণ বা একাডেমিক ডিটেনশনের মুখোমুখি হতে হয়েছে। আর যারা স্বেচ্ছায় প্লাজারিজমের পথ বেঁচে নিয়েছিলেন, তাদের পড়ালেখার পাঠ চুকিয়ে কাউকে নিজ মাতৃভূমিতে ফেরত যেতে হয়েছে, কাউকে বা অন্য কোনো বিকল্প পথ বেঁচে নিতে হয়েছে। সবচেয়ে দুঃখজনক সত্যি হলো, এ দুষ্কর্ম্মে জড়িতরা কেউই কানাডিয়ান বা অভিবাসী পরিবারের নতুন প্রজন্মের কেউ ছিলেন না। এদের সবাই ছিলেন আন্তর্জাতিক শিক্ষার্থী, আরও সুনির্দিষ্টভাবে বলা যায় অধিকাংশই ছিলেন এশিয়ান।
প্রজন্মের ওপর প্লাজারিজমের ক্ষতিকর প্রভাব নিয়ে জাফর ইকবালের মতো মানুষকে জ্ঞান দেওয়ার সুযোগ কারও আছে বলে বিশ্বাস করি না। পাশ্চাত্য শিক্ষা সংস্কৃতির নৈতিকতার সিদ্ধহস্ত এই শিক্ষাবিদ, তার লেখালেখি আর গবেষণার মাধ্যমে একটি সৃজনশীল প্রজন্ম সৃষ্টির লক্ষ্য নিয়ে রাতদিন কাজ করছেন। তরুণ প্রজন্মকে সৃষ্টিশীলতা আর নৈতিকতায় উদ্বুদ্ধ করতে তার প্রচেষ্টারও কোনো কমতি নেই। চাইলে অনেক আগেই নামিদামি বিশ্ববিদ্যালয়ের শীর্ষ নির্বাহীও হতে পারতেন। অতীত বিশ্লেষণে তার মধ্যে কোনো পদ-পদবীর কোনো মোহ আজ অবধি জাতির দৃষ্টিগোচর হয়নি। তাহলে এমন একজন গুণী মানুষকে নিয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে এত ঝড় কেন?
আমাদের জাতীয় সংস্কৃতিতে দায় স্বীকারের প্রথা নেই বললেই চলে। অন্যের ওপর দায় চাপিয়ে অথবা নিজের কর্মকাণ্ডকে বৈধতা দিতে যে কোনো শঠতার আশ্রয় নিতে আমরা কখনো কার্পণ্য করি না। সপ্তম শ্রেণির বিজ্ঞান বইয়ে কিছু তুঘলকি কাণ্ড ঘটেছে। তথ্য নির্ভর নয় এমন একটি ওয়েভ সাইট থেকে সাইটেশন ছাড়া একটি অনুচ্ছেদ কপি করা হয়েছে, আবার আর একটি অধ্যায়ে গুগলের দুর্বল অনুবাদের আশ্রয় নেওয়া হয়েছে।
আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থার পর্যালোচনায় দুটো ঘটনা অত্যন্ত সাধারণ হলেও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম আর ইলেকট্রনিক তথ্য মাধ্যমের দিকে তাকালে মনে হয়, দুটো ঘটনা আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থাকে ধ্বংসের মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দিয়েছে!
সপ্তম শ্রেণির বিজ্ঞান বইটির সম্পাদক হিসেবে ড. জাফর ইকবাল-ই যেন সব সর্বনাশের হোতা। আসলেই কি তাই? বইটি প্রকাশের আগে ত্রুটিগুলো সম্পাদনা পরিষদের দৃষ্টি গোচর হয়নি, এর দায় অবশ্যই সম্পাদনা পরিষদের। অপ্রত্যাশিত ঘটনাটি উদঘাটনের সঙ্গে সঙ্গে জাফর ইকবাল দায় স্বীকার করেছেন।
বিবৃতিতে ঘটনার জন্য দুঃখ প্রকাশ করেছেন। আমাদের সামাজিক ও জাতীয় সংস্কৃতির ধারাবাহিকতার বাইরে গিয়ে বিভিন্ন গণমাধ্যমে স্পষ্ট ভাষায় একে প্লাজারিজম বলে দাবি করেছেন। বোধ করি নীতিনির্ধারকদের সাথে পরবর্তী করণীয় নিয়ে আলোচনাও করেছেন, তবুও জাফর ইকবালকে হেনস্তা করতে একদল মানুষ যেন মরণপণ চেষ্টায় নিয়োজিত! কি রয়েছে, এর অন্তরালে? একাডেমিক স্বচ্ছতা প্রতিষ্ঠা, নাকি সুদূরপ্রসারী কোনো দুরভিসন্ধি?
আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থায় অনিয়ম, অনাচার নতুন নয়। সংস্কারের মাধ্যমে যুগোপযোগী করে শিক্ষা ব্যবস্থার আধুনিকায়ন নিয়ে নানা প্রচেষ্টাও চলমান। তবুও গুণগত শিক্ষা নিশ্চিত করতে উল্লেখযোগ্য প্রত্যাশিত উন্নতি হয়েছে, এমন দাবি করার সময় এখনো আসেনি। নতুন বছরের বইয়ে ইতিহাস ঐতিহ্য নিয়ে বিতর্কিত তথ্যের সংযোজন যে সাবোটাজ নয়- এর গ্যারান্টিই বা কোথায়?
আমাদের অর্থনৈতিক, সামাজিক ও রাজনৈতিক মূল্যবোধের সাথে শিক্ষা ব্যবস্থার রয়েছে এক সুগভীর সংযোগ। তাই সুদৃঢ় নৈতিক মূল্যবোধ নিশ্চিত করতে না পারলে, কাঙ্ক্ষিত সমাজ প্রতিষ্ঠা সম্ভব নয়। ড. জাফর ইকবাল এমন কাঙ্ক্ষিত একটি প্রজন্মের লক্ষ্যে প্রতিনিয়ত কাজ করছেন। তার লেখালেখি, গবেষণা, বক্তব্য, বিবৃতিতে এমন প্রচেষ্টার সুস্পষ্ট প্রমাণাদি দৃশ্যমান, তবুও তাকে নিয়ে এত নির্লজ্জ উপহাস কেন?
জাফর ইকবাল একজন শিক্ষক! আমার দৃষ্টিতে একজন ব্যতিক্রমী শিক্ষক। আজকাল আমাদের শিক্ষক সমাজ নিজেদের স্বার্থ সিদ্ধির লক্ষ্যে সাদা, লাল, নীল, সবুজ এমন নানা ধারায় বিভক্ত। একধারার সমর্থক, আরেক ধারাকে সহ্য করতে পারেন না। আর শিক্ষকদের অনুকরণে ছাত্র সমাজের মাঝেও এই অসহিষ্ণুতা বিস্তৃতি লাভ করে। এক ধারার ছাত্র সমাজ তার বিপরীত ধারার শিক্ষক কে ন্যুনতম শ্রদ্ধাবোধ প্রদর্শনেও অনীহা প্রকাশ করে। শিক্ষা ব্যবস্থার এমন সুকঠিন বাস্তবতায়ও জাফর ইকবাল যেন ব্যতিক্রম!
তিনি রাজনীতি করেন না, তবে একটি চেতনাকে ধারণ করেন। আর এই চেতনাকে প্রজন্মের মাঝে বিকশিত করতে নিয়মিত এর পরিচর্যাও করেন। এমন অনেককেই জানি, যারা শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র ছিলেন, আদর্শিক চেতানায় জাফর ইকবালের অনুসারী নয়, তবুও শিক্ষক হিসেবে তার প্রতি আস্থা আর শ্রদ্ধাবোধের কোনো কমতি নেই। যদি তাই হয়, সাম্প্রতিককালে জাফর ইকবালকে নিয়ে এত তীর্যক ব্যাঙ্গ বিদ্রুপের হেতু কি?
জাফর ইকবাল যা বিশ্বাস করেন, তা করতে ও বলতে সংশয়ে ভোগেন না। তাই তো সিলেটের কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে বসে ঝড় বৃষ্টির দিনে একাই তাকে প্রতিবাদ জানাতে দেখা যায়। মৌলবাদ, সাম্প্রদায়িকতা, ধর্মীয় উগ্রবাদের তিনি কট্টর সমালোচক। বাংলাদেশ, স্বাধীনতা আর বঙ্গবন্ধুর প্রশ্নে তিনি আপসহীন। সাম্যভিত্তিক একটি সুখী, সুন্দর সমাজ ব্যবস্থাকে তিনি হৃদয়ে লালন করেন। চিন্তা চেতনায় জাফর ইকবালের পরিপন্থী মানুষের সংখ্যা বাংলাদেশে কম নয়!
এসব মানুষের রাজনৈতিক পৃষ্ঠপোষক যেমন রয়েছে, পাশাপাশি আন্তর্জাতিক মুরুব্বিও রয়েছে। এরা বিশ্বাস করে, জাফর ইকবালরা কোনো ব্যক্তি নয়, এরা প্রতিষ্ঠান। জাফর ইকবালরা বেঁচে থাকলে বাংলায় তালেবানী বিকাশ ক্ষতিগ্রস্ত হবে, একাত্তরের প্রতিশোধ প্রলম্বিত হবে। তাই কখনো এরা জাফর ইকবালকে মুরতাদ ঘোষণা করে, কখনো বা ফয়জুল হাসানকে ব্যবহার করে শাহজালাল বিশ্ববিদ্যালয়ের মুক্তমঞ্চে তাকে রক্তাক্ত করে।
সপ্তম শ্রেণির বিজ্ঞান বইয়ের উসিলায়, জাফর ইকবালদের থামিয়ে দিয়ে, ওরা পরাজিত হায়েনাদের খায়েস পূরণ করতে চায়। চরমপন্থীদের ভূস্বর্গ বানিয়ে, ওরা দেশমাতৃকার অগ্রযাত্রাকে চিরদিনের জন্য থামিয়ে দিতে চায়। এরা দেশপ্রেমিক নয়, দেশদ্রোহী। দেশ-বিদেশে বসে ষড়যন্ত্র আর প্রপাগান্ডার মাধ্যমে অস্থিতিশীলতা সৃষ্টি করে সুগভীর নীলনকশা বাস্তবায়নে এরা বদ্ধপরিকর।
লেখক: কলামিস্ট উন্নয়ন গবেষক ও সমাজতাত্ত্বিক বিশ্লেষক
সাধারণ সম্পাদক, আলবার্টা রাইটার্স ফোরাম
এমআরএম/এমএস