লাল সন্ত্রাস: সিরাজ সিকদার ও সর্বহারা রাজনীতির মঞ্চায়ন

মো. ইয়াকুব আলী
মো. ইয়াকুব আলী মো. ইয়াকুব আলী
প্রকাশিত: ০৮:৫৪ এএম, ০৩ নভেম্বর ২০২২

এই বইয়ের ফ্ল্যাপে লেখা আছে, সত্তরের দশকের শুরুর কয়েকটি বছর বাংলাদেশের ওপর দিয়ে বয়ে গেছে প্রচণ্ড এক ঝোড়ো হাওয়া। এ সময় অল্প কয়েকজন ব্যক্তি নানাভাবে এ দেশের তরুণদের মনোজগতে সাড়া জাগাতে পেরেছিলেন। তাদের একজন সিরাজ সিকদার। তার নেতৃত্বে পূর্ব বাংলার সর্বহারা পার্টি ছিল ওই সময়ের এক আলোচিত চরিত্র।

তরুণদের একটা বড় অংশ এই দলের সশস্ত্র ধারার রাজনীতিতে শামিল হয়েছিলেন। তারা কারও চোখে বিপ্লবী, কারও চোখে সন্ত্রাসী। বাংলাদেশের রাজনীতির ইতিহাসের ব্যবচ্ছেদ করতে হলে অনিবার্যভাবেই উঠে আসে সিরাজ শিকদার এবং সর্বহারা পার্টির প্রসঙ্গ।

এ নিয়ে আছে অনেক আলোচনা-সমালোচনা, বিতর্ক ও বিভ্রান্তি। সিরাজ সিকদার এবং বাংলদেশের সর্বহারা রাজনীতির একটা সামগ্রিক ছবি এ বইয়ে তুলে ধরা হয়েছে।

বইটা মোট দুইটা পর্বে বিভক্ত। এছাড়াও শুরুতে আছে, ‘জীবনের গল্প’ শিরোনামে লেখকের ভূমিকা। আর শেষে আছে ‘ইতিহাসের এনাটমি’ শিরোনামে লেখকের নিজস্ব কিছু বিশ্লেষণ। প্রথম পর্ব ‘পূর্বাপর’ এ লেখক বাংলাদেশে সর্বহারা রাজনীতির উৎস এবং বিবর্তন অনুসন্ধান করেছেন।

আর দ্বিতীয় পর্ব ‘তাহাদের কথা’তে লেখক সর্বহারা রাজনীতির সাথে যুক্ত এবং সহানুভূতিশীলদের নিজেরদের বক্তব্য তুলে ধরেছেন। ফলে বইটা হয়ে উঠছে বাংলাদেশের সর্বহারা রাজনীতির এক অকাট্য দলিল।
লেখক বইটা শুরু করেছেন একটা সাঁওতাল গানের মাধ্যমে,

‘সিধু তুমি কোথায়
রক্তে করেছ স্নান
কাঁদো কেন কানু
লড়াই লড়াই
আমার ভাইদের জন্য
আমরা করেছি রক্তস্নান
তস্কর আর ব্যাপারীরা
আমাদের জমি নিয়েছে কেড়ে।’

ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির বিরুদ্ধে গর্জে উঠা সাঁওতাল জনগোষ্ঠির দুই ভাই ছিল সিধু-কানু। ১৮৫৫-৫৬ সালে তারা জমিদার জোতদারদের বিরুদ্ধে তির-ধনুক নিয়ে বিদ্রোহ করলে কোম্পানির সৈন্যদের বন্দুকের সামনে তারা টিকতে না পেরে অন্য অনেকের সঙ্গে শহীদ হন। সর্বহারা রাজনীতির শেকড় অনুসন্ধান করতে গিয়ে লেখক তাই এই ঘটনার কথা উল্লেখ করেছেন।

এরপর জন্মকথা’তে লেখক লিখেছেন – ‘ভারতের মার্কসবাদী কমিউনিস্ট পার্টির শিলিগুড়ি কমিটি ১৯৬৫ থেকেই সশস্ত্র বিপ্লবের তত্ত্ব প্রচার করছিল। তারা কয়েকটি গ্রামে কৃষক কমিটি তৈরি করে। এখানকার কৃষকেরা প্রধানত আদিবাসী-সাঁওতাল। এদের বেশিরভাগই গরিব ভাগচাষি।’

এরপর এসেছে নকশালবাড়ি এবং তার পুরোধা চারু মজুমদার এবং কানু সান্যালের কথা। তারপরই এসেছে বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির কথা। লেখকের ভাষায় – ‘বাংলাদেশের কমিউনিস্টরা ভারতের কমিউনিস্ট পার্টির অংশ ছিলেন। ১৯৪৭ সালে ভারত-ভাগের পর পূর্ববঙ্গ কমিউনিস্ট পার্টির আলাদা কমিটি হয়।

তবে তাত্ত্বিক ও প্রায়োগিক দিক থেকে ভারতের কমিউনিস্ট পার্টির সঙ্গে তাদের ফারাক ছিল না। ভারতে কমিউনিস্ট পার্টির ভাঙন ধরলে এ দেশেও তার প্রভাব পড়ত এবং পার্টি ভাগ হতো।’

এরপর এসেছে সিরাজ সিকদারের পরিচয়। সিরাজ সিকদারের জন্ম ১৯৪৪ সালে, শরীয়তপুর জেলার ভেদরগঞ্জ উপজেলার লাকার্তা গ্রামে। বরিশাল জিলা স্কুল থেকে মাধ্যমিক এবং বরিশালের ব্রজমোহন কলেজ থেকে উচ্চমাধ্যমিক পাস করে তিনি ১৯৬৩ সালে ঢাকায় বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় বুয়েটে ভর্তি হন।

বুয়েটে পড়ার সময় সিরাজ সিকদার পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র ইউনিয়নের সংগঠক হন। ১৯৬৫ সালে সোভিয়েত ও চীনা লাইনে ছাত্র ইউনিয়ন বিভক্ত হলে তিনি চীনপন্থী অংশের সঙ্গে থাকেন।

সিরাজ সিকদারের ব্যক্তিমানস ও দৃষ্টিভঙ্গির পরিচয় তুলে ধরার জন্য লেখক দুটি ঘটনার উল্লেখ করেছেন। সিরাজ সিকদারের উপলব্ধি হয়, মধ্যবিত্তসূলভ সনাতন খোলস থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। ‘আমি’ শব্দের অহংবোধ ছাড়তে হবে। জীবনে তিনি যত ছবি তুলেছিলেন, যেসব ছবি তার সংগ্রহে ছিল, সব পুড়িয়ে ফেললেন। গোগ্রাসে গিলতে থাকলেন মাও সেতুংয়ের রচনা। সমাজের নানা অংশের মানুষের মধ্যে বৈষম্য তাকে পীড়িত করতো।

দ্বিতীয় ঘটনাটি সিরাজ সিকদারের বিয়ের। তখন তিনি পড়েন থার্ড ইয়ারে। উনাদের বাড়িতে রওশন আরা নামের পনের-ষোল বছরের দূর সম্পর্কের এক আত্মীয়া কাজ করতেন। তাকে সেই কঠোর পরিশ্রম থেকে মুক্তি দিতে সিরাজ সিকদার বিয়ে করেন। এভাবেই তিনি বাস্তব জীবনে কমিউনিস্ট মূল্যবোধের প্রয়োগ শুরু করেন।

কেন্দ্রীয় ছাত্র ইউনিয়নের সহ-সভাপতি থাকাকালীন সিরাজ সিকদার ১৯৬৮ সালের মে মাসে গঠন করেন ‘পূর্ব বাংলা শ্রমিক আন্দোলন’। প্রথমবারের মতো সম্পূর্ণ বাংলা ভাষায় একটা রাজনৈতিক দলের নাম রাখলেন সিরাজ সিকদার এবং তার সহযোগীরা। এটি হবে গোপন সংগঠন। দলে যারা থাকবেন তারা ছদ্মনাম ব্যবহার করবেন।

এভাবেই সিরাজ সিকদার হলেন রুহুল আলম। সিদ্ধান্ত হলো, আলাদা একটা অফিস নেওয়া হবে। অফিসের নাম দেওয়া হলো মাও সে তুং চিন্তাধারা গবেষণা কেন্দ্র। কাজ চললো ১৯৬৮ সালের নভেম্বর পর্যন্ত। পয়লা ডিসেম্বর তারিখ বসিয়ে তিনি উপস্থাপন করলেন ‘পূর্ব বাংলা শ্রমিক আন্দোলনের থিসিস’ যেটা আগেই লেখা ছিল।

থিসিসে ১৯৪৭ পরবর্তী সময়ে সমাজে চারটি দ্বন্দ্বের কথা উল্লেখ করা হয়। দ্বন্দ্বগুলো হলো - ১. পূর্ব বাংলার জনগণের সঙ্গে পাকিস্তানি উপনিবেশবাদের জাতীয় দ্বন্দ্ব; ২. পূর্ব বাংলার কৃষকের সঙ্গে সামন্তবাদের দ্বন্দ্ব; ৩. পূর্ব বাংলার জনগণের সঙ্গে সাম্রাজ্যবাদ, বিশেষ করে মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের, সংশোধনবাদ বিশেষ করে সোভিয়েত সামাজিক সাম্রাজ্যবাদের এবং ভারতীয় সম্প্রসারণবাদের জাতীয় দ্বন্দ্ব; ৪. পূর্ব বাংলার বুর্জোয়া শ্রেণির সঙ্গে শ্রমিক শ্রেণির দ্বন্দ্ব।

থিসিসে উল্লেখ করা চারটি দ্বন্দ্বের মধ্যে প্রথমটিকেই প্রধান দ্বন্দ্ব হিসেবে দেখতে হবে। থিসিসে দুটি বিষয় তুলে ধরা হয়, যা খুবই গুরুত্বপূর্ণ:

১. জাতীয় পতাকা ঊর্ধ্বে তুলে ধরে জাতীয় সংগ্রামের ভিত্তিতে ঐক্যফ্রন্ট তৈরি করতে হবে;
২. শ্রমিক-কৃষক মৈত্রীর ভিত্তিতে সর্বহারা শ্রেণির নেতৃত্বে পাকিস্তান উপনিবেশবাদবিরোধী সব দেশপ্রেমিক শ্রেণিকে ঐক্যবদ্ধ করতে হবে।

থিসিসে বেশ কয়েকটি নতুনত্ব ছিল। তখনকার দিনে ডান-বাম নির্বিশেষে সবাই পূর্ববঙ্গ শব্দের বদলে পূর্ব পাকিস্তান শব্দটি ব্যবহার করতো পরম আদরে। এ দেশে পূর্ব বাংলা শ্রমিক আন্দোলন প্রথম রাজনৈতিক সংগঠন, যেখানে পূর্ব বাংলা নামটি ব্যবহার করা হয়। থিসিসের দ্বিতীয় বৈশিষ্ট্য হলো, পূর্ব বাংলাকে সরাসরি পাকিস্তানের উপনিবেশ বলা এবং উপনিবেশবাদের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের আহবান জানানো। তৃতীয় বৈশিষ্ট্য অন্যান্য কমিউনিস্ট পার্টি ও গ্ৰুপের বক্তব্যের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ - সর্বহারা শ্রেণির নেতৃত্বে সব দেশপ্রেমিক শ্রেণির ঐক্যবদ্ধ আন্দোলনের আহ্বান।

পূর্ব বাংলা শ্রমিক আন্দোলনের থিসিসে জাতীয় পতাকার প্রসঙ্গ আসে। এ নিয়ে দলের শীর্ষ নেতৃত্বের মধ্যে আলোচনা হয়। আলোচনায় অংশ নেন সিরাজ সিকদার, সামিউল্লাহ আজমী, আজমীর স্ত্রী খালেদা এবং রানা। সামিউল্লাহ ও খালেদার প্রস্তাব ছিল সবুজ জমিনের ওপর লাল বৃত্ত বসিয়ে পতাকা বানাতে হবে।

এ রকম সিদ্ধান্ত হলেও কোনো পতাকা তখনও বানানো হয়নি। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে পূর্ব বাংলা শ্রমিক আন্দোলনও সিরাজ সিকদারের নেতৃত্বে সেই যুদ্ধে যোগ দেয়। ২৩শে এপ্রিলের প্রচারপত্রে জাতীয় মুক্তিবাহিনী গঠনের আহ্বান ছিল। পরবর্তীতে ৩০শে এপ্রিল ঝালকাঠি, বানারীপাড়া, স্বরূপকাঠি ও কাউখালী থানার ৬২টি গ্রাম নিয়ে বিস্তৃত পেয়ারাবাগানে গঠিত হলো ‘জাতীয় মুক্তিবাহিনী’। সিরাজ সিকদার নিজেই প্রশিক্ষণের তত্ত্বাবধান করেন।

গেরিলাদের জন্য তৈরি হয় আচরণবিধি। মাওয়ের ‘যুদ্ধ ও রণনীতির সমস্যা’ নিবন্ধ থেকে হুবহু তুলে দেওয়া হয় আচরণবিধি, যা ছিল এ রকম:

১. সব কাজে আদেশ মেনে চলুন।
২. জনগণের কাছ থেকে একটি সুচ-সুতোও নেবেন না।
৩. দখল করা সব জিনিস ফেরত দিতে হবে।
মনোযোগ দেওয়ার আটটি ধারা:
১. ভদ্রভাবে কথা বলুন।
২. ন্যায্যমূল্যে কেনাবেচা করুন।
৩. ধার করা প্রতিটা জিনিস ফেরত দিন।
৪. কোন জিনিস নষ্ট করলে তার ক্ষতিপূরণ দিন।
৫. মানুষকে মারবেন না, গালমন্দ করবেন না।
৬. ফসল নষ্ট করবেন না।
৭. নারীর সঙ্গে অশোভন আচরণ করবেন না।
৮. যুদ্ধবন্দীর সঙ্গে খারাপ ব্যবহার করবেন না।

দেশ স্বাধীন হওয়ার পর সর্বহারা পার্টির একটা প্রচারণা ছিল - একাত্তরের ১৬ ডিসেম্বর পাকিস্তানের খপ্পর থেকে বেরিয়ে এসে বাংলাদেশ আবার ভারতের উপনিবেশ হয়ে গেছে। ১৯৭২ সালের মার্চ মাসে সর্বহারা পার্টির একটা দলিলে ‘ভারতীয় সম্প্রসারণবাদের সঙ্গে পূর্ব বাংলার জনগণের জাতীয় দ্বন্দ্ব’কে মৌলিক দ্বন্দ্ব আখ্যা দেওয়া হয়।

সেখানে আরো উল্লেখ করা হয় – ‘এ দ্বন্দ্ব সমাধানের পথ হচ্ছে সশস্ত্র জাতীয় বিপ্লবের মাধ্যমে ভারতীয় সম্প্রসারণবাদ ও তার পদলেহী কুকুর ছয় পাহাড়ের দালাল জাতীয় শত্রুদের খতম ও উৎখাত করা, বাংলাদেশ পুতুল সরকারকে উৎখাত করা, পূর্ব বাংলাকে ভারতীয় সম্প্রসারণবাদীদের ঔপনিবেশিক শৃঙ্খল থেকে মুক্ত ও স্বাধীন করা।’

পূর্ব বাংলা শ্রমিক আন্দোলনের প্রথম থিসিস প্রচারিত হয়েছিল ১৯৬৮ সালে। এটাই ছিল সিরাজ সিকদারের লেখা প্রথম প্রচারিত দলিল। থিসিসের নিচে দুটি স্লোগান ছিল - চেয়ারম্যান মাও দীর্ঘজীবী হন; মার্কসবাদ, লেনিনবাদ, মাও সে তুং চিন্তাধারা জিন্দাবাদ। চার বছর পর ইন্দিরা গান্ধীর উদ্দেশে লেখা প্রচারপত্রের শেষে দুটি স্লোগান যোগ হয় - পূর্ব বাংলার সর্বহারা পার্টি জিন্দাবাদ; কমরেড সিরাজ সিকদার জিন্দাবাদ। তার মানে, সিরাজ সিকদার নিজেকে একক নেতা হিসেবে তার দলে প্রতিষ্ঠা করেন এবং তার সহকর্মী ও অনুসারীরা এটা মেনে নেন।

এরপর সর্বহারা পার্টির জাতীয় ঐক্যের আহ্বান শুধুমাত্র বিবৃতির মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল। অন্য দলগুলোর নেতাদের সঙ্গে সর্বহারা পার্টির শীর্ষ নেতাদের ব্যক্তিগত যোগাযোগ বা বৈঠক হয়েছে বলে জানা যায় না।

১৯৭৩ সালের শুরু থেকে সর্বহারা পার্টি তার নিজস্ব সশস্ত্র বাহিনী গড়ে তোলার কাজ শুরু করে জোর কদমে। এর নাম দেওয়া হয় ‘দেশপ্রেমিক সশস্ত্র বাহিনী’। ১৯৭৩ সালের মাঝামাঝি থেকে সর্বহারা পার্টির কর্মীরা তাদের আক্রমণের গতি বাড়িয়ে দেয়। তাদের প্রধান লক্ষ্য জাতীয় শত্রু খতম। তেহাত্তরের জুলাই থেকে ডিসেম্বরের মধ্যে ১৪টি পুলিশ ফাঁড়ি, থানা ও ব্যাংকে হামলা চালানো হয়। জাতীয় শত্রু খতমের নামে সর্বহারা পার্টির লোকেরা সেই সময় যে কত মানুষ মেরেছে তার কোনো তালিকা নেই।

চুয়াত্তর সালে বিজয় দিবস সামনে রেখে সর্বহারা পার্টি ১৫ ও ১৬ ডিসেম্বর দুদিন হরতাল ডেকেছিল।
১৯৭৫ সালের ১লা জানুয়ারি চট্টগ্রামে গ্রেফতার হওয়ার পর সিরাজ সিকদারকে অতি দ্রুত ঢাকায় নিয়ে আসা হয়। প্রাথমিক হেফাজতেই তার ওপর চালানো হয় অত্যাচার। অত্যাচার করে কথা বের করতে না পেরে শুরু হয় কথোপকথন।

আপনি কি জানেন আপনার শেষ পরিণতি কী?

আমি জানি। একজন দেশপ্রেমিকের পরিণতি কি হতে পারে তা ভালোভাবেই জানা আছে আমার।
আমরা আপনাকে শেখ সাহেবের কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করতে বলবো। জাতীয় বিশ্বাসঘাতকের কাছে একজন দেশপ্রেমিক ক্ষমা চাইতে পারে না। তাহলে আপনাকে মৃত্যুবরণ করতে হবে। সে মৃত্যুই আমি গ্রহণ করব। সে মৃত্যু দেশের জন্য মৃত্যু, গৌরবের মৃত্যু।

সিরাজ সিকদারের মৃত্যুর খবরটি শুনে শেখ মুজিব রেগে যাননি, বরং বিচলিত হয়ে বলেছিলেন, ‘তোরা ওকে মেরে ফেললি!’ পঁচাত্তরের ২৫ জানুয়ারি জাতীয় সংসদে মুজিব বলেছিলেন, ‘কোথায় আজ সিরাজ সিকদার?’ মুজিব ঐদিন দেড় ঘণ্টা বক্তব্য দিয়েছিলেন। এক পর্যায়ে বলেছিলেন, ‘কোথায় আজ সিরাজ সিকদার?

তাকে যদি ধরা যায়, আর তার যে দলবল, তাদের যদি ধরা যায়, তাহলে ধরতে পারব না কোন অফিসে কে ঘুস খান? ধরতে পারব না কে অন্ধকারে বিদেশের থেকে পয়সা খান? ধরতে পারব না কোথায় পয়সা লুট করেন? ধরতে পারব না কোথায় করা হোর্ডার আছেন? ধরতে পারব না কারা ব্ল্যাক মার্কেটিয়ার আছেন? নিশ্চয় ধরতে পারব।’

বাংলাদেশে বিনা বিচারে বন্দি অবস্থায় ‘ক্রসফায়ারে’ নিহত প্রথম ব্যক্তি সিরাজ সিকদার। মৃত্যুর আগে সিকদারের নেতৃত্বাধীন সর্বহারা পার্টির কর্মকাণ্ড তৎকালীন শাসকদের মনে ভয় ঢুকিয়ে দিয়েছিল। জনমনে তৈরি হয়েছিল সিরাজ সিকদারের জন্য এক ধরনের শ্রদ্ধাবোধ। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক আহমদ শরীফকে সিরাজ সিকদারের মৃত্যু ভীষণভাবে নাড়া দিয়েছিল।

‘বিপ্লবী সিরাজ সিকদার’ নামে একটি প্রবন্ধে তিনি লিখেছিলেন, ‘সিরাজ সিকদার আজ আর কোন ব্যক্তির নাম নয়। সিরাজ সিকদার একটি সংকল্পের, একটি সংগ্রামের, একটি আদর্শের, একটি লক্ষ্যের ও ইতিহাসের একটি অধ্যায়ের নাম।’ মাত্র ৩০ বছর দুই মাস ছয়দিন বেঁচেছিলেন। এটুকু সময়ের মধ্যেই তিনি সরকারের কাছে হয়ে দাঁড়িয়েছিলেন ‘মোস্ট ওয়ান্টেড’। কেমন ছিল তার জীবনবোধ? তার উপলব্ধির কথা তিনি নিজেই লিখে গেছেন ‘জীবন’ কবিতায়:

‘কতগুলো সফলতা
কতগুলো ব্যর্থতা
কতগুলো যোগ্যতা
কতগুলো সীমাবদ্ধতা
কতগুলো ভালো
আর কতগুলো খারাপ
কতগুলো আনন্দ
কতগুলো বেদনা
কতগুলো দ্বন্দ্ব
কতগুলো সংঘাত
এই তো জীবন’

বইয়ের শেষে ‘ইতিহাসের এনাটমি’ অনুচ্ছেদে লেখক লিখেছেন, ‘সিরাজ সিকদার মেধাবী তরুণ, সিভিল ইঞ্জিনিয়ার গ্রাজুয়েট। ইচ্ছে হলেই বানিয়ে ফেলতে পারতেন একটা আকর্ষণীয় ক্যারিয়ার। হতে পারতেন চৌকস আমলা কিংবা অধ্যাপক। কিন্তু তিনি পা বাড়ালেন বিপদসংকুল পথে। সহযাত্রী হলো আরও অনেক তরুণ।

কী এক সম্মোহনী শক্তি দিয়ে তিনি এতগুলো মেধাবী মন জড়ো করতে পারলেন, তা এক রহস্য বটে। এমনটি বাংলাদেশে আর কোন দলের মধ্যে দেখা গেছে কি না সন্দেহ। বাংলাদেশের কোন রাজনৈতিক দলের শীর্ষ নেতা বিশ্ববিদ্যালয়ের পরীক্ষায় প্রথম শ্রেণিতে প্রথম হয়েছেন, এমনটি আর নেই।’

বিপ্লব আর সন্ত্রাস মুদ্রার এপিঠ-ওপিঠ। রাষ্ট্র যাদের সন্ত্রাসী বলে, তারা দাবি করেন তারা বিপ্লবী। সূর্য সেন থেকে সিরাজ সিকদার - এই পরিক্রমায় আছে হাজারো তরুণ। মানুষ কীভাবে তাদের মূল্যায়ন করবে? এটা নির্ভর করে যিনি দেখছেন তার দৃষ্টিভঙ্গির ওপর।

উর্দু ইংরেজির ভিড়ে প্রথমবারের মতো সম্পূর্ণ বাংলা শব্দ দিয়ে সিরাজ সিকদার এবং তার তরুণদল তৈরি করেছিলেন একটি রাজনৈতিক দল – ‘পূর্ব বাংলা শ্রমিক আন্দোলন’ পরবর্তীতে পূর্ব বাংলা সর্বহারা পার্টি। লেখায় ও স্লোগানে তারাই প্রথম উচ্চারণ করেছিলেন স্বাধীনতার কথা। তৈরি করেছিলেন রূপকল্প, একটি পতাকা। তারা যে প্রক্রিয়ায় ও পদ্ধতিতে পা বাড়ালেন, এখন সবাই তাকে একবাক্যে বলে 'সন্ত্রাসবাদ’?

লেখাটা শেষ করতে চাই ‘পূর্ব বাংলা সর্বহারা’ পার্টির অন্যতম অবাঙালি সদস্য সামিউল্লাহ আজমীর প্রিয় গানটির চরণগুলো দিয়ে। লেখকও এই বইটির উৎসর্গ পত্রে এই গানটির উল্লেখ করেছেন -
‘মুক্তির মন্দির সোপানতলে
কত প্রাণ হলো বলিদান
লেখা আছে অশ্রুজলে।’

এমআরএম/এমএস

প্রবাস জীবনের অভিজ্ঞতা, ভ্রমণ, গল্প-আড্ডা, আনন্দ-বেদনা, অনুভূতি, স্বদেশের স্মৃতিচারণ, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক লেখা পাঠাতে পারেন। ছবিসহ লেখা পাঠানোর ঠিকানা - [email protected]