শাঁখের করাত

মাথায় আকাশ ভেঙে পড়লো

শায়লা জাবীন
শায়লা জাবীন শায়লা জাবীন মেলবোর্ন, অস্ট্রেলিয়া
প্রকাশিত: ০৭:২৮ পিএম, ১০ অক্টোবর ২০২২
ছবি-সংগৃহীত

হ্যালো ম্যাম, আমি ইফতি। আজ ছুটি নিয়ে আপনার সঙ্গে কথা বলতে এসেছি, আমি প্রায়শই অসুস্থ হয়ে যাচ্ছি। হাই ব্লাড প্রেসার, কোলেস্টেরল হাই, সুগার লেভেল বর্ডারে, লিভার এনলার্জ করেছে। চুল সব পেকে যাচ্ছে, হুটহাট রেগে যাচ্ছি... কিছুতেই রাগ কন্ট্রোলা করতে পারছি না, আর কত।

সব কিছুরই তো একটা সীমা আছে, শরীর খারাপ হয়ে যাচ্ছে কিন্তু আমি তো জানি সমস্যা আসলে কোথায়। তাই আমার জিপি আপনার কাছে রেফার করলেন, এখন যদি আপনি আমার কথা শুনে একটা উপায় বলেন।

পারিজাত রহমান তাকিয়ে রয়েছেন সামনে বসা ক্লায়েন্টের দিকে। নাম ইফতেখার আহমেদ, বয়স প্রায় ৪১ হবে। মাঝারি উচ্চতা, মাঝারি স্বাস্থ্য, একটা পোলো টিশার্ট পরে। ৮ বছরের বিবাহিত জীবন, বাংলাদেশে ৫ বছর কেটেছে, অস্ট্রেলিয়াতে ৩ বছর, স্কিল মাইগ্রেশন নিয়ে এসেছেন। এখন সরকারি চাকরি করেন, তার স্ত্রী হোম মেকার, একটা বাচ্চা, বয়স ৪ বছর। তাকে ডাকার আগে ফাইলে এসব তথ্য পেয়েছেন।

জ্বি বলুন, আপনাকে আমি কীভাবে সাহায্য করতে পারি...

ছাত্র থাকাকালীন একটা মেয়েকে পছন্দ করতাম, মেয়েটাও হয়তো আমাকে পছন্দই করতো। মাঝে মাঝে কথা হতো ফোনে, কখনো দেখা করতাম কোনো ক্যাফেতে বা ক্যাম্পাসে, যদিও দু’জন আলাদা দুই প্রতিষ্ঠানে পড়তাম। মেয়েটির নাম ঈশিতা।

এভাবেই দু’বছর কেটে গেলো। তৃতীয় বছরে ঈশিতা জানালো তাদের বাসায় তার জন্য পাত্র দেখছে। সে তার বাবা-মার কথার বাইরে যেতে পারবে না। তার বাবা-মা আমাকে কোনোভাবেই মেনে নেবে না। যেহেতু আমি তখনো ছাত্র, কিছুই করি না।

বললাম, চলো পালিয়ে বিয়ে করি...

ঈশিতা কোনোভাবেই রাজি না, বলে বাবা-মা কষ্ট পাবেন অনেক।

বললাম, তুমি শক্ত থাকো, বিয়েতে রাজি হয়ো না, বাসায় বলো পড়াশোনা শেষ করে বিয়ে করবা।

ঈশিতা চুপচাপ শুনলো, বললো দেখি...

এভাবেই আরও কিছু মাস গেলো, চিন্তায় ঠিকমতো পড়াশোনা করতে পারি না, চাকরি খোজা শুরু করলাম।

এরই মধ্যে একদিন দেখি ঈশিতার কোনো খোঁজ পাই না, ফোন করলে বন্ধ পাই। দু’দিন পর একটা অজানা নম্বর থেকে একটা অচেনা মেয়ে কণ্ঠ, ফোন করে বললো ঈশিতার বিয়ে হয়ে গেছে। আমি যেন আর যোগাযোগ করার চেষ্টা না করি।

ঘটনার আকস্মিকতায় এত বেশি মুশড়ে পরলাম যে আমি খুবই অসুস্থ হয়ে গিয়েছিলাম, বাসায় দরজা বন্ধ করে বসে থাকি। কারও সঙ্গে কথা বলি না। খাওয়া-দাওয়া করতে পারি না, ওজন কমে গেলো। বড় বোন, ছোট ভাই অনেকে বেশ বোঝালো, বাবা-মা ভীষণ দুশ্চিন্তায়।

চিকিৎসক দেখালেন, ওই বছর অনার্স ফাইনাল ছিল, দিতে পারিনি। বছর খানেক পুরো মাথা এলোমেলো ছিল। মনে হতো ঈশিতা কেন আমাকে একবার বললো না? নাকি ওকে জোর করে বিয়ে দিলো।

এভাবেও সময় কেটে গেলো, পরের বছর অনার্স দিলাম, এরপর একটা সময় মাস্টার্স...

দিবাস্বপ্ন দেখতাম, একদিন হুট করে ঈশিতা চলে আসবে আমার কাছে!

কিন্তু না, সেই যে হাওয়া... আর সে নেই কোথাও। দেশে না বিদেশে তাও জানি না।

আচ্ছা, দুঃখজনক তারপর...

এরপর চাকরিতে ঢুকলাম, ততদিনে আমার বোনের বিয়ে হয়েছে। আমার ভাই আর আমি পিঠাপিঠি, আমিই বড়। বাসায় সবাই বিয়ের কথা বলে, আমার একটুও মন টানে না, খাই, ঘুমাই, অফিসে যাই।

একদিন বাবা-মা খাওয়ার টেবিলে বললেন, বুঝলাম তোমার জীবনের একটা অনাকাঙ্খিত কষ্টের সময় গেছে। তাই বলে তো তুমি এটা নিয়ে সারা জীবন বসে থাকবে না। মেয়েটার তো কোনো খোঁজ নেই। হয়তো ফ্যামিলির চাপে বিয়ে করেছে। তাই আর যোগাযোগ রাখেনি, তুমি এখন চাকরি করছো, বিয়ে করো। তোমার পরে আরও একজন আছে বিয়ের।

আমি বাবা-মা’কে বললাম ছোট ভাইকে বিয়ে দিতে। আমি তখনো বিয়ের জন্য ঠিক প্রস্তুত না, আমার ছোট ভাইয়ের পছন্দ ছিলো। এর প্রায় আরও এক বছর পরে আমার ছোট ভাইও বিয়ে করে ফেললো।

আমার কোথাও কোনো সমস্যা নাই, আমি ভালোই ছিলাম একা, কিন্তু এবার আমার আম্মা রোজ রাতে আমার ঘরে এসে কান্নাকাটি শুরু করলো, সে আর কয়দিন বাঁচবে।

আমার বউ দেখে মরতে চায়...

আমি একদম চুপ, মনের ভেতরে কাউকেই বসাতে পারছি না, বন্ধু-বান্ধবরাও বোঝানো শুরু করলো, সবাই পাত্রী দেখা শুরু করলো।

আমি ছবি দেখি আর চুপচাপ না বলি...

একদিন অফিসের ডাইনিংয়ে বসে লাঞ্চ করছি, একটা মেয়ে এসে পাশের খালি চেয়ার দেখিয়ে বললো সে কি বসতে পারে কিনা, আগে দেখিনি কখনো। উজ্জ্বল শ্যামলা গোলগাল চেহারার, চেহারায় একটা মিষ্টি ভাব আছে, চকদুটো বেশ চটপটে, বললাম বসুন।

বসতে বসতে বললো সে কাস্টমার কেয়ার ডিপার্টমেন্টে নতুন জয়েন করেছে তিনদিন হলো। লাঞ্চ টাইম সবখানে ভিড়। কোথাও জায়গা পাচ্ছিল না বসার।

বললো তার নাম রিমি, আপনার?

আমি বললাম বসুন কোনো সমস্যা নেই, আমার নাম ইফতি।

এরপর থেকে প্রায়শই রিমি লাঞ্চ করতে আমার টেবিলে বসতে লাগলো। আর অনুমতি চাইতো না, বসেই কথা বলা শুরু করতো, বেশিরভাগ তার বাসার কথা, কখনো অফিসের।

একদিন কথা প্রসঙ্গে বললো তার বাবা নাই, অনেক ছোটবেলায় মারা গেছেন, তার মা অনেক কষ্ট করে তাদেরকে বড় করেছেন। তারা তিনবোন একভাই। বড় বোনের বিয়ে হয়েছে, সে মেঝো। বাকি ভাই বোন ছোট। তারা পড়াশোনা করছে।

আমাকেও জিজ্ঞাসা করতো আমার বাসায় কে কে আছে? কোন বিভাগে চাকরি করি, কতদিন?

একদিন কথা প্রসঙ্গে জিজ্ঞাসা করে বসলো, আমি এখনো বিয়ে করিনি কেন?

আমি একটু বিব্রত এবং বিরক্ত হলাম মনে মনে, এত ব্যক্তিগত প্রশ্ন কেউ করে?

মনে হয় বুঝতে পারলো, সঙ্গে সঙ্গে বললো আপনি বলতে না চাইলে থাক। আপনার তার মানে পছন্দ আছে কেউ।

আমি কিছুই বললাম না...

সে তার বড়বোনের মেয়ের জন্মদিনের দাওয়াত দিলো আমার বাবা-মাসহ এবং তাদের সঙ্গে কথা বলার জন্য আমার মোবাইল নম্বর চাইলো।

বললাম, আমার মা-বাবা’কে বলতে হবে না, তারা যাবেন না, আমি আসবো।

সে তবুও ফোন নম্বর চাইলো, বললো আসুক না আসুক, সে বলতে চায়।

আমি আমার মোবাইল নম্বর দিলাম...

সে তার নম্বর থেকে আমাকে মিসড কল দিয়ে সেভ করে রাখতে বললো।

আমার মা সব শুনে উল্টা আমাকেই জেরা, এই মেয়ে কে?

ভালো লাগলে বিয়ে কর... ইত্যাদি

আমি বললাম, সে রকম কিছু না। জাস্ট! অফিস কলিগ।

দুইদিন পর আমার ভাই-বোনও বিষয়টা নিয়ে খোঁচানো শুরু করলো।

এদিকে ফোন নম্বর পাওয়ার পরে রিমি প্রায়ই ম্যাসেজ করতো কি করছি এসব, মাঝে মাঝে রাতে ফোন দিত।

আমি যেহেতু একা তাই হয়তো কথা বলতাম...

তবে বলতাম কম, শুনতাম বেশি।

একদিন রিমি কথা প্রসঙ্গে বললো, তার ভাগ্নির জন্মদিনে যেন যাই, আর আমার বিয়ের দাওয়াত যেন দেই।

বললাম যাব, আর আমার বিয়ে তো ঠিক হয়নি, হলে অবশ্যই দাওয়াত দেব।

শুনে দেখি সে একদমই চুপ, এরপর বললো সে তো এতিম, তারপরে এবার গরিব। তার তো কোনোদিন বিয়েই হবে না। এখনকার ছেলেরা সবাই ধনী বাবার-মেয়ে খোঁজে।

আমি সকালে অফিস আছে বলে ফোন রাখলাম। পরের সপ্তাহে রিমির ভাগ্নির জন্মদিনে গেলাম, সে সবার সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিলো, তার মা, বড় বোন, দুলাভাই, ছোট ভাইবোন। আমার অনেক যত্ন নিলো সবাই।

আসার সময় রিমির মা আমার কাছে এসে বললো, বাবা-আমার একটা উপকার করো। বাপ মরা মেয়ে, তুমি একটা ভালো দেখে ছেলে খুঁজে দাও রিমির জন্য। খুবই উপকার হয়, রিমি তো নিজেই চাকরি করে, নিজেরটা নিজেই দেখবে শুধু একটা ভালো ছেলে দরকার।

আমি আচ্ছা, দেখবো বলে বিদায় নিয়ে চলে আসলাম...

রিমিদের আর্থিক অবস্থা আমাদের মতো স্বচ্ছল নয়, যেটা খুবই স্বাভাবিক কারণ ছোট-বেলায় বাবা মারা গেছেন, ওই দিন প্রথম মেয়েটার জন্য খারাপ লাগলো। আমাদের সমাজে বাবা ছাড়া মেয়েরা পড়াশোনা করেও কত অসহায়।

এই ঘটনার তিনমাস পর আমার মা আমাকে বললো, রিমি মেয়েটাকে আমার কেমন লাগে? সে নাকি প্রায়ই ফোন করে আমার আম্মার সাথে কথা বলে!

নম্বর কীভাবে পেলো জানি না, আম্মার জোরাজুরি শুরু হলো,পছন্দ হলে বিয়ে কর।

আমি অনেক কিছু চিন্তা করলাম, ভাবলাম বিয়ে যদি করতেই হয় মেয়েটা এতিম, অবস্থাও ভালো না। খুবই আগ্রহ আমার প্রতি, আমাদের পরিবারের প্রতি আচ্ছা একেই করি, আমার তো অন্যকোনো পছন্দ ছিল না।

আরও তিনমাস পর আমাদের বিয়ে হয়ে গেলো। বাসায় সবাই রাজি, আমার বড় বোনের স্বামী একটু দ্বিমত করেছিল, তিনি বললেন বাবা ছাড়া বড় হওয়া মেয়েরা অতিরিক্ত ফার্স্ট হয়, আর একটু চিন্তা করো, তার কথা খুবই টিপিক্যাল এবং রক্ষনশীল মনে হলো আমার কাছে, তবে বয়সে বড় বিধায় মুখে কিছু বললাম না।

বিয়ের পর ছয়মাস হাওয়ায় উড়ে গেলো, আমরা কক্সবাজার গেলাম, রিমি আগের চেয়েও বেশি কথা বলা শুরু করলো কিন্তু সব আমাদের পরিবারকেন্দ্রিক গল্প।

এরপর বিয়ের এক বছর, এরই মধ্যে রিমি খুবই ঘনঘন ওদের বাসায় যেতো, তার মা ও ছোট ভাই-বোনকে খরচের টাকা দিত মাসে মাসে, আমি কোনোদিন কিছু বলিনি।

ঈদ বা কোনো উৎসব হলে আমিও দিতাম...

এর মাঝে একদিন দেখি বাসায় কিছু ছোট ছোট জিনিস নাই, যেমন আমার একটা টাই, পারফিউম। আমার আম্মা বলছে শোকেস থেকে নাকি চামচের সেট নাই, আমার ছোটভাই সিঙ্গাপুর বেড়াতে গিয়ে আম্মার জন্য এনেছিল।

আমার ছোট ভাইয়ের বউ তিশা নাকি আম্মাকে বলেছে তার ডায়মন্ডের আংটি পায় না, তার ঘরের ড্রেসিং টেবিলের গহনার বাক্সে ছিল, আমার বড়বোন বললো আমরা তার বাসা থেকে আসার পর নাকি সে তার কাশ্মীরি শাল পাচ্ছে না, ওই দিন বলে বুয়া ও আসেনি।

রিমি সব শুনে চুপচাপ থাকলো, বললো আছে হয়তো কোথাও, পরদিন রিমি অফিসে গেলো না...

শরীর খারাপ বললো।

আমি একাই গেলাম, ওই দিন দুপুরে রিমির বড় দুলাভাই দেখা করতে এলেন, বললেন এদিক একটা কাজে এসেছিল, আমি দেখলাম তার গলায় আমার হারিয়ে যাওয়া টাই!

রিমি টেক্সট করে জানালো, সে তার মায়ের বাসায় গেছে, ফেরার পথে যেন নিয়ে যাই।

রিমিকে আনতে গিয়ে দেখি, আমার শাশুড়ি ঝলমলে মুখ করে বললেন, রিমি বাথরুমে বসো বাবা...

আল্লাহ তোমাদের ভালো করুক।

রিমি আমাকে এই হীরার আংটি কিনে দিয়েছে, বললো মা তুমি জীবনে অনেক কষ্ট করেছো, এটা তোমার প্রাপ্য।

আমি কখনো ভাবি নাই আমি হীরার আংটি হাতে পরবো, এমন মেয়ে পাওয়া ভাগ্যের ব্যাপার।

আমি চুপচাপ রিমিকে নিয়ে বাসায় এলাম, কিছুই বললাম না রাস্তায়, রিমি হাত পা নেড়ে চেড়ে গল্প করতে লাগলো।

পারিজাত রহমান বললেন ওহো, মনে তো হচ্ছে ক্লেপটোম্যানিয়া...

জ্বি, আমার মাথায় আকাশ ভেঙে পড়লো। আমি যা বোঝার তা বুঝে গেলাম। শুধু বুঝতে পারছিলাম না, রিমিকে কীভাবে বলবো, আর সে কি রি-অ্যাক্ট করবে...

এরপর আরও কিছু জিনিস হারিয়ে গেলো...

এমআরএম/জেআইএম

প্রবাস জীবনের অভিজ্ঞতা, ভ্রমণ, গল্প-আড্ডা, আনন্দ-বেদনা, অনুভূতি, স্বদেশের স্মৃতিচারণ, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক লেখা পাঠাতে পারেন। ছবিসহ লেখা পাঠানোর ঠিকানা - [email protected]