এদেশে প্রতিষ্ঠিত হওয়ার চেয়ে লাউ চাষ করা কঠিন
বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার আগে পূর্ব পাকিস্তানের মানুষ খুব বেশি দেশ ছাড়েনি যেমনটি দেশ স্বাধীন হওয়ার পর থেকে ঘটে চলেছে। অনেকেই বলবে পাসপোর্ট থেকে শুরু করে ভিসা জোগাড় করা একটি জটিল পদ্ধতি ছিল তখন যার ফলে দেশ ছাড়ার ইচ্ছে থাকা সত্ত্বেও সম্ভব হয়ে ওঠেনি। ঘটনার কিছুটা সত্য হলেও কিন্তু দেখা যায় সিলেটিরা সব সময় দেশ-বিদেশ ঘুরছে।
তৎকালীন ১৯টি জেলার মধ্যে যশোরের মানুষ দেশ ছেড়েছে দেরি করে। তবে, এ জেলার অনেক হিন্দু সম্প্রদায় ভারতের কলকাতা আশা যাওয়া রীতিমত বজায় রেখে আসছে নানা কারণে। আমার পরিবার মূলত বাংলাদেশ ছেড়েছে দেশ স্বাধীনের পর স্কলারশিপ ও বাইরে লেখাপড়া করার সুযোগ হওয়ায়।
নিজ দেশ ছেড়ে অন্য একটি দেশে এসে সবকিছু গুছিয়ে উঠতে কয়েক যুগ লাগার পেছনে শত শত কারণ জড়িত যেমন বাংলা খাবার এবং দেশীয় শাক সবজি। যদিও মাঝে মধ্যে এসব খাবার পাওয়া যায় তবে দুঃখের বিষয় ভেজাল এবং পচা খাবার দেশ থেকে বেকসুর খালাস হয়ে বিদেশে আসে এবং সেই খাবার যখন দশগুণ বেশি দাম দিয়ে কিনি এবং রান্না করে মুখে দিতে চেষ্টা করি তখন স্বাদের পরিবর্তে বমি আসে।
চেষ্টা করছি দেশীয় শাক সবজি নিজে চাষ করতে সুইডেনের মতো শীতের দেশে। মজার ব্যাপার হলো সাধনা এবং চেষ্টা থাকলে কিনা সম্ভব জীবনে? সেটাই হয়েছে। সব সবজির মাঝে লাউ বাঙালির কাছে একটি অমৃত খাবার সেটাও সুইডেনে ফলানো, আমার কাছে এতবড় একটি চ্যালেঞ্জ ছিল যা যদি তুলনা করি সুইডেনে প্রতিষ্ঠিত হওয়ার চেয়ে কঠিন।
হয়তো অনেকের কাছে বিশ্বাসযোগ্য হবে না কিন্তু এটাই সত্য। শীতের দেশে লাউ উৎপাদন করা সত্যিই একটি বড় চ্যালেঞ্জ ছিল। তাহলে বুঝতেই পারছেন কী পরিমাণ চেষ্টা করতে হয়েছে সফল হতে। পরাগায়ন করাতে চেষ্টা করেছি, নিজ হাতে পুরুষ ফুলকে নারী ফুলের সঙ্গে যুক্ত করেছি যাতে করে পরাগায়ন পদ্ধতিটি সঠিক হয় যেমনটি মৌমাছি বা বাতাসের সাহায্যে হয়ে থাকে।
এভাবে এক দেশে থেকে অন্য দেশে যেমন আমরা এসেছি, নিজেদের মানিয়ে নিয়েছি। এখন আমাদের দেশের সব কিছু আস্তে আস্তে এখানে এনে ছোট্ট একটি বাংলাদেশ গড়ে তোলার চেষ্টা এর চেয়ে বড় কিছু আর কি হতে পারে? এসব চেষ্টা করার পথে দেশের কথা নতুন প্রজন্মের কথা মনে হয়েছে। মনে হয়েছে সাধারণ পরিবারে জন্ম নেওয়া অনেক তরুণের কথা।
ফুলের মতো অনেক প্রাণ অকালে ঝরে পড়ছে সামান্য একটু সুযোগের অভাবে। ফুল যেমন তার সব সুযোগ থাকতেও একটু সাহায্যের অভাবে পরাগায়ন ঘটাতে না পারার কারণে ফলে পরিণত হতে পারছে না, ঠিক একটি গরিব পরিবারের অনেকেই একটু সুযোগ, একটু চেষ্টার অভাবে সফল মানুষ হয়ে সমাজের দায়িত্ব পালনের পরিবর্তে সমাজের বোঝা হয়ে ধুঁকে ধুঁকে মরছে!
আমরা যারা সুযোগ পেয়েছি তাদের অগত্ব উচিত হবে যারা সে সুযোগ থেকে বঞ্চিত তাদের একটু সাহায্য করা। একটু সাহায্য সহানুভূতি পেলে একটি জীবন সুন্দর হয়ে সমাজের কাছে, সমাজের মানুষের কাছে সর্বোপরি নিজের কাছে তার জন্মের স্বার্থকতা খুঁজে পেতে পারে। এতটুকু চেষ্টা যদি আমরা করি অবশ্যই সম্ভব চাওয়া পাওয়ার সফলতা ঘটানো।
আমার সুইডেনের ক্ষেতে সবকিছু হয়েছে। দুঃখের বিষয় হঠাৎ ঠান্ডা আবহাওয়ার কারণে একের পর এক সব শাক সবজি এখন প্রায় মৃত্যু পথের যাত্রী। ভাবছি একদিন আমাদেরও এই সাজানো গোছানো জীবনটা হঠাৎ শেষ হয়ে যাবে তখন মন চাইলেও কারো জন্য কিছু করতে পারব না। ভাবছি সেই সময়টি যখন এখনও আসেনি এবং সুযোগ যখন আছে তখন দেরি কেন?
এখনই আমরা কিছু একটা করি। আমার মতো যদি সবাই একটু চেষ্টা করে আমি বিশ্বাস করি আগামী দশ বছরে বাংলাদেশে একজন গরিব অসহায় শিশুর জন্ম হবে না, শুধু যদি একটু চেষ্টা করি সবাই। ট্যুগেদার, উই ক্যান মেক ইট হ্যাপেন।
লেখক: রহমান মৃধা, সাবেক পরিচালক (প্রোডাকশন অ্যান্ড সাপ্লাই চেইন ম্যানেজমেন্ট), ফাইজার, সুইডেন থেকে, [email protected]
এমআরএম/এমএস