সুইডেন-ন্যাটো ও বিশ্ব রাজনীতি
মাথায় কত প্রশ্ন আসে দিচ্ছে না কেউ জবাব তার। জবাব কীভাবে দেবে যদি সঠিক উত্তর জানা না থাকে? মিডিয়া, গণমাধ্যম কী সবসময় সঠিক খবর দিতে পারে? উত্তর হ্যাঁ বা না হতে পারে। গোটা বিশ্ব জানে সুইডেন সামরিকভাবে নিরপেক্ষ দেশ। শুধু কি তাই? যদি বলি দুইশো বছর আগ থেকেই নিরপেক্ষ ভূমিকা পালন করে চলছে, বিশ্বের অনেকের মতো সাধারণ সুইডিশরাও সেটাই বলবে।
কিন্তু না, সময় সুযোগ বুঝে সুইডেন অনেক বারই ঝোপ বুঝে কোপ মেরেছে বিশ্ব পলিটিক্সে। একটি উদাহরণ হয়তো অনেকেরই মনে পড়বে যেমন ভিয়েতনাম যুদ্ধে তৎকালীন সুইডিশ প্রধানমন্ত্রী ওলোপ পালমে কড়া প্রতিবাদ করেছে আমেরিকা যখন ভিয়েতনাম আক্রমণ করে। আজ থেকে দুইশো বছর আগে নর্ডিক রেজিওনে সুইডেনের দাপট ছিল অনেকটা বিশ বছর আগের সোভিয়েত ইউনিয়নের মতো।
সময়ের সাথে পরিবর্তন ও পরিবর্ধন সুইডেনকে বাধ্য করেছে লেজ গুটিয়ে ঘরে ফিরে আসতে, যেমনটি দেখতে পারছে গোটা বিশ্ব সোভিয়েত ইউনিয়নের পতন এবং রাশিয়ার দাপটের হ্রাস যা দেখলে মনে করিয়ে দেয় সুইডেনের অতীত এবং বর্তমানকে। সহজ করে বলি বর্তমান রাশিয়ার ইতিহাস অতীতের সুইডেনের প্রতিচ্ছবি।
তবে হঠাৎ কেন সুইডেন ন্যাটোতে যোগ দিতে উঠেপড়ে লাগলো এটাই এখন সবাই জানতে চায়! যদি ‘দি লং স্টোরি শর্ট করি’ তবে বলবো রাশিয়ার হঠাৎ ইউক্রেন আক্রমণই মূলত কারণ। সুইডেন ন্যাটোতে যোগ না দিয়ে পরোক্ষভাবে বা স্যাড়ো টিমে থেকে ইউক্রেন যুদ্ধে যে সাপোর্ট দিয়েছে, সেটা রাশিয়াসহ গোটা বিশ্বের নজর কেড়েছে। সুইডেন ২০১৪ সাল থেকে ইউক্রেনকে নানাভাবে সাহায্য করে আসছে।
ইউক্রেনে যুদ্ধ শুরুর আগে ফিনল্যান্ডের ৫৩ শতাংশ ও সুইডেনের ৪১ শতাংশ মানুষ ন্যাটোতে যোগ দেওয়ার পক্ষে ছিল বলে জরিপে দেখা যায়। তবে সাম্প্রতিক জরিপে সুইডেনে ন্যাটোতে যোগদানের পক্ষে জনমত ৫০ শতাংশের বেশি হয়েছে। আর ফিনল্যান্ডে এই হার আরো বেশি।
ন্যাটোতে আনুষ্ঠানিকভাবে যোগ না দিলেও অনেক আগে থেকেই জোটটির সঙ্গে কাজ করছে ফিনল্যান্ড ও সুইডেনের সেনাবাহিনী। আফগানিস্তানের ন্যাটোর নেতৃত্বাধীন অভিযানে অংশ নিয়েছিলেন দেশ দুটির সেনাসদস্যরা। দুই দেশই সামরিক সরঞ্জাম ও প্রশিক্ষণের বিষয়ে ২০১৫ সাল থেকে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে কাজ করছে। হঠাৎ রাশিয়ার ইউক্রেন আক্রমণ সুইডেনকে পরোক্ষভাবে আক্রমণ করেছে এমনটি মনোভাব পুরো সুইডিশ জাতির।
এমতাবস্থায় সুইডেন অ্যালিয়ান্স ফ্রি অবস্থায় থেকে ইউক্রেনকে শতভাগ সাহায্য করতে পারছে না বিধায় যৌথভাবে শত্রুর মোকাবিলা এবং গণতন্ত্রের মূলমন্ত্র ব্যক্তি ও বাঁক-স্বাধীনতার প্রতি রেসপেক্ট দেখাতে ‘ওয়াক অ্যাজ ইউ টক কনসেপ্ট’ ব্যবহার করলো। কথায় বলে ট্রুথ হার্টস যা অনেক সুইডিশকে যন্ত্রণা দিলেও সুইডিশ জাতি তাদের অতীতের ট্রেডিশন ভেঙ্গে সরাসরি বিশ্ব পলিটিক্সে যোগদান করলো।
বিষয়টি হয়েছে অনেকটা বাংলাদেশের মতো, বাংলাদেশে অনেকেই সবসময় সরকারের দল করে কারণ তাদের মতে সরাসরি কোনো পার্টির সাপোর্টার না হয়ে বরং সব সময় ‘সরকার পার্টি’ করাই নিরাপদ ও লাভজনক যা সুইডেন এত বছর ধরে করে এসেছে। দুইশো বছর পর সময়, চাপ এবং তাপ সুইডেনকে ‘সরকার পার্টি’ ছেড়ে সরাসরি বিশ্ব পলেটিক্সে যোগ দিতে বাধ্য করলো। Today will be yesterday, tomorrow and tomorrow will never die — সুতরাং সুইডেন তার মনের গভীরে ‘নেভার অ্যালোন, আলওয়েজ অ্যালোন কনসেপ্ট’ থেকে শিক্ষণীয় অভিজ্ঞতার হাত ধরে নতুন জার্নি শুরু করলো।
এদিকে হঠাৎ সুইডেন ও ফিনল্যান্ডের ন্যাটোতে যোগদানের পরিকল্পনা সমর্থন করছে না তুরস্ক। দেশটির প্রেসিডেন্ট রিসেপ তাইয়েপ এরদোয়ান এ কথা সাফ জানিয়ে দিয়েছেন। মূলত যে ৩০টি দেশ বর্তমান ন্যাটোতে রয়েছে তুরস্ক তার মধ্যে একটি, সেক্ষেত্রে তুরস্কের ভেটো দেওয়ার অধিকার রয়েছে। এটা করার পেছনে তুরস্কের অনেক উদ্দেশ্য রয়েছে। শুক্রবার ইস্তাম্বুলে সাংবাদিকদের সঙ্গে আলাপে তুরস্কের প্রেসিডেন্ট বলেন, ‘স্ক্যান্ডিনেভিয়ান অঞ্চল সন্ত্রাসী সংগঠনগুলোর অতিথিশালা। এ পরিস্থিতিতে আমরা তাদের ন্যাটোতে যোগ দেওয়ার পরিকল্পনা সমর্থন করতে পারি না।’
তবে তিনি বলেননি যে এসব সন্ত্রাসীকে বা কারা তৈরি করেছে এবং কেনই বা তারা তাদের নিজ দেশ ছেড়ে (তুরস্ক তার মধ্যে অন্যতম) সুইডেন, ফিনল্যান্ডসহ স্ক্যান্ডিনেভিয়ান অঞ্চলে আশ্রিত হয়েছে! এখন দেখা যাক পরবর্তী পদক্ষেপগুলো কোথায় গিয়ে থামে!
রহমান মৃধা, সাবেক পরিচালক (প্রোডাকশন অ্যান্ড সাপ্লাই চেইন ম্যানেজমেন্ট), ফাইজার, সুইডেন। [email protected]
এমআরএম/জেআইএম