চড়ুইভাতি

রহমান মৃধা
রহমান মৃধা রহমান মৃধা
প্রকাশিত: ০৪:০৭ পিএম, ২২ মার্চ ২০২২
ছবি: সংগৃহীত

মনে কি পড়ে বহু বছর আগের একটি ছড়া কবিতার কথা? নুরু, পুশি, আয়েশা, শফি সবাই এসেছে/আম বাগিচার তলায় যেন তারা হেসেছে। রাঁধুনিদের শখের রাঁধার পড়ে গেছে ধুম, বৈশাখ মাসের এই দুপুরে নাইকো কারো ঘুম। বাপ-মা তাদের ঘুমিয়ে আছে এই সুবিধা পেয়ে, বনভোজনে মিলেছে আজ দুষ্টু কটি মেয়ে।

বসে গেছে সবাই আজি বিপুল আয়োজনে, ব্যস্ত সবাই আজকে তারা ভোজের নিমন্ত্রণে। কেউবা বসে হলদি বাটে কেউবা রাঁধে ভাত, কেউবা বলে ধুত্তুরি ছাই পুড়েই গেলো হাত। বিনা আগুন দিয়েই তাদের হচ্ছে যদিও রাঁধা, তবু সবার দুই চোখেতে ধোঁয়া লেগেই কাঁদা। কোর্মা পোলাও কেউবা রাঁধে, কেউবা চাখে নুন, অকারণে বারে বারে হেসেই বা কেউ খুন। রান্না তাদের শেষ হলো যেই, গিন্নী হল নুরু, এক লাইনে সবাই বসে করলে খাওয়া শুরু। ধূলোবালির কোর্মা-পোলাও আর সে কাঁদার পিঠে, মিছিমিছি খেয়ে সবাই, বলে- বেজায় মিঠে। এমন সময় হঠাৎ আমি যেই পড়েছি এসে, পালিয়ে গেল দুষ্টুরা সব খিলখিলিয়ে হেসে।

আজও মনে পড়ে ছোট বেলার ফেলে আশা দিনগুলোর কথা। শুধু যে ধূলোবালির কোর্মা-পোলাও রান্না করেছি তা নয়, বন্ধুরা মিলে সত্যিকার বনভোজন করেছি অনেক বার জীবনে। বাড়িতে মজার মজার খাবার খেয়েছি তারপরও রাতের আঁধারে বন্ধুরা মিলে হাঁস, মুরগী বা মোরগ রান্না করা নিরিবিলি জায়গায়, তারপর কলার পাতায় একত্রে বসে বন্ধুরা মিলে বনে বসে ভোজন করা ছিল সত্যিই মধুময় সময়।

প্রায় চল্লিশ বছর আগের দিনের স্মৃতিচারণে ফিরে এসেছি। তখন রাজধানী ঢাকা থেকে শুরু করে বিভাগ-জেলা-মহকুমা এমনকি গ্রামগঞ্জ পর্যন্ত পিকনিকের প্রীতিপ্রদ উৎসব বেশ চালু ছিল। বনভোজনের ঋতু ছিল শীতের সময়। শীত ঠিকমতো না পড়তেই শুরু হয়ে যেত বনভোজন। আমার জন্ম গ্রামে, গ্রাম ছেড়েছি ১৯৮৩-তে। জ্ঞান হওয়ার পর থেকে দেখেছি শীত শুধু গ্রামবাংলার মানুষের প্রিয় ঋতুই নয়, উৎসবেরও ঋতু। ঘরে ঘরে নতুন গুড়ের পিঠা নানা নামের, নানান ধাঁচের।

নতুন গুড়ের নাড়ু, পায়েস, খেজুরের রসের সঙ্গে ঘন দুধে ভেজানো ঢেঁকিছাঁটা চালের চিতই পিঠা। ময়রার দোকানে নতুন গুড়ের বাতাসা, কদমা, খোরমা ইত্যাদি ছিল প্রিয় খাবার। গ্রামের মানুষের পায়ে তখন জুতা-স্যান্ডেল ছিল না। কাঁপুনি শীতে খড় জালিয়ে গোল হয়ে বসে আগুন পোহানোর মধ্য দিয়ে সময় কাটানো, মাঠ থেকে ছোলা গাছ পুড়িয়ে ছাই থেকে ছোলা কুড়িয়ে কুড়িয়ে খাওয়া বনভোজনেরই একটি অংশ ছিল তখন। ছোটবেলার সেসব কথা এখনোও মনে পড়ে।

আমি এখন বসত করি সুইডেনে। প্রশ্ন হতে পারে সুইডেনে কি এগুলো হয়? হয় মানে বেশি বেশি হয়। তবে কিছুটা ভিন্ন ধরনের বা ভিন্ন নামে। এখানে সুইডিশ ভাষায় যে শব্দটি বেশি ব্যবহার করা হয় তার নাম হচ্ছে সুইডিশ ফিকা। বন্ধু বান্ধবী মিলে কফিশপে বা পার্কে বসে আড্ডা মারাকে ফিকা বলা হয়। ইংরেজি ভাষায় ফিকা মানে পিকনিক। পিকনিক অর্থ হলো নিজ নিজ বাড়ি থেকে খাবার নিয়ে গিয়ে পার্টিতে একত্রে ভোজন করা।

jagonews24

আমেরিকান বা ইংরেজরা এ কাজটি করে থাকে। তবে সুইডিশরা এটা সব সময় করে পার্কে বা জঙ্গলে। এরা বলে ‘উতে ফিকা’ বা বনভোজন। আমি সুইডেনে প্রায়ই বনেভোজন করি বিধায় বনভোজন শব্দটি বেশি ব্যবহার করি। আজ কনকনে শীত তবে পুরো আকাশ নীল, মেঘের কোনো বালাই নেই, সূর্য কিরণ দিচ্ছে।

মারিয়াকে (আমার স্ত্রী) বললাম চলো ফ্রোলুন্ডার (ফ্রোলুন্ডা সুইডেনের প্রাকৃতিক জঙ্গলের একটি নাম) জঙ্গলে গিয়ে দুপুরের লাঞ্চ সেরে নেব। মারিয়া রাজি হয়ে গেলো। ঝটপট করে শহর থেকে দুটো সিব্রিম মাছ, পটেটোস সালাদ, ব্যাগেট ব্রেড, সালাদ, বড় একটি সাগর কলা ও মারাবো চকলেট কিনে বাসায় এসে প্রয়োজনীয় যা দরকার সঙ্গে নিয়ে গাড়িতে করে সরাসরি বাল্টিক সাগরের পাড়ে ফ্রোলুন্ডার বার্বকিউ স্পটে এসে হাজির।

একটি বিষয় বলা দরকার তা হলো সুইডেনে সূর্যের দেখা পাওয়া শীতের দিনে সরাসরি আল্লাহর রহমত এবং এমন একটি মুহূর্ত সুইডিশরা মিস করতে পারে আজ অবধি দেখিনি। তাও এসে দেখি বনভোজন স্পটগুলো সুইডিশরা দখল করে গ্রিল করতে শুরু করেছে। আমি এর আগে এদের দেখিনি। আমাকে দেখেই তারা বুঝতে পেরেছে আমিও গ্রিল করব, নিজ থেকেই তারা বললো ‘তুমি আমাদের সঙ্গে গ্রিল কর, আমাদের খাওয়া প্রায় শেষ শুধু কফি ও পানকেক ছাড়া (সুইডিশ পানকেক আমাদের দেশের গ্রামের ভাষায় বলে ধাপড়া)’।

দেরি না করে লেগে গেলাম তাদের সঙ্গে। আমার মাছ দেখেই তারা লোভী হয়ে গেলো, আপ্লুতের সঙ্গে মাছ সম্পর্কে নানান বিষয় জিজ্ঞেস করতে শুরু করলো। বললাম মাছ একটা বেশি আছে তোমারা সবাই একটু একটু করে টেস্ট করতে পারবে। দেখো আমি কিভাবে গ্রিল করছি, তাহলে পরবর্তীতে বাংলা কায়দায় এমনটি তোমরাও করতে পারবে। শুরু হয়ে গেল বিল্ডিং ট্রাস্ট বিল্ডিং গ্রোথ। তারা আমাকে তাদের পানকেক ও কফি অফার করলো যদিও বললাম লাগবে না, নাছোড় বান্দা বললো লাঞ্চ শেষে কফি এবং পানকেক দিয়ে শেষ করবে আজকের বনভোজন।

পুরো দিনটির বেশির ভাগ সময় সবাই মিলে মজা করলাম। তারা জ্বালানির জন্য কাঠ ছোট ছোট করে কেটে আগুন সতেজ রাখতে আপ্রাণ চেষ্টা করতে সাহায্য করেছে। প্রচন্ড ঠান্ডা তারপর বাইরে জঙ্গলে কাঠ ছোট ছোট করে কেটে সুন্দর করে রাখা রয়েছে পৌরসভা কর্তৃপক্ষ কর্তৃক, তারপরও তাকে আরও ছোট ছোট করে কেটে জ্বালানিকে সহজতর করতে তাদের চেষ্টার তুলনা ছিল না। আজকের এই মধুময় বনভোজনের মুহূর্তটি হঠাৎ ছোটবেলার গোলাম মোস্তফার কবিতার কথা মনে করিয়ে দিলো।

লেখক: রহমান মৃধা, সাবেক পরিচালক (প্রোডাকশন অ্যান্ড সাপ্লাই চেইন ম্যানেজমেন্ট), ফাইজার, সুইডেন।[email protected]

এমআরএম/এএসএম

প্রবাস জীবনের অভিজ্ঞতা, ভ্রমণ, গল্প-আড্ডা, আনন্দ-বেদনা, অনুভূতি, স্বদেশের স্মৃতিচারণ, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক লেখা পাঠাতে পারেন। ছবিসহ লেখা পাঠানোর ঠিকানা - [email protected]