মরুর বুকে বাসে একদিন

প্রবাস ডেস্ক
প্রবাস ডেস্ক প্রবাস ডেস্ক
প্রকাশিত: ০৫:৫৭ পিএম, ২৬ নভেম্বর ২০২১

২০১৬ সালের ৭ মার্চ কুয়েতে যখন পা রাখি তখন সবকিছু অচেনা। কেননা এয়ারপোর্ট থেকে বের হয়ে যতদূর চোখ যায় দেখি এ যেন রাত না, রাতের মধ্যে দিনের অনুভূতি। চারদিকে আলো শুধুই ঝলকানি।

কোম্পানির সিকিউরিটির একজন এসে আমাদের বাসায় নিয়ে গেলেন। পরের দিন সকালে উঠে নাস্তা খাওয়ার জন্য আশপাশের দোকানগুলোতে খাবার খুঁজতে শুরু করলাম। তখন হাতের নাগালে পেয়ে গেলাম এক পাকিস্তানির হোটেল। কিন্তু কি খাবো বা কি নেবো তা তাকে কোনোভাবেই বোঝাতে পারছিলাম না। কেননা সে সময় সঠিকভাবে হিন্দি ভাষা বলতে পারতাম না। আরবি তো অনেক দূরের কথা। তখন হোটেল কর্তৃপক্ষ বুঝে নিলো নতুন। তাই হাতের ইশারায় যা বল্লাম তাই দিলেন।

হোটেলের পথিমধ্যে রাস্তার ধারের পাশ দিয়ে দেখি কত আধুনিক বাস চলাচল করছে। চিন্তা করলাম এগুলো মনে হয় দূরপাল্লার বাস, কেননা বাসগুলো দেখতে খুবই সুন্দর। কিন্তু আমার ধারণা ভুল। এগুলো শুধুমাত্র কোম্পানির যাত্রীদের জন্য বরাদ্দ ছিল, মানে এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে যাওয়ার জন্য। দেখে শখ জাগলো এই বাসগুলোতে চড়বো। প্রবাসে নতুন অবস্থাই বাসে চলা কিন্তু অনেক মুশকিল, কারণ আপনাকে আগে থেকে বাস সম্পর্কে অনেক কিছুই জানতে হবে।

প্রথমত, আপনি কোথায় যাবেন তার জন্য ওই স্থানের কিছু নির্ধারিত বাস আছে। যেতে হলে ওইসব বাসে চড়তে হবে। কুয়েতের সরকারি কোম্পানির বাস হচ্ছে ‘কেপিটিসি’ আর কতগুলো বেসরকারি কোম্পানির বাস আছে। এই দেশে কোনো ব্যক্তিগত বাস নেই যাত্রী পরিবহনের জন্য।

বেসরকারি বাসগুলো নির্দিষ্ট কিছু কোম্পানির মধ্যে যেমন ভাগ করে দেওয়া হয়েছে তেমনি রাস্তাও ভাগ করে দেওয়া হয়েছে। এখানের বাসগুলো চলে নম্বরের ভিত্তিতে। যেমন যে কয়েকটি কোম্পানির বাস আছে তারা প্রত্যেকটা রোডে নম্বরের ভিত্তিতে চলবে। কুয়েত সিটি থেকে যদি আপনি অন্য একটি এলাকাতে যেতে চান তাহলে নম্বরের ভিত্তিতে যেতে হবে।

এখানে শুধু বাসের নাম আর নম্বর থাকে। যেমন কুয়েত সিটি টু ফরওয়ানিয়ার সিটি বাস ২১, কেজিএল ২১ কেপিটিসি ২১। একই জায়গাতে কুয়েত সিটি টু ফরওয়ানিয়া ৫১, ৫৯, ৫০৭ এই নম্বরে যত বাস আছে প্রত্যেকটা ভিন্ন ভিন্ন রাস্তা দিয়ে চলাচল করে। যাতে যাত্রীরা কোনো ভোগান্তি ছাড়ায় নিরাপদে পৌঁছাতে পারেন।

আর সবচেয়ে মজার ব্যাপার হচ্ছে কুয়েতের বাস ভাড়া কিন্তু এক রেট। মানে আপনি যেখানে যান না কেন কুয়েতের ২৫০ পয়সা দিয়ে টিকিট কেটে সারাদেশ ঘুরতে পারবেন। এজন্য ভাড়া নিয়ে ড্রাইভারদের সঙ্গে কোনো ঝামেলা করতে হয় না। আর বাসগুলোতে ড্রাইভার ব্যতীত কোনো হেল্পার কিংবা সুপার ভাইজার থাকে না। ফলে ভাড়া নিয়ে বাকবিতণ্ডা করা লাগে না।

সব গন্তব্যে বাস কাউন্টার আছে যেখান থেকে প্রতি পাঁচ মিনিট পর পর কোম্পানির বাস পাওয়া যায়। আর কাউন্টারগুলো থেকে বাসে উঠে ড্রাইভারের কাছে নির্ধারিত ভাড়া দিয়ে দিলে তারা একটা টিকিট দেবে। ফলে ঝামেলা ছাড়াই গন্তব্যে পৌঁছানো যাবে সহজে।

কুয়েতে নতুন আসার পর তো কিছুই চিনি না, তবু আমাকে বাসে চড়তে হবে। আমি আমার মামার কাছে যাব বলে ইচ্ছা করেছি। তবে কিভাবে যাব তাতো জানা ছিলো না। তারপর ঠিক করে নিলাম আমি যে এলাকায় থাকি সেখান থেকে মামার কাছে যাব। মামা বলতে আমার বাড়ির পাশের এক মামা ছিল কুয়েতে, তখন তাকে কল দিয়ে জানতে চাইলাম আপনি কোথায় থাকেন?

তারপর মামা ঠিকানা বললো। এরপর আমি বাসা থেকে সেখানে যাওয়ার জন্য রওয়ানা হলাম। পথিমধ্যে কয়েকজনকে জিজ্ঞাসা করলাম এই জায়গায় কিভাবে যাব? তখন কয়েকজন আমাকে এই গন্তব্যের বাসের নম্বর বলে দিল সেই নম্বরের বাসগুলো সেখানে যায়। তারপর কাউন্টারে গিয়ে ৬২ নম্বর বাস পেয়ে গেলাম এবং উঠে ড্রাইভারকে কুয়েতের এক দিনার দিলাম। ড্রাইভার আমাকে ৭৫০ পয়সা ফিরিয়ে দিল। তারপর রওয়ানা দিলাম অচেনা এক গন্তব্যে।

কিছুক্ষণ পর পর বাসের যাত্রীদের জিজ্ঞাসা করতে লাগলাম, ভাই আমি কি সে জায়গায় এসেছি? কেননা আমি অনেক চিন্তা পড়ে গেলাম। বাস চলছিল তো চলছিলই কিন্তু কোথায় যাচ্ছে আমি কিছুই বুঝতে পারছি না। এই অচেনা মরুর বুকে যদি আবার হারিয়ে যায়!

মাথার মাঝে বিভিন্ন চিন্তা ভর করছিল। কোথায় থেকে আবার কোথায় চলে যায় তার তো ঠিক ঠিকানা নেই। ঠিকমত ভাষাও বুঝি না। জিজ্ঞাসা করতে করতে অবশেষে সে ঠিকানাই আমি চলে আসি। না চেনার কারণে আসার সময়ও আমাকে অনেক কষ্ট করে আসতে হয়েছিল, কেননা কুয়েতে তখন আমি একবারে নতুন।

এখানে ট্যাক্সির চেয়ে কম খরচে বাসে চলাফেরা আরামদায়ক। এজন্য আমি কুয়েতে প্রায় জায়গায় বাস দিয়ে চলতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করি। তবে বাস দিয়ে কুয়েতের প্রথমদিন আমার জন্য স্মরণীয় হয়ে থাকবে আজীবন।

সাইফ রুবেল, কুয়েত থেকে

এমআরএম/এমএস

প্রবাস জীবনের অভিজ্ঞতা, ভ্রমণ, গল্প-আড্ডা, আনন্দ-বেদনা, অনুভূতি, স্বদেশের স্মৃতিচারণ, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক লেখা পাঠাতে পারেন। ছবিসহ লেখা পাঠানোর ঠিকানা - [email protected]