ভালোবাসা হুট করে আসেনি

রহমান মৃধা
রহমান মৃধা রহমান মৃধা
প্রকাশিত: ০৮:৫৭ পিএম, ১৮ সেপ্টেম্বর ২০২১

সবাই বলে দূরপরবাসে এসে বাঙালি জাতি থালাবাসন ধোয়া থেকে শুরু করে রান্না-বান্না করে অথচ দেশে হাত ধুয়ে ভাত খেতে চায় না। এর পেছনে কী কারণ রয়েছে? সবাই বলবে বিদেশে পরের মায়েনদারি করা থেকে সব কাজ করতে বাঙালির সমস্যা নেই অথচ দেশে আসলে নবাবজাদাদের যতো সমস্যা।

এমন উক্তি পররাষ্ট্রমন্ত্রীও গত বছর করেছিলেন। যে যাই বলুক এখন আর কারো কথা গায়ে লাগে না। আমি নিজে বহু বছর বিদেশে, সব কাজই করি। দেশে থাকতেও করেছি তবে বাধ্যতামূলক ছিল না। কারণ গরিবের হাতের কাজটি যদি আমি করতাম তাহলে বেচারি গরিবের হয়তো দু’বেলা ভাত জুটতো না।

তবে দেশে থাকতে বন্ধুরা মিলে বনভোজন করেছি জীবনে অনেক। দৈনন্দিন জীবনের সব কাজ করার ফাঁকে নানারকম মজাদার খাবার তৈরি করার মধ্যে মজা আছে। অনেকে বলে আমার রান্নায় কী এমন রহস্য রয়েছে যে আমার রান্না খেলে প্রেম প্রেম ভাবের উদয় হয় দেহে এবং মনে! আমি বিদেশে থাকি, প্রেমপ্রীতি ভালোবাসা হুট করে আসেনি। কঠিন সাধনার ফলে শেষ পর্যন্ত একটু ভালোবাসা পেয়েছি।

অনেকের ধারণা ভালোবাসা খুব সহজ। আলাদিনের চেরাগের মতো চাইলেই হুড় হুড় করে চলে আসবে এবং বলবে ‘ভালোবাসি’ আর সঙ্গে সঙ্গে হয়ে গেল গরম গরম টাটকা ভালোবাসা, ব্যাপারটা মোটেই তা নয়। ভালোবাসার জন্য যোগ্যতা দরকার, মনের যোগ্যতা দরকার, আর দরকার সাধনার।

একবার ছাত্রজীবনে বিশ্ববিদ্যালয়ের এক মেয়েকে জিজ্ঞেস করেছিলাম, আচ্ছা তোমাকে যদি ভালোবাসতে চাই তাহলে কী যোগ্যতার দরকার?

মেয়েটি চটপট করে একগাদি প্রশ্ন করলো সুইডিশে যার বাংলা অনুবাদ করলে এমনটি হবে। যেমন, সাহস আছে? ধৈর্য্য আছে? মন আছে? বেখেয়ালি? প্রেমের ‘শিরোমনি’ মাগুরা’র ‘চণ্ডীদাস আর রজকিনী’ বা উড়নচণ্ডীর প্রেমে লেগে থাকার অধ্যবসায় বোঝো, ইত্যাদি।

আমি মনে মনে বললাম ‘ওরে তুই কতো ঢং করবি, আর কতো ঘুরাবি, মনের কথা খুলে ক ভালো বাসবি কী- না বাসবি? আমি নিজে মাগুরার ছেলে, তারপর গ্রামের বাড়ি নহাটা। তোদের দেশে এসেছি কিছু একটা ঘটাই দেব।’

মেয়েটি বললো মনে মনে কী ভাবছো? বুকের পাটায় জোর না থাকলে তুমি তছনছ হয়ে যাবে, তুমি ভেঙে চুরমার হয়ে যাবে, তারপরও সে বেখেয়ালির যদি মনে হয়, যথেষ্ট হয়নি ভালোবাসা, মনের দুয়ারই খুলবে না তোমার জন্য।

ছটাক থেকে শুরু করে তোলা, তোলা থেকে বিন্দু পর্যন্ত হিসাব নেবে, কতোটা ভালোবেসেছ সকাল, দুপুর এবং সন্ধ্যায়! কীভাবে কখন তার দিকে তাকিয়েছো এবং কী সংকেত ছিল সেই চাহনিতে ইত্যাদি। মনে মনে আবারও বললাম তোর ভালোবাসার নিকুচি করি।

এবার মেয়েটি ধরেছে আমার মনের কথা। বলে কী..আমি এতক্ষণ বক বক করছি অথচ তুমি কিছুই বলছ না কারণ কী? মনে মনে নিশ্চয় অনেক কিছু ভাবছো তবে সাহস করে বলতে পারছো না, ঠিক বলিনি? আমি বললাম না, তোমার কথা গুরুত্ব দিয়ে শুনছি, (গুরুত্ব না ছাই, ঢাহা মিথ্যা কথা বলে দিলাম)।

মেয়েটি এ কথা সে কথা বলতে বলতে এক পর্যায়ে বললো ভালো ভালো রুচিপূর্ণ খাবার রান্না করা তারপর যদি নানা ধরনের এবং নানা দেশের হয় তাহলে তো কথা নেই। পারবে, অতটা ভালোবেসে যেতে? বিরক্ত হয়ে যাবে না? ভালোবাসার অত্যাচার মনে হবে না? সইতে পারবে?

আজীবন কানায় কানায় পূর্ণ ভালোবাসা দিয়ে যেতে পারবে? দেখো, সোজা করে বলছি, যদি না পারো, ভুলেও ভালোবেসো না।
আজ খেলবে, কাল মন ভাঙবে, বরং ও ভালোবাসা তোমার কাছে রেখে দাও!

তারপর সুইডিশ পাগলিকে ভালোবাসতে হলে, পাগলের মতোই ভালোবাসতে হবে। এসব ছিল সেদিনের আলোচনা। ভালোবাসা এসেছিল জীবনে বহু বছর আগে। সেই ভালোবাসাকে পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে ধরে রাখতে অনেক কিছুই করতে হয়। তবে মজাদার এবং নতুন নতুন খাবার রান্না করা ভালোবাসার মানুষের জন্য নিশ্চিত একটি ভিন্ন ধরনের অনুভূতি।

আজ রান্না করবো একটু ভিন্ন ধরনের মজাদার খাবার। স্পেনের ভ্যালেন্সিয়া প্রভিন্সের ট্রেডিশনাল খাবার পাএইয়া (Paella) যা বিশ্বে পরিচিত। (স্পেনিশ ভাষায় দুটো এল পাশাপাশি থাকলে তার উচ্চারণ হয় এই)। পাএইয়া রান্না করতে যে উপকরণগুলি নিয়েছি তার মধ্যে রয়েছে নানা ধরনের সিফুড যেমন ঝিনুক, অক্টোপাস, চিংড়ি।

সবজির মধ্যে বেছে নিয়েছি পাপড়িকা, ছিম। ভ্যালেন্সিয়ার চাউল সাথে রসুন সামান্য পেঁয়াজ এবং অলিভ ওয়েল। এসব ইনগ্রীডিয়েন্স এক সঙ্গে করে রান্না করা কিছুটা দেশি বিরিয়ানির মতো বললে বুঝতে সুবিধা হবে। নতুন পরিবেশে প্রথম প্রথম খেতে কিছুটা অরুচি লাগারই কথা।

কারণ ঝিনুক আমাদের দেশে হাঁসকে খেতে দেখেছি। তবে সাগরের ঝিনুক দেখতে হার্টের মতো, তারপর অক্টোপাস সাদা মাছের মতো দেখতে যা আমাদের দেশের তুলনায় ভিন্ন। রান্না যে ভালো হয়েছে এবং খেতেও যে খুব মজা হয়েছে তার প্রমাণ খাবারের ছবিটি। বোন আপটিট।

যাই হোক খাবার শেষে যখন প্রিয় জনের মুখে খাবারের প্রসংসা শুনি বা যদি কখনও এর মতো গানের শুরে বলে ‘‘I can eat my dinner in a fancy restaurant, but nothing compares to yours” মনের মধ্যে ভালোবাসা দোলা দেয় যা দুটি প্রাণের সাধনা।

লেখক: রহমান মৃধা, সাবেক পরিচালক (প্রোডাকশন অ্যান্ড সাপ্লাই চেইন ম্যানেজমেন্ট), ফাইজার, সুইডেন থেকে, [email protected]

এমআরএম/জেআইএম

প্রবাস জীবনের অভিজ্ঞতা, ভ্রমণ, গল্প-আড্ডা, আনন্দ-বেদনা, অনুভূতি, স্বদেশের স্মৃতিচারণ, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক লেখা পাঠাতে পারেন। ছবিসহ লেখা পাঠানোর ঠিকানা - [email protected]