‘এসি চুরি হয়ে গেছে, কাঁথা ভিজিয়ে ঘর ঠান্ডা রাখি’
‘এক কুয়েতি আমারে ফ্রিজ আর এসি দিছিল। এক বছর আগে চুরে চুরি করিয়া লইয়া গেছে গি। এরমভাবে থাকছি, কুয়েতি আর দিতো নায়। আবার নিজে কিনতে গেলে অনেক টেকার দরকার। যা বেতন পাই এর বাইরে ১ টেকাও কামানির সুযোগ নাই। যা দিয়া ফ্রিজ-এসি কিনতে পারমু। থাকতে থাকতে অভ্যাস অই গেছে। কষ্ট অইলেও সহ্য করিয়া যাইয়ার।’
হাসিমুখে আঞ্চলিক ভাষায় কথাগুলো বলছিলেন, সিলেটের বাসিন্দা আব্দুল মাজিদ (ছদ্মনাম)। প্রায় একযুগ হলো কুয়েতে। জাকরের (পশুপালন) কাজে এসেছেন। আসতে শুধুমাত্র টিকিটের খরচ লেগেছিল। ভিসার খরচ নেই। জাকরের কাজে বেশিরভাগ মানুষ শুধুমাত্র টিকিটের খরচ দিয়ে আসেন। আসার পর থেকে মরুভূমিতে কাজ করছেন আব্দুল মাজিদ।
খুবই আন্তরিক একজন মানুষ। পানি চাইতেই রুমে বসতে দিলেন। সঙ্গে আন্তরিকতার সঙ্গে খোঁজখবর নিলেন। সাথে তার এক চাচাতো ভাই থাকেন। তাকে তিনি নিয়ে এসেছেন। তবে বেশি দিন হয়নি। এই মরুর বুকে তৃষ্ণার্ত অবস্থাই ভাবছিলাম ফ্রিজের ঠাণ্ডা পানি পাব। তাঁবুতে ঢুকতেই দেখি ফ্রিজ তো দূরের কথা একটা এসিও নেই। চারপাশে তাবু টানিয়ে ঘর বানানো হয়েছে।
গরমে বসা যাচ্ছে না। মাটির কলস থেকে পানি দিল। কলসে রেখে মুখ কাপড় দিয়ে বেঁধে রাখায় পানি কিছুটা ঠান্ডা পেলাম। বর্তমান যুগে এসব কলস গ্রামেও দেখা যায় না। অথচ কুয়েতের মতো একটা ধনী দেশে তারা মাটির কলসে রেখে পানি ঠান্ডা করে পান করেন।
রুমের এসি তো দূরের কথা একটা টেবিল ফ্যান না থাকায় আরেকটু অবাক হলাম। ৫০ ডিগ্রির বেশি তাপমাত্রা এখন। এই সময় এসি ছাড়া কিভাবে থাকা সম্ভব! তাও আবার মরুভূমিতে! একপাশে দেখলাম কাঁথা ভেজানো। জানতে চাইলাম এখানে কীভাবে থাকেন?
উত্তরে মজিদ বললেন, ‘কেতা ভিজাইয়া রাখি, রাতে ওটা বিছাইয়া উপরে হালজা পাতলা কাপড় একটা দিয়া রাখি, তখন কিছুটা হলেও ঠান্ডা লাগে। দিনে তো ঘুমাইতাম পারি না কাজের লাগি। হারাদিন দুম্বার পিছিয়ে থাকতে হয়। রাইতে ও ঘুমাইতাম পারি না চুরের বাচ্চার কারণে, একানো চুরর আখড়া।’
কথাগুলো শুনে খুবই খারাপ লাগছিল। কিন্তু ওই মানুষগুলোর দিকে তাকিয়ে একটু বোঝা যাচ্ছে না কতটা কষ্টে প্রবাস জীবন পার করছেন তারা। দেশের মানুষকে পেয়ে হাসিখুশিতে ভরা তাদের চেহারা। মরুভূমিতে থাকায় সহজে কারো সঙ্গে দেখা হয় না। কুয়েতিরা এসে প্রতিদিন একবার দেখে যায়। সঙ্গে প্রয়োজনীয় বাজারের জিনিসপত্র দিয়ে যায়।
সারাদিন রোদে খেটে কাজ করে যাচ্ছেন প্রবাসীরা। মাত্র ২০ হাজার টাকায় চাকরি করতে হচ্ছে। কুয়েতিরা কখনো বখশিশ দিলে এটা অতিরিক্ত পাওনা। মরুভূমিতে পার্ট-টাইম কাজের সুযোগ নেই। এত কষ্ট করেও নিজের সুখের জন্য একটা এসি, একটা ফ্রিজ ক্রয় করে না। যেই টাকাগুলো নিজের সুখের জন্য ব্যয় করার কথা সেটা পরিবারের জন্য পাঠিয়ে দিচ্ছে। এরপরেও পরিবারের চাহিদার শেষ থাকে না। হায়রে প্রবাস জীবন!
মরুভূমিতে বসবাস করা আর নরকে বসবাস করা যেন একই কথা! সেই সকাল ৬টা থেকে সন্ধ্যা ৬টা পর্যন্ত মাথার ওপর সূর্যের তাপ। জনমানবহীন বালুময় এ মরুভূমির আশপাশে কাউকে পাওয়া যায় না। এখানে জরুরি প্রয়োজনীয় কাজ ছাড়া কারো যাতায়াত নেই। এই মরুভূমিতে একাকি থাকার কষ্ট সহ্য করার ক্ষমতা সবার নেই! মরুভূমিতে থাকা এক এক মানুষের জীবনকাহিনি যেন একেক রকমের।
এমআরএম/এএসএম