আর কত বাটপারি
বাংলাদেশের যে কোনো বিষয় আলোচনা করতেই উত্তর রেডি। সমস্যা তুলে ধরতেই সমাধান! আমি কী বলতে চেষ্টা করছি কেউ কী তা বুঝতে পারছেন? বিষয়টি কিছুটা মুখস্থবিদ্যার মতো। ধরুন আমি কখনও জাপান যাইনি কিন্তু দেশটি সম্পর্কে পড়েছি। যদি কেউ জাপানের নৈশভোজের নিয়ম-কানুন সম্পর্কে জানতে চায় নিশ্চয় সঠিক উত্তর দেওয়া সম্ভব। কারণ ওই যে আমি বই পড়ে জেনেছি, তাই প্রশ্ন করার সঙ্গেই সঠিক উত্তর দিতে আর দেরি হয় না। এটা হলো মুখস্থবিদ্যা।
বাংলাদেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে একটি জিনিস পরিষ্কার সেটা হলো আমাদের সবকিছু পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে সঠিক এবং আমরা সেরাদের সেরা। যেমন কিছুদিন আগে দেখলাম একজন মন্ত্রী বলছেন, ‘অনুকরণ নয় আমরা অনুধাবন করছি/করব প্রযুক্তির ক্ষেত্রে।’ এটা যে নিশ্চিত একটি ডাহা মিথ্যে সে বিষয়ে এই মন্ত্রী জানেন তারপরও তেল মারতে এভাবে বলা।
প্রযুক্তিতে কোন জিনিসটা আমাদের নিজেদের উদ্ভাবন? আছেন কি কেউ যে আমাকে বলতে পারবেন? তবে আমরা প্রযুক্তির ইউজার হিসেবে সত্যিই ভাগ্যবান কারণ সবধরনের সুযোগ-সুবিধা আমরা পাচ্ছি। সেক্ষেত্রে প্রধানমন্ত্রীর ছেলে জয়ের আন্তরিকতা রয়েছে সেটা না বলে মন্ত্রী উল্টোপাল্টা কথা বলে গেলেন সবার সামনে, অথচ কেউ প্রতিবাদ করলো না! তারা কখন কী বলে তা নিজেরাও জানে না।
ছোটবেলায় শুনেছিলাম এক ভদ্রলোক বসের বাসায় ইলিশ মাছ এনে বলছে, স্যার, নিজের পুকুরের মাছ আপনার জন্য এনেছি। জাতির এই গুণগত অভ্যাস হয়তো থেকেই যাবে আজীবন।
খারাপ এবং ভালো এই দুটি গুণেই আমরা মানুষ জাতি। তার অর্থ এই নয় যে সমপরিমাণ বা বেশি খারাপ হতে হবে। সামান্য ভুল ত্রুটি থাকতে পারে জীবন চলার গতিতে কিন্তু ভারসাম্য হারালে সভ্য সমাজে বসবাস করা যাবে কি? না যাবে না। তবে বাংলাদেশে বিষয়টি অন্যরকম। তাহলে সমস্যা কোথায়? না, সমস্যা নেই। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, মানুষ হিসেবে আপনি কি সভ্য হয়ে বসবাস করবেন নাকি অসভ্য হয়ে বসবাস করবেন?
যদি সভ্য মানুষ হয়েই বসবাস করতে চান তাহলে অবশ্যই আপনাকে সচেতনতা অর্জন করতে হবে এবং অসচেতনতাকে বিসর্জন দিতে হবে। আপনি যদি সেটা করতে পারেন তাহলে সভ্যতা ও অসভ্যতার মধ্যে পার্থক্য তৈরি করতে পারবেন এবং নিজেকে সভ্যরূপে গড়ে তুলতে পারবেন। ওই যে বলেছিলাম ভ্যালু বা মূল্যবোধের কথা, ভালো ও মন্দের মধ্যে পার্থক্য করার কথা, ঠিক তাই। তা না শিখলে দিনের শেষে যেমন অন্ধকার আসে ঠিক তেমনি তিলে তিলে আমাদের জীবনে অধঃপতন ঘনিয়ে আসবে।
বর্তমানে ঘরে, বাইরে, দেশে, বিদেশে পরীমনিকে রোল মডেল হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে। পরীমনি একদিনে রোল মডেল হয়নি, তার জীবন ইতিহাস নাড়লে দেখা যাবে কী পরিমাণ পুরুষ তাকে এই রোল মডেল হতে সাহায্য করেছে। চোখের সামনে যা ঘটে চলেছে সেটা দেখলেই বোঝা যায় অবস্থা কোথায় গিয়ে ঠেকেছে।
এই ধরুন পরীমনির বাসা যখন প্রশাসন ঘিরে ফেলে তখন সে বারবার এক পুলিশ কর্মকর্তাকে ভাই সম্বোধন করছিল। এত বড় কর্মকর্তাকে ভাই বলে ডাকতে পারে এমন সাহস বাংলাদেশে কার আছে? মা-বাবা ডাকতে পারেন। আবার অনেক সময় স্ত্রীও অধিক আদুরে সম্বোধন করতে গিয়ে স্বামীর নাম ধরে ডাকে। কিছুদিন পরই নতুন একটি ভিডিওতে দেখলাম পুলিশের আরও এক কর্মকর্তার সঙ্গে পরীমনির কেক খাওয়ার দৃশ্য।
এসবের আগে হেলেনা জাহাঙ্গীর নামে এক নারীর সাক্ষাৎকার দেখেছিলাম বোট ক্লাবের পাশে। সেই হেলেনা জাহাঙ্গীরের মুখেও বারবার প্রশাসনের এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার নাম শুনছিলাম। এইবার বোঝেন ঠ্যালা।
পরীমনি আর হেলেনা জাহাঙ্গীররা ছাড়া বাংলাদেশের কোনো সাধারণ নাগরিক যদি তাদের ভাই বলে সম্বোধন করতো, তাহলে ভেবে দেখুনতো কী অবস্থা হতো? সেই হেলেনা জাহাঙ্গীরও পরে গ্রেফতার হয়েছে। কিন্তু সেই ভাইদের কেউ কিন্তু হেলেনা ও পরীর সাহায্যে এগিয়ে আসেননি।
সমাজের অনেক অর্থবিত্ত বা ক্ষমতার অধিকারী অসভ্য মানুষ নামের দানবের সংখ্যা আজ এতবেশি যে এখন আর তাদেরকে নির্মূল বা বিনাশ করা সম্ভব নয়। তাহলে উপায় কী? উপায় একটাই সেটা হলো চোরের উপর বাটপারি নয়, বাটপারির উপর বাটপারি করা।
ঘটেছে সদ্য এমন একটি ঘটনা সুইডেনে। শুনুন বলি নতুন করে পুরোনো ঘটনা। এটা একটা সত্য ঘটনা সত্ত্বেও বর্ণনায় মূল চরিত্রের প্রকৃত নাম ও ঠিকানা গোপন করা হলো।
আমি এবং আমার স্ত্রী মারিয়া বাসায় ফিরছি। পথে হঠাৎ ভারতবর্ষের এক মহিলা হাই বলেই তার পরিচয় দিল, নাম সুচি পুরো নাম সুচিত্রা।
আমি প্রায়ই তোমাদেরকে দেখি, কোথায় থাকো তাও জানি। অনেক দিন ধরে ভাবছি কথা বলবো কিন্তু সুযোগ হয়নি। আজ ভাগ্যে সেটা জুটে গেল।
সুচি ইংরেজি ভাষা ব্যবহার করছে, মারিয়া প্রথমেই কথোপকথনে ঢুকে গেল। আমি শুধু আমার নামটি বলে চুপচাপ সব কথা শুনতে লাগলাম। পরে জানা গেল মহিলাটি আমাদের বাসার বেশ কাছেই থাকে। যেতে যেতে পথে স্বল্প সময়ের মধ্যেই মারিয়ার টেলিফোন নম্বরটা নিল এবং বিদায় পর্ব শেষে বাসায় ফিরে এলাম।
আজ শনিবার তিনি ফোন করেছে, আমাদের বাসায় আসতে চায়। মারিয়া আমাকে জিজ্ঞেস করলো আমাদের দিনের প্লান কী? সব জেনে সুচিকে বিকেল চারটের দিকে আসতে বললো। নতুন মেহমানের জন্য কিছু নাস্তাপানির ব্যবস্থা করা হয়েছে। ঠিক চারটের সময় দরজার সামনে সুচি এবং তার স্বামী হাছ্ছে (Hasse) এসে হাজির।
ভারতের নারী অথচ নরওয়ের স্বামী, একটু চমকে গেলাম। তারপরও সব কিছু অ্যাডজাস্ট করে কফি আড্ডায় বসে গেলাম। এ কথা, সে কথা, এবার শুরু হলো সুচির মনের কথা। আমি ভারতবর্ষের একজন স্কুল শিক্ষক, বাবা-মা বিয়ে দেন আমাকে একজন ডাক্তারের সঙ্গে।
ডাক্তার আমাদের বিয়ের পরই আমাকে দেশে রেখে সুইডেনে পিএইচডি করতে আসেন। আমরা হিন্দু বিধায় আমার বিয়েতে বড় অঙ্কের একটি অর্থ আমার বাবা-মা ছেলে পক্ষকে দেন এবং ছেলের সুইডেনে পড়তে যে খরচ সেটাও বহন করেন।
মারিয়া জিজ্ঞেস করলো, তা তুমি সাথে এলে না কেন? উত্তরে সুচি বললো, আমি সবে নতুন চাকরি পেয়েছি সেটা ছিল একটি কারণ। তারপর স্বামীর কোর্স চার বছরের, সব মিলে সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম, আমি দেশে রতনের (সুচির প্রথম স্বামী) বাবা-মার সঙ্গেই থাকি। তাছাড়া আমাদের সমাজে এটা অত্যন্ত সাধারণ ব্যাপার (কাজের কারণে স্বামী, স্ত্রী দেশে বা বিদেশে অনেক সময় একা থাকে)।
রতন সুইডেনে ঢোকার কয়েকদিন পর জানতে পারি আমি মা হতে চলেছি। রতন সব জানতে পারে, চিঠি এবং টেলিফোনে আমাদের যোগাযোগ চলছে তখন। সময় তার গতিতে চলছে, হঠাৎ আমাদের সংসারে একটি মেয়ের জন্ম হয়, নাম রাখি কাজল।
রতন আগের মতো তেমন ফোন করে না চিঠিও খুব একটা ঘন ঘন আসে না। এদিকে আমি, কাজলকে নিয়ে এবং চাকরি নিয়ে ব্যস্ত। সময় দেখতে দেখতে পার হয়ে চলছে। চার বছর অনেক সময় আবার অল্প সময়, সেটা পার হয়ে পাঁচ হতে চলেছে, এর মধ্যে রতন একবারও দেশে আসেনি। কী ব্যাপার, ভাবনায় পড়ি!
রতনের বাবা-মাও চিন্তিত। আমার বাবা-মা মাসের পর মাস টাকা ঢালছে অথচ কোনো খবর নেই রতনের। শেষে কোনো এক সময় সুইডিশ দূতাবাসে বিষয়টি তুলে ধরতে তারা জানালো, রতন পিএইচডি করেনি তবে সেখানে ভারতবর্ষের অন্য একটি বিধবা মহিলাকে বিয়ে করে সুইডিশ নাগরিকত্ব নিয়েছে।
এ ঘটনা জানার পর আকাশ ভেঙ্গে মাথায় পড়ে! কী করি! অনেক চেষ্টা এবং কষ্ট করে সুইডিশ ভিসা জোগাড় করে আমি কাজলকে দেশে তার দাদা-দাদির কাছে রেখে সুইডেনে ঢুকি এবং সুইডিশ পুলিশের আশ্রয়ে রতনের খবর পাই। রতন আমার আগমনের খবরে ভীত হয়ে পড়ে, কাপুরুষেরা যেমনটি হয়।
হিন্দু বংশের ছেলে হয়ে গোপনে বিয়ে করা এবং সুইডেনে পুরো ঘটনা গোপন রাখা সর্বোপরি নিজ দেশ থেকে মিথ্যা কাগজপত্র এনে সুইডিশ সরকারের কাছে নিজেকে অবিবাহিত প্রমাণ করা! কত বড় বাটপারি, ভাবতেই গা শিউরে উঠে!
সুচির অব্যাহত চেষ্টা ও মানবিক কারণে শেষে সুইডেনে পারমিশন পায়। সুচি আরো চেষ্টা করে পরে তার মেয়ে কাজলকে সুইডেনে আনার অনুমতি পায়। এরপরে সুচি করে তার সেই আসল কাজ, সুইডেনে বিয়ে করে এবং সুইডিশ যুবককে। সুচি এখন তার হাছ্ছেকে নিয়ে সুখী আছে।
পাঠক, বাটপারের উপর কিভাবে বাটপারি করতে হয় সেটা বোঝানোর জন্য এই ঘটনাটির অবতারণা করলাম। মনে কি পড়ে একটি পুরনো গানের কথা? ‘হেলেন ভেঙ্গেছে ট্রয় নগরী, কেউ ছেড়েছে সিংহাসন, ভেঙ্গেছে কত মন, ভেঙ্গেছে কত জন, সবই তো নারীরই কারণ।’ কারণ হয়তো নারী, কিন্তু ঘটনা ঘটানোর পেছেন কে জড়িত ভেবেছেন কি?
না ভাবা হয়নি, এর জন্য দায়ী সমাজ, দেশ, এবং সর্বোপরি আমরা পুরুষ নামের দানবেরা। এই দানবদের কারণে যুগে যুগে পরীমনির মতো রমণীর সংখ্যা বেড়েই চলেছে।
আমার অনুরোধ সবার কাছে, শুধু নারীদের প্রতি নয়, সকলে রুখে দাঁড়ান পুরুষোচিত দানবদের বিরুদ্ধে। ব্যক্তিস্বার্থে যারা দেশকে নিচু করে তাদেরকে আমি ঘৃণা করি। আপনি?
লেখক: রহমান মৃধা, সাবেক পরিচালক (প্রোডাকশন অ্যান্ড সাপ্লাই চেইন ম্যানেজমেন্ট), ফাইজার, সুইডেন থেকে, [email protected]
এমআরএম/জেআইএম