চঞ্চল চৌধুরী, তুমিই মানুষ
মো. মাহমুদ হাসান
সৃষ্টিকর্তা পরম করুণাময় ইহলোকে আঠারো হাজার মাখলুকাত সৃষ্টি করেছেন। তার সেরা সৃষ্টি মানুষ। তাই পবিত্র ধর্মগ্রন্থে মানুষকে আশরাফুল মাখলুকাত বা সেরা সৃষ্টি বলা হয়েছে। কর্মের মাধ্যমে আল্লাহর এই সেরা সৃষ্টি কখনো কখনো অমানুষে পরিণত হয়।
মানুষ আকৃতির এই অমানুষের সংখ্যা যেন আজ উদ্বেগজনকভাবেই বেড়ে চলেছে। তাই তো চঞ্চল চৌধুরী তোমাকে আজ বলতে হয়েছে, ধর্ম, বর্ণ নয়, ‘মুক্ত চিন্তার মানুষগুলো আজ সংখ্যালঘুতে পরিণত হচ্ছে’। এটির জন্য তুমি আমি কেউ নই, এই অবক্ষয়ের জন্য সমাজ ব্যবস্থা ই দায়ী। স্বাধীনতার পঞ্চাশ বছরে ও আমরা মানুষের সমাজ তৈরি করতে পারিনি, এ দায়ভার তো তোমার নয় চঞ্চল, তাহলে তুমি হতাশ হবে কেন?
‘মা’ দিবসে অভিনেতা চঞ্চল চৌধুরী সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ফেসবুক ওয়ালে তার মাকে নিয়ে হাস্যোজ্জ্বল ছবি দিয়েছেন। মায়ের প্রতি তার এই ভালোবাসা ও অনুরাগ শুধু তার একার নয় গোটা দুনিয়ায় মা দিবসে মায়েদের প্রতি শ্রদ্ধা আর ভালোবাসায় এভাবেই জেগে উঠে মানবজাতি।
মানুষরূপী কিছু অমানুষ তার এই ছবিটিকে কটাক্ষ করেছেন, ধর্মীয় আবরণকে ব্যবহার করে চঞ্চল চৌধুরীকে ক্ষত-বিক্ষত করেছেন। আর চঞ্চলের এই মনোবেদনার খবর ও আজ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভাইরাল।
প্রিয় চঞ্চল চৌধুরী, মায়ের সঙ্গে তোমার হাস্যমুখের ছবি ওদের হ্রদয়ে দাহ সৃষ্টি করে, কারণ ওরা অসুস্থ মাকে জংগলে ফেলে দিতে অভ্যস্ত। ধর্মের আবরণে ওরা ধর্মহীন, তাই ওরা মানবতাহীন জঘন্য কীট বিশেষ, যার ছোঁয়ায় সমাজে ক্যান্সার ছড়ায়।
ওরা অন্ধ তাই দিল্লির মরণব্যাধিতে সৌহার্দ্যের বন্ধন ওদের চোখে পড়ে না। ওরা অজ্ঞ তাই ইসলামের শাশ্বত শান্তির সৌন্দর্যের পরিবর্তে ওরা জিহাদের বাণী ছড়ায়। আলখেল্লা গায়ে জড়িয়ে শরীয়তের নামে যারা লিভ টুগেদারকে জায়েজ করতে চায়, ওরা সেই ভন্ডদের ই অনুসারী।
বরিশালের ব্রজমোহন, টাংগাইলের কুমুদিনী, সিলেটের মুড়ারী চাঁদ, হবিগঞ্জের বৃন্দাবন, ময়মনসিংহের আনন্দ মোহন, রংপুরের কারমাইকেল, চট্টগ্রামের প্রীতিলতার মতো হাজারো মহান-মহীয়সীর অবদানে যে বাংলা শত বছর যাবত আলোকিত হচ্ছে, সেই বাংলাকে ওর ভয় পায়, তাই তোমার মায়ের শাখা সিঁদুরের সংস্কৃতি ওদেরকে বিক্ষুব্ধ করে তোলে।
কোভিড আক্রান্ত বাবাকে তালাবদ্ধ করে ওরা পালিয়ে যায়। ওরা প্রিয়জনদের শেষ শ্রদ্ধা জানাতে অনীহা প্রকাশ করে। যে পুলিশ তাদের প্রিয়জনদের শেষ যাত্রার সংগী হয়, সুযোগ বুঝে সেই পুলিশকেই ওরা রক্তাক্ত করে। ওরা মানুষ নয়, ওরা দেখতে মানুষের মতো হলেও, গভীর জংগলে পালিয়ে বেড়ানো হিংস্র পশুদের চেয়ে কোনোভাবেই এরা উত্তম নয়।
হবিগঞ্জের ঈদের জামাতে শান্তি শৃঙ্খলার দায়িত্ব পালন করা হিন্দু ভাইদের মহত্ত্ব ওদের চোখে পড়ে না, খুলনার পাইকগাছায় মন্দিরের পাশে মসজিদ স্থাপন করে হিন্দু ভাইদের সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির দৃষ্টান্তে ওরা জেগে থেকেও ঘুমায়। সিরিয়ায় উগ্র স্বগোত্রীয়দের অত্যাচারে নিষ্পেষিত জনগোষ্ঠীকে যখন কানাডার প্রধানমন্ত্রী জাস্টিন ট্রুডো আশ্রয় দেয় খৃষ্টীয় ধর্মের কথা বলে ওরা তখন তা প্রত্যাখ্যান করে না।
ওপারে মোদি, অমিত শাহরা যে বিষবাষ্প ছড়িয়ে হিন্দু রাষ্ট্র বানাতে মরিয়া, এপারে ও আলখেল্লার আড়ালে আফগান স্বপ্নে বিভোর একদল অন্ধ সাম্প্রদায়িক শক্তি চরম মরণ নেশায় মত্ত। মানবতা বিবর্জিত এই ছদ্মবেশীদের আচরণে অভিমানী না হয়ে, অজ্ঞতা আর অন্ধকারে নিমজ্জিত এই পাপিষ্ঠদের ঘরে শিখা প্রজ্জ্বলিত করে চঞ্চল চৌধুরী তুমি মানবতার প্রতিভূ হয়ে উঠো।
প্রিয় চঞ্চল চৌধুরী, আমরা দুঃখিত, ব্যথিত, মর্মাহত, সেই সাথে ভীষণ ক্ষুব্ধ ও বটে। যে বাংলার স্বপ্ন দেখে একদিন মায়ের আঁচল ছেড়ে লক্ষ প্রাণ আত্নাহুতি দিয়েছিল, সেই সম্প্রীতির সংস্কৃতি আজও আমরা প্রতিষ্ঠিত করতে পারিনি বলে।
করজোড়ে ক্ষমা চাই, তোমার বিদুষী মায়ের কাছে যার হাস্যোজ্জ্বল মুখ তোমাকে আন্দোলিত করে, যে মায়ের মুখে হাসি ফুটাতে তুমি বাংলার সেবায় এগিয়ে যাও সেই মা ই পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ মা। সেই মায়ের ঔরসে জন্ম নেয়া চঞ্চল চৌধুরী মানবতার সেবায় তোমরাই শ্রেষ্ঠ-তোমরা ই মানুষ, আমরা তোমাদেরই সাথী হতে চাই।
লেখক: মো. মাহমুদ হাসান, কলামিস্ট উন্নয়ন গবেষক ও সমাজতাত্ত্বিক বিশ্লেষক, কানাডা।
এমআরএম/এমএস