বৈধপথে অভিবাসন সম্মানের, শান্তিরও

প্রবাস ডেস্ক
প্রবাস ডেস্ক প্রবাস ডেস্ক
প্রকাশিত: ১১:৫৭ এএম, ০৭ ফেব্রুয়ারি ২০২১

প্রতি বছর অবৈধপথে ইউরোপে প্রবেশ করছেন শত শত বাংলাদেশি। দুর্বিষহ অবস্থার মধ্য দিয়ে যেতে হচ্ছে তাদের। অথচ একই টাকা খরচ করে বৈধ উপায়েই এসব দেশে আসার সুযোগ আছে।

একজন বাংলাদেশির গল্প শোনাই আপনাদের। ধরুন তার নাম তরুণ। সুইজারল্যান্ডে গিয়ে পরিচয় হয় তার সঙ্গে। বাড়ি নারায়ণগঞ্জে। দেশ ছেড়েছেন আজ থেকে ২২ বছর আগে। চার বছর আগে বৈধ কাগজপত্র হয়েছে তার। কিন্তু এই সময়ে বাবা-মা মারা গেছেন, মারা গেছেন বড় এক ভাই।

অথচ বৈধ কাগজ না থাকায় দেশে ফেরা হয়ে ওঠেনি তার। ২২ বছর আগে ভারতের এক দালালের মাধ্যমে নরওয়েতে এসেছিলেন জানুয়ারি মাসে। ১২ লাখ টাকায় ভারতের পাসপোর্ট-ভিসাসহ সব কিছুর ব্যবস্থা করেছিল দালালটি। তাদের দলে ছিল ৭ জন। তিনি এইচএসসি পাস করে পড়ালেখায় মন বসাতে পারেননি।

তাই ইউরোপে আসার স্বপ্ন দেখেছিলেন। বাবা-র কাছ থেকে অনেকটা ‘ইমোশনাল ব্ল্যাকমেইল’ করে টাকা আদায় করেছিলেন। তার দলে বাকিরা বেশ শিক্ষিত। কেউ অনার্স পাস করেছে, কেউবা ডিগ্রি। এর মধ্যে ভারতের ছেলে রতনের সঙ্গে তার ভাব হয়ে যায়। তারা একই ফ্লাইটে পাশাপাশি বসে প্রচণ্ড ঠান্ডার মধ্যে নরওয়েতে পৌঁছান।

দালাল আগেই বলে দিয়েছিল, নরওয়ে পৌঁছেই পাসপোর্ট ছিঁড়ে ফেলে দিতে। তাই করেছিলেন। ফলে ইমিগ্রেশনে গেলে পুলিশ ধরে জেলে নিয়ে যায়। দালাল লোকটি বলে দিয়েছিল মুখ দিয়ে একটাও শব্দ করা যাবে না। অর্থাৎ, পুলিশ যাতে বুঝতে না পারে কোন দেশি। বিভিন্ন দোভাষী এনেও তরুণদার মুখ থেকে একটা শব্দ উদ্ধার করতে পারলো না তারা।

কিন্তু রতনের মুখ ফস্কে ইংরেজি ভাষা বের হয়ে গেল। এরপর তাদের আলাদা রাখা হলো। তখন থেকে রতনের আর খবর জানেন না তিনি। প্রায় বছর খানেক সেখানকার জেলে রেখে একটা সময় তাকে একটা বিশেষ কাগজ ধরিয়ে দেশে পাঠানোর সব ব্যবস্থা পাকা করা হয়।

কিন্তু তিনি দেশে ফিরতে রাজি ছিলেন না। সড়কপথে পুলিশের চোখ ফাঁকি দিয়ে পালিয়ে যান ডেনমার্ক। এরপর নানা দেশ ঘুরে ১৮ বছর পর পর্তুগালে গিয়ে অবশেষে বৈধ কাগজপত্র করতে পারেন। এর তিনবছর পর সুইজারল্যান্ডে এসে থিতু হন। বর্তমানে একটা হোটেলে কাজ করছেন।

তিনি যখন আমাদের কাছে এই গল্প করছিলেন, তখন কখনো তার মুখে আনন্দ কখনো বা বিষাদ খেলা করছিল, চোখের কোণে কখনো ঝিলিক দিচ্ছিল জল। বলছিলেন বিস্তারিত বলতে গেলে অনেক সময় লাগবে, আর আমাদের হাতে এত সময়ও ছিল না।

বললেন, তার জীবনে যেসব ভয়াবহ ঘটনা ঘটেছে, যে কষ্টের মধ্যে দিয়ে যেতে হয়েছে, তা সিনেমাকে হার মানায়। তবে এ কথা স্বীকার করলেন, এভাবে না এসে যদি বৈধ পথে আসতেন, তাহলে বাবা-মাকে অন্তত শেষ দেখাটা দেখতে পেতেন। এতদিন দেশে না গিয়ে থাকতে হতো না।

এটা গেল মাত্র একজন বাংলাদেশির কথা। এমন কত শত বাংলাদেশি পুরো ইউরোপজুড়ে ঘুরে বেড়াচ্ছেন একটি দেশে আশ্রয়ের আশায়। বসনিয়ার কথা আপনারা সবাই জানেন। এসব অভিবাসন-প্রত্যাশী কিন্তু বেশ শিক্ষিত। ১৫ থেকে ১৮ লাখ টাকা খরচ করে দালাল ধরে ইউরোপ পাড়ি দিয়েছেন।

অথচ চাইলেই এর চেয়ে কম টাকায় ভাষা শিখে কোনো একটি বিশেষ কাজে প্রশিক্ষণ নিয়ে বৈধ পথে ইউরোপের কোনো দেশে আসা সম্ভব ছিল তাদের পক্ষে। হয়ত বলবেন ভাষা শেখাটা সহজ নয়।

তাহলে আমি বলবো, এখন তারা যে পরিস্থিতিতে আছেন সেটা কি সহজ! আর ইতালিতে ঘুরতে গিয়ে আমি দেখেছি অনেক স্বল্প শিক্ষিত বাংলাদেশিরা কয়েক বছরেই চমৎকার সেদেশের ভাষায় কথা বলেন। অর্থাৎ, আপনি যে কাজটা এখানে আসার পর করতে বাধ্য, সেটা আগে থেকে করলে ঝঞ্ঝাটমুক্তভাবে সম্মানের সাথে থাকার সুযোগ পাবেন।

এই যেমন ধরুন জার্মানিতে গত বছর অভিবাসনের যে নতুন আইন করা হয়েছে, তাতে কত সুবিধা আছে। এদেশে ৮ কোটি মানুষের মধ্যে দুই কোটি ৮০ লাখ মানুষ ষাটোর্ধ্ব। ফলে এখানে তরুণ জনশক্তির অভাব রয়েছে। জার্মানিতে ১০ লাখের বেশি দক্ষ শ্রমিকের অভাব রয়েছে। এই ঘাটতি পূরণে নতুন অভিবাসন আইন করা হয়, যা ২০২০ সালের ১ মার্চ থেকে কার্যকর হয়েছে।

নতুন আইনে যা আছে

১. নতুন আইনে বিশ্ববিদ্যালয় ও কলেজ ডিগ্রিধারীদের পাশাপাশি কারিগরি প্রশিক্ষণপ্রাপ্তদের জন্যও আবেদনের সুযোগ আছে। তবে এই প্রশিক্ষণের মেয়াদ কমপক্ষে দুই বছরের হতে হবে এবং এই ডিগ্রি জার্মান ডিগ্রির সমান বলে অনুমোদিত হতে হবে।

২. সার্টিফিকেট ঠিক আছে কিনা তা জার্মান শ্রম মন্ত্রণালয়ের ইনফরমেশন পোর্টালে গিয়ে যাচাই করে দেখা যাবে। কীভাবে যাচাই করা যাবে তার ব্যাখ্যা পাওয়া যাবে ‘মেক ইট ইন জার্মানি’ ওয়েবসাইটে।

৪. ইউরোপীয় ইউনিয়নের বাইরে বসবাসকারীরাও জার্মানিতে চাকরির আবেদন করতে পারবেন।

৫. কারিগরি শিক্ষার যে লেভেল ঠিক করা হয়েছে, তার চেয়ে কম যোগ্যরা চাকরির আবেদন করতে না পারলেও অভিবাসনের চেষ্টা করতে পারবেন। তবে শর্ত হচ্ছে, জার্মানির কোনো চাকরিদাতার কাছ থেকে তাদের চাকরির প্রস্তাব পেতে হবে। সেক্ষেত্রে চাকরিদাতাকে আবেদনকারীর জন্য প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করতে হবে এবং দুই বছরের মধ্যে তিনি যেন পেশাদার পর্যায়ের সার্টিফিকেট পেতে পারেন, তা নিশ্চিত করতে হবে।

৬. যারা চাকরির সুযোগ পাবেন, তাদের চার বছর কিংবা চাকরির মেয়াদ পর্যন্ত ভিসা দেওয়া হবে। চার বছর পর তারা স্থায়ীভাবে বসবাসের অনুমতির জন্য আবেদন করতে পারবেন।

৭. জার্মান ভাষায় বি২ লেভেল পর্যন্ত দক্ষতা ও নিজের খরচ বহনের সামর্থ্য থাকলে জার্মানিতে এসে চাকরি খোঁজার অনুমতিও পাওয়া যাবে।

৮. ৪৫ বছরের বেশি বয়সী আবেদনকারীদের মাসে কমপক্ষে ৩,৬৮৫ ইউরো আয় করতে হবে।

৯. জার্মানিতে যেসব খাতে দক্ষ জনশক্তির অভাব প্রকট, যেমন চিকিৎসা, তথ্যপ্রযুক্তি, নার্সিং, সেসব ক্ষেত্রে আইন একটু শিথিল করা হয়েছে। অর্থাৎ, আবেদনকারীর যদি অন্তত পাঁচ বছরের চাকরির অভিজ্ঞতা থাকে, তাহলে জার্মান কর্তৃপক্ষের দ্বারা সার্টিফিকেট যাচাইয়ের যে শর্ত, তার আর প্রয়োজন পড়বে না।

১০. যারা চাকরি পাবেন, তারা স্বামী-স্ত্রী ও সন্তানদের জার্মানি নিয়ে আসতে পারবেন। অবশ্য সেক্ষেত্রে পরিবারের সদস্যদের খরচ চালানোর সামর্থ্যের প্রমাণ দিতে হবে।

জার্মানিতে প্রায় সাত বছর থাকার পর এটা সহজেই বুঝতে পারি বৈধভাবে বিদেশে থাকাটা কত সম্মানের। বৈধভাবে অর্থ উপার্জন করছি, জার্মান সরকারকে ট্যাক্স দিচ্ছি, ফলে দুই বছরের মধ্যে পারমানেন্ট রেসিডেন্ট কার্ড পেয়ে গেছি। বি-২ পর্যায়ে ভাষা শেখা শেষ। এখন চাইলেই নাগরিকত্বের জন্য আবেদন করতে পারি। তাই রাস্তায় যখন দু-একজন বাংলাদেশিকে দেখি বোতল কুড়াতে, তখন সত্যিই কষ্ট লাগে। নিজেদের সর্বস্ব বিক্রি করে সুন্দর জীবনের আশায় ইউরোপ পাড়ি দিয়ে এ কেমন জীবন কাটাচ্ছেন তারা! সূত্র: ডয়েচে ভেলে।

এমআরএম/এমএস

প্রবাস জীবনের অভিজ্ঞতা, ভ্রমণ, গল্প-আড্ডা, আনন্দ-বেদনা, অনুভূতি, স্বদেশের স্মৃতিচারণ, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক লেখা পাঠাতে পারেন। ছবিসহ লেখা পাঠানোর ঠিকানা - [email protected]