প্রবাস জীবন মানেই সুখের অভিনয়
‘এক পরিচিত ফোন দিলে প্রায়ই বলে ভাই আমাকে বিদেশ নিয়ে যাও, দেশে আর ভালো লাগে না। আমি প্রতিবারই একই কথা বলি ব্যবসা করছেন ভালো আছেন। পারলে ব্যবসাটা আরো বড় করেন তবুও বিদেশের নাম নিয়েন না। ব্যবসা ছেড়ে বিদেশ আসা ঠিক হবে না। বিদেশ জীবন কারো জন্যই সুখকর হয় না।’
‘ভাই আমার তাচ্ছিল্য করে বলে বুঝেছি আমি বিদেশ গেলে তোদের আগে বড় লোক হইয়া যাব, এই ভয়ে নিতে চাও না। বিদেশ না নিলে না নিবি উপদেশ দেয়ার দরকার নেই। এই কথার পরিপেক্ষিতে আমার কিছুই বলার থাকে না। বলা উচিতও নয়।’
বড় ভাইকে একদিন কল করে বললাম, কি অবস্থা? কেমন আছেন আপনি?
-খুব ভালো আগামী সপ্তাহে আমার ফ্লাইট, দোয়া করিও।
-কি বলেন! কই যাবেন আপনি?
ওমান যাচ্ছি। তোমরা তো নিলে না তাই নিজে নিজেই সব ব্যবস্থা করলাম। এতদিন তো বিদেশ কথা বললে ভয় দেখিয়েছ, এখন অন্ততঃপক্ষে প্রবাস জীবন সম্পর্কে বুঝিয়ে বলো।
আমি তাকে প্রবাস জীবন সম্পর্কে তীক্ত সত্য বলতে লাগলাম। আপনার মন খারাপ কিংবা প্রচণ্ড মাথা ব্যথা করছে তখন টাইগার বাম মলম কপালে মেখে বিছানায় শুয়ে বিশ্রাম নিচ্ছেন। ঠিক তখনই আমার বেডের পাশে দাঁড়িয়ে অন্যান্য রুমমেটরা তর্কাতর্কি শুরু করে দিল। কিংবা একজন আরেকজনকে অকথ্য ভাষায় গালাগালি করছে, কেউবা বেসুরা গলায় ‘যাও পাখি বলো তারে সে যেন ভুলে মা মোরে’ গান করছে।
অনেকে হাসাহাসিতে গড়াগড়ি খাচ্ছে তখন তাদের এই আওয়াজ আপনার মস্তিষ্কে গিয়ে ধারালো ছুরি হয়ে বিঁধবে, মনে হবে কেউ একজন আপনার মস্তিষ্ক উপযুক্ত ছুরিকাঘাতে ক্ষত-বিক্ষত করছে তখন কিছু বলতে পারবেন না। নীরবে ছুরিকাঘাত সয়ে যেতে হবে। কিছু বললেই অন্য রুমমেটরা আপনার দিকে তীক্ষ্ম দৃষ্টিতে তাকাবে তখন বুঝবেন প্রবাস জীবনের মজা।
যখন চরম অসুস্থ ঘরের লাইটের আলো কাটা হয়ে চোখে বিঁধছে আপনি লাইট অব করে দিলেন তখন কেউ একজন রুমমেট অশ্লীল ভাষায় গালি দিয়ে লাইট অন করে দিল কিংবা অসুস্থতার কারণে ফ্যানের বাতাস বরফ কুচির মতো শরীরে বিঁধছে আপনি ফ্যান অফ করে দিলেন রুমের অন্য সদস্যরা ফ্যান অন করে দিয়ে বলে উঠল এতই যখন শীত করে তখন কম্বল গায়ে ঘুমাতে পারেন না। তখন বুঝবেন প্রবাস জীবন কী।
গায়ে প্রচণ্ড জ্বর মাথা তুলে বসতে পারছেন না। তখন কেউ মাথায় পানি কিংবা গামছা ভিজিয়ে শরীর মুছে দেবে না তখন অনুভব করবেন প্রবাস জীবনের স্বাদ।
যখন রাত্রীর শেষ প্রহরে আরামের ঘুম ত্যাগ করে কাজে যেতে হবে কিংবা সারাদিনের কাজ শেষে নিজে রান্না করে অথবা ক্যাটারিংয়ের স্বাদহীন খাবার মুখে দেবেন তখন বুঝবেন প্রবাস জীবনের বিষাদ।
যখন ঈদের দিন ঈদের খুশি উপভোগ না করে অফিসে যেতে হবে তখন বুঝবেন প্রবাস জীবন আসলে কী! সর্বোপরি, ১০ বছর প্রবাস জীবন শেষ করে আসার পর প্রিয়জনদের মুখে যখন শুনবেন ‘তুই আমাদের জন্য কি করেছিস, তুই তো আমাদের জন্য কিছুই করিসনি তখন হাড়েহাড়ে টের পাবেন প্রবাস জীবন কি।
তিনি আমাকে থামিয়ে দিয়ে বললেন আর তোমার লেকচার দিতে হবে না। সবার প্রিয়জন এক রকম না। আর বিদেশ যদি এত খারাপ হত তাহলে লাখ লাখ লোক বছরের পর বছর বিদেশ করত না। আর আমাকে ভয় দেখিয়ে লাভ নেই আমি বিদেশ যাবই। দোকান বিক্রি করে দিয়েছি বিদেশ ভালো না লাগলে দেশে ফিরে আবার দোকান কিনে নেব। তোমার লেকচার অন্য জায়গায় ছাড়, এই কথা বলে তিনি লাইনটা কেটে দিলেন।
তাকে বলা হলো না, একবার বিদেশ গেলে একেএকে পরিবারের সবার সমস্যা সমাধান করতে করতে বাড়ি ফেরার কথা সে ভুলে যাবে। কিংবা প্রবাসীরা সুখে নেই তবে তারা সুখী হবার ভান করে অন্য সবার চেয়ে একটু ভালো। তাই বিদেশ যাবার আগে সুখী হবার অভিনয় শিখে যান!
চলবে....
এমআরএম/এমএস