ক্যাথলিক তীর্থভূমি শিয়াউলিয়াইয়ের হিল অব ক্রসেসে একদিন

রাকিব হাসান রাফি
রাকিব হাসান রাফি রাকিব হাসান রাফি , স্লোভেনিয়া প্রতিনিধি
প্রকাশিত: ০৪:০১ পিএম, ১৩ আগস্ট ২০২০

হিল অব ক্রসেস খ্রিস্টান ধর্মাবলম্বী বিশেষ করে ক্যাথলিক চার্চে বিশ্বাস করে এমন মানুষের কাছে সবচেয়ে পবিত্র স্থানগুলোর মধ্যে একটি হিসেবে বিবেচিত হয়। বর্তমানে লিথুয়ানিয়ার এ দেশটির নামের সাথে ‘হিল অব ক্রসেস’ এ স্থানটি বিশেষভাবে জুড়ে আছে। এ স্থানটির বিশেষত্ব হচ্ছে এখানে বহু ক্রস রাখা আছে।

তবে কবে থেকে এ ক্রস রাখা হলো তা বলাটা একটু মুশকিল। ধারণা করা হয় ১৮৩০-১৮৩১ সালে পোল্যান্ডের অংশবিশেষ যখন রাশিয়ার আগ্রাসনের বিরুদ্ধে বিগ্রহ ঘোষণা করে (উল্লেখ্য যে সে সময় লিথুয়ানিয়া এবং পোল্যান্ড ছিলো একটি সমন্বিত রাষ্ট্র) তখন এ বিগ্রহে যারা নিহত হয় তাদের মধ্যে একটা অংশ যাদের লাশ খুঁজে পাওয়া যায়নি পরবর্তীতে তাদেরকে স্মরণ করার উদ্দেশ্যে তাদের পরিবারের লোকেরা সর্বপ্রথম এখানে ক্রস রাখা শুরু করে।

এরপর ধীরে ধীরে পরবর্তী সময়ে লিথুয়ানিয়ার বিভিন্ন রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট যেমনঃ ১৯১৮ সালে লিথুয়ানিয়ার প্রথম স্বাধীনতা সংগ্রাম, ১৯৪৪ সাল থেকে ১৯৯০ সাল পর্যন্ত তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়নের বিরুদ্ধে লিথুয়ানিয়ার আপরাইজিং মুভমেন্টসহ বিভিন্ন সময়ে প্রাণ হারানো মানুষদের স্বজনেরা তাদেরকে স্মরণের উদ্দেশ্যে এ স্থানে সমবেত হতে শুরু করে এবং এ রকম বহু ক্রস স্থাপন করে। যেহেতু সমাজতান্ত্রিক আদর্শে পরিচালিত সোভিয়েত ইউনিয়নে রাষ্ট্রীয়ভাবে সকল ধরনের ধর্ম চৰ্চা নিষিদ্ধ ছিল তাই এ স্থানটি ক্যাথলিক খ্রিস্টান সম্প্রদায়ের মানুষদের কাছে একটা সময় প্রতিবাদের স্থান হিসেবে প্রকাশিত হয় এবং ধীরে ধীরে এ স্থানটি একটি ধর্মীয়ভাবে মর্যাদা পেতে শুরু করে।

যাত্রাটি ছিল গত বছরের ডিসেম্বর মাসের প্রথম সপ্তাহে। ক্লাসের চাপ সে অর্থে ছিল না বললেই চলে। অন্যদিকে অনেকদিন ধরেই বুকের ভেতর লালন করা এক ইচ্ছে যে বাল্টিক দেশগুলো ভ্রমণ করতে হবে।

উত্তর ইউরোপে বাল্টিক সাগরের পূর্ব উপকূল ঘেঁষে অবস্থিত তিনটি দেশ লিথুয়ানিয়া, লাটভিয়া এবং এস্তোনিয়া এ তিনটি দেশকে একত্রে বলা হয় বাল্টিক স্টেট। তবে সাংস্কৃতিক এবং ভাষাগত বিষয়ের কথা বিবেচনা করলে কেবলমাত্র লিথুয়ানিয়া এবং লাটভিয়া এ দুইটি দেশই বাল্টিক রাষ্ট্র। লিথুয়ানিয়ার সাধারণ মানুষের ব্যবহৃত ভাষার নাম লিথুয়ানিয়ান এবং লাটভিয়ার সাধারণ মানুষের ব্যবহৃত ভাষার নাম লাটভিয়ান। লাটভিযান এবং লিথুয়ানিয়ান এ দুইটি ভাষা এখন পর্যন্ত এ পৃথিবীর শেষ দুইটি জীবিত ভাষা যেটি বাল্টিক ভাষাগোষ্ঠীর সদস্য এবং ধারণা করা হয় এ পৃথিবীর সবচেয়ে পুরাতন ভাষাগুলোর মধ্যে এ দুইটি ভাষা অন্যতম।

অনেক ভাষাতত্ত্ববিদের মতে, লিথুনিয়ান এবং লাটভিয়ান এ দুইটি ভাষা সংস্কৃত ভাষার থেকেও পুরোনো। অন্যদিকে এস্তোনিয়ার সাধারণ মানুষের ব্যবহৃত ভাষা এস্তোনিয়ান মূলত ফিন-ইউরালিক ভাষাগোষ্ঠীর অন্তর্গত। সাংস্কৃতিক এবং ভাষার মানদণ্ডে এস্তোনিয়া লাটভিয়া এবং লিথুয়ানিয়া থেকে আলাদা। তারপরেও দীর্ঘদিন সোভিয়েত ইউনিয়নের ফেডারেশনের অন্তর্ভুক্ত হওয়ার কারণে এবং একই সাথে দীর্ঘদিনের আন্তঃরাষ্ট্রীয় বিভিন্ন সম্পর্কের কারণে এ তিনটি দেশ একত্রে বিশ্ব মানচিত্রে বাল্টিক স্টেট নামে পরিচিতি পেয়েছে।

বাংলাদেশের মানুষ তো বটেই এমনকি ইউরোপের অনেকের কাছেও এ তিনটি দেশের তেমন পরিচিতি নেই। এর কারণ হতে পারে দেশ তিনটির ভৌগলিক অবস্থান বিশেষ করে মূল ইউরোপের দেশ বলতে আমাদের কাছে পরিচিত দেশসমূহ যেমন জার্মানি, ফ্রান্স, ইতালি, স্পেন, নেদারল্যান্ডস, গ্রেট ব্রিটেন এ সকল দেশের দেশ তিনটির অবস্থানগত দূরত্ব। পাশাপশি দীর্ঘদিন সোভিয়েত ইউনিয়নের অধীনে থাকার কারণে এক সময় সমাজতান্ত্রিক আদর্শে পরিচালিত দেশগুলো ছাড়া পৃথিবীর অন্যান্য দেশগুলো থেকে বিচ্ছিন্ন থাকার দরুণ দেশ তিনটি সে অর্থে পরিচিতি লাভ করতে পারেনি।

যদিও গড় আয় এবং অর্থনৈতিক পরিকাঠামোর বিবেচনায় এ তিনটি দেশ ইউরোপের অন্যান্য দেশ বিশেষ করে পশ্চিম ইউরোপের দেশগুলোর তুলনায় দুর্বল। যেহেতু পূর্ব ইউরোপের দেশগুলো পশ্চিম ইউরোপের দেশগুলোর তুলনায় অর্থনীতিকভাবে পিছিয়ে তাই পশ্চিম ইউরোপের দেশগুলোত আগত অভিবাসীদের একটা বড় অংশ থাকে হাঙ্গেরি, চেক রিপাবলিক, পোল্যান্ড, রোমানিয়া, বুলগেরিয়া, ইউক্রেন, সার্বিয়ার মতো পূর্ব ইউরোপের দেশগুলো থেকে।

অনেক সময় দেখা যায় কোনও একটা নির্দিষ্ট কাজের ক্ষেত্রে পূর্ব ইউরোপের দেশগুলোতে যে পরিমাণ বেতন দেওয়া হয়, পশ্চিম ইউরোপের দেশ যেমনঃ ফ্রান্স, জার্মানি, ইতালি, সুইডেন, নেদারল্যান্ডস, গ্রেট ব্রিটেন, নরওয়ে, ডেনমার্ক, অস্ট্রিয়া এ সকল দেশে ওই একই কাজের জন্য দ্বিগুণ থেকে তিনগুণ বেশি মজুরি পাওয়া যায়। তবুও কেনো জানি গ্রেট ব্রিটেন, নরওয়ে, সুইডেন এ রকম হাতেগোনা চার থেকে পাঁচটি দেশ ছাড়া পশ্চিম ইউরোপের অন্যান্য দেশে লাটভিয়ান কিংবা লিথুয়ানিয়ানদের সেভাবে চোখে পড়ে না।

অনেকদিন ধরেই পরিকল্পনা করে আসছিলাম বাল্টিক রাষ্ট্র হিসেবে পরিচিত এস্তোনিয়া, লাটভিয়া এবং লিথুয়ানিয়া এ তিনটি দেশে ভ্রমণ করার জন্য। প্রায় দেড় বছর চেষ্টা করার পর অবশেষে গেল বছরের ডিসেম্বর মাসে সফলতাও খুঁজে পেলাম। স্লোভেনিয়ার সাথে সরাসরিভাবে বাস কিংবা ট্রেনে এমনকি অ্যারোপ্লেনেও এ তিনটি দেশের সংযোগ নেই। অনেক খোঁজাখুঁজির পর অবশেষে কম খরচে ফ্লাইটের টিকিট পেয়েও গেলাম। অস্ট্রিয়ার রাজধানী ভিয়েনাতে অবস্থিত শোয়েচাট ইন্টারন্যাশনাল এয়ারপোর্ট থেকে রায়ান এয়ারে লাটভিয়ার রাজধানী রিগাতে যাতায়াত করার জন্য বাইশ ইউরোতে ফ্লাইটও পেয়ে গেলাম। তবে সমস্যা হচ্ছে খুব ভোরের ফ্লাইট আর এত ভোরে আসলে ভিয়েনাতে সেরকম পাবলিক ট্রান্সপোর্টেরও আনাগোনা চোখে পড়ে না।

Astonia1

দুপুর পৌনে তিনটার বাসে স্লোভেনিয়ার রাজধানী লুবলিয়ানা থেকে ফ্লিক্স বাসে করে রওয়ানা দিলাম অস্ট্রিয়ার রাজধানী ভিয়েনাতে। স্লোভেনিয়ার রাজধানী লুবলিয়ানা থেকে অস্ট্রিয়ার রাজধানী ভিয়েনাতে পৌঁছাতে প্রায় পাঁচ ঘণ্টার মতো সময় লাগে। কোনও উপায় না দেখে সে রাতটা শোয়েচাট ইন্টারন্যাশনাল এয়ারপোর্টে থেকে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিলাম।

শীতের দিনে ভোর ছয়টা কিন্তু সেখানে তখনও ঘুটঘুটে অন্ধকার, সোয়া দুই ঘণ্টা জার্নি শেষে আমাদের অ্যারোপ্লেন লাটভিয়ার রাজধানী রিগাতে পৌঁছাল।

রিগা এয়ারপোর্ট থেকে বাহিরে বের হওয়ার সাথে সাথে খুবই জটিল অবস্থা। প্রচণ্ড শীত আর ঠাণ্ডা বাতাস, বরফের চাঁদরে চারদিকে সব কিছু ঢেকে আছে। স্লোভেনিয়াতে আমার বাসা যে অঞ্চলে সেখানে সারা বছরই তাপমাত্রা সমভাবাপন্ন থাকে। শীত এখানে রিক্ত নয় আবার গ্রীষ্মকালেও গরমের প্রকোপ এখানে খুব বেশি একটা নয়। রিগার প্রচণ্ড শীত তাই শরীরের ভেতর নিষ্ঠুর কামড় বসালো, তবুও অভিযাত্রিক তো আর তাতে কাবু হওয়ার কথা না। রিগার ইন্টারন্যাশনাল এয়ারপোর্ট থেকে সেন্ট্রাল বাস স্টেশনের ভাড়া সোয়া এক ইউরো।

সেন্ট্রাল বাস স্টেশন থেকে সরাসরি শিয়াউলিয়াইয়ের বাস রয়েছে, আগের থেকে অনলাইনে বাসের টিকেট বুক দেওয়া ছিল। হিল অব ক্রসেসের অবস্থান লিথুয়ানিয়ার রাজধানী ভিলনিয়াস থেকে প্রায় দুইশতও বিশ কিলোমিটার উত্তর-পশ্চিমে শিয়াউলিয়াই নামক একটি ছোট শহরের কাছে। রিগা থেকে শিয়াউলিয়াই পৌঁছাতে প্রায় সোয়া দুই ঘণ্টার মতো লাগে এবং প্রায় সাড়ে বারো ইউরোর মতো বাস ভাড়ার প্রয়োজন হয়।

কৌচসার্ফিং নামে একটি জনপ্রিয় সোশ্যাল নেটওয়ার্কিং সাইট রয়েছে। ট্রাভেলারদের কাছে এ কৌচসার্ফিং বিশেষভাবে জনপ্রিয়। কেউ কোনও জায়গায় বেড়াতে গেল এবং সে সত্যি সে জায়গাটি সম্পর্কে কিংবা সেখানকার মানুষের জীবনযাত্রা কিংবা সে অঞ্চলের সংস্কৃতি সম্পর্কে বিশেষভাবে আগ্রহী। কোনও একটি নির্দিষ্ট জায়গা সম্পর্কে কিংবা কোনও একটি অঞ্চলের মানুষের সংস্কৃতিকে প্রত্যক্ষভাবে জানার সুযোগ হচ্ছে এ কৌচসার্ফিং।

আপনি একটি জায়গার নাম লিখে সেখানে সার্চ দিলেন, এরপর আপনাকে তারা কয়েকজন মানুষের প্রোফাইল দেখাবে যারা এ অঞ্চলে বসবাস করেন। ফেসবুকের মতোই আপনি তাদেরকে তখন ম্যাসেজের মাধ্যমে যোগাযোগ করতে পারেন। যদি তাদের কারও আপনাকে পছন্দ হয় এবং যেদিন আপনি সেখানে ভ্রমণ করতে যাচ্ছেন সেদিন যদি তিনি সময় বের করতে পারেন তাহলে তিনি আপনাকে নিয়ে ওই দিন ঘুরবেন, আপনাকে স্থানীয় কৃষ্টি কিংবা সংস্কৃতি সম্পর্কে ধারণা দেবেন। এমনকি ভাগ্য ভালো হলে তার বাসায় আপনি কয়েক রাত (সাধারণত দুই রাত) অতিথি হিসেবে থাকার জন্য প্রস্তাব পেতে পারেন।

কৌচসার্ফিং এর মাধ্যমে আমার সাথে পরিচয় হয়েছিলও সাউলিয়াসের, সাউলিয়াস শিয়াউলিয়াইয়ের বাসিন্দা। তিনি তার গার্লফ্রেন্ড এরিকাকে নিয়ে একটি ফ্ল্যাটে বসবাস করেন। এ বছরের স্প্রিং এ তাদের দুইজনের বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হওয়ার কথা।

শিয়াউলিয়াইয়ের অধ্যায়কে মনের ভেতর বিশেষভাবে জায়গা দিতে পেরেছি এ দম্পতির কারণে। শিয়াউলিয়াই পৌঁছানোর সাথে সাথে সাউলিয়াসের নিজের গাড়ি চেপে আসলেন আমাকে গ্রহণ করার জন্য। এরপর তাঁর বাসায় নিয়ে গেলেন, পথিমধ্যে এক জায়গায় গাড়ি পার্ক করে আমার জন্য শপিং করলেন। আমাকে একজন অতিথি হিসেবে সম্মান জানাতে তিনি কোনও কার্পণ্য বোধ করেননি। আমার উদ্দেশ্যে তারা একটি সান্ধ্যকালীন ভোজের আয়োজন করেছিলেন। আমার সাথে তারা তাদের এক বন্ধু এবং বন্ধুর গার্লফ্রেন্ডকেও দাওয়াত দিয়েছিলেন এ সান্ধ্যকালীন ভোজে।

সাউলিয়াসের বাসায় গিয়ে একটু ফ্রেশ হয়েই আমরা বেরিয়ে পড়লাম হিল অব ক্রসের উদ্দেশ্যে। তখন প্রায় সাড়ে তিনটার মতো বাজে। লিথুয়ানিয়াতে ডিসেম্বরে সাড়ে তিনটা মানে সন্ধ্যা হবে হবে এরকম অবস্থা। পথিমধ্যে সাউলিয়াস আমাকে শিয়াউলিয়াই শহরেরও কিছু জায়গা ঘুরিয়ে দেখালেন।

শিয়াউলিয়াই বর্তমানে লিথুয়ানিযার চতুর্থ বৃহত্তম শহর, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়ই আসলে এ শহরের প্রধান অংশ ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়। লাটভিয়া কিংবা লিথুয়ানিয়া অথবা এস্তোনিয়া তিনটি দেশের কোনোটিতে সে রকম কোনও উঁচু স্থান না থাকায় রাস্তার দুপাশে যেদিকে চোখ যায় শুধু সমতল ফসলের মাঠ আর বন-জঙ্গল।

শিয়াউলিয়াইয়ের সেন্টার থেকে হিল অব ক্রসেসের অবস্থান প্রায় ১১ কিলোমিটার উত্তরে। যখন আমরা সেখানে পা রাখি তখন চারদিক অনেকটা অন্ধকার হয়ে গিয়েছে। অন্ধকারের পুর চিরে যে সামান্য আলোর দেখা পেলাম তাকে অনুজীব্য করে ডিএসএলআরের সাহায্যে কোনও রকম কিছু ছবি নেওয়ার চেষ্টা করলাম।

সাউলিয়াসের সাথে কথা বলে জানতে পারলাম যে ১৯৯৩ সালে তৎকালীন সময়ের ক্যাথলিক সম্প্রদায়ের মানুষদের প্রধান ধর্মগুরু দ্বিতীয় জন পল হিল অব ক্রস ভ্রমণ করার পর এ সম্প্রদায়ের অধিভুক্ত অনেক মানুষের কাছে জায়গাটি প্রধান তীর্থস্থান হিসেবে পরিচিত পায়। ২০০০ সালের দিকে এখানে একটি আশ্রমও স্থাপন করা হয়েছে যা ‘ফ্রান্সিসকান হেরিটেজ’ নামে পরিচিত।

দশ মিনিটে পুরো জায়গাটি পায়ে হেঁটে ঘুরে ফেলা যায় তবে জায়গাটি সত্যি আমার কাছে অসাধারণ লেগেছে। কাঠ থেকে আরম্ভ করে বিভিন্ন ধরনের ধাতব দ্রব্যের সাহায্যে তৈরি একেকটি ক্রস অসাধারণ এক শিল্পকর্মের নিদর্শন। আগের রাতে তুষারপাত হওয়ায় ভেড়ার লোমের মতো সাদা তুষার, সন্ধ্যার লণ্ঠন এবং অসাধারণ শিল্পকর্মের এক একটি ক্রস একীভূত হয়ে এক অপার্থিব সৌন্দর্য্য আর ভালো লাগার অনুভূতির অবতারণা করেছিল। এখনও ক্যাথলিক ধর্মপ্রাণ অনেক মানুষই সেখানে ক্রস রাখে, তাই একটু একটু করে এ জায়গাটির পরিধিও বাড়ছে।

Astonia2

হিল অব ক্রসেস ভ্রমণ শেষে আমরা আবার সাউলিয়াসের বাসায় ফিরে আসলাম, তার গার্লফ্রেন্ড আমাদের জন্য ততক্ষণে সব আনুষ্ঠানিকতা শেষ করে রেখেছেন। তার বন্ধুও তাদের বাসায় এসে পৌঁছেছেন তার বান্ধবীকে নিয়ে। সাউলিয়াসের গার্লফ্রেন্ড এরিকা লিথুয়ানিয়ার মানুষের খাদ্যাভ্যাস সম্পর্কে বর্ণনা করতে গিয়ে বলেন যে লিথুয়ানিয়ার সাধারণ মানুষের প্রধান খাদ্য আলু এবং তাদের প্রায় প্রত্যেক খাবারে সিদ্ধ আলু দিয়ে তৈরি কোনও আইটেম থাকবেই।

এমনকি তাদের দেশের মানুষের কাছে সবচেয়ে জনপ্রিয় খাবার সেপেলিনিয়াইও আলু দিয়ে তৈরি করা হয়। লিথুয়ানিয়ার স্থানীয় ভাষায় এয়ারশিপকে সেপেলিয়ানাই বলা হয় এবং আলু দিয়ে তৈরি এ খাবারটি দেখতে অনেকটা এয়ারশিপের এর মতো বলে এ রকম নামকরণ করা হয়েছে। আমাদের জন্য তিনি আলু দিয়ে কেক তৈরি করেছিলেন, সাথে এ সেপেলিনিয়াইও ছিল। সিদ্ধ আলু দিয়েও ভিন্ন ভিন্ন স্বাদের অনেক ধরনের খাবারের আইটেম তৈরি করা যায় সেটা লিথুয়ানিয়া না গেলে জানাই হত না।

খাবারের ফাঁকে ফাঁকে বিভিন্ন বিষয় নিয়ে আলোচনা হলো। তাদের সাথে কথোপকথনের মধ্য দিয়ে আর সেটা আমার কাছে একটু বিচিত্র মনে হয়েছে। বিশ্বের বেশিরভাগ দেশেই একটি দিনকে স্বাধীনতার দিবস হিসেবে উদযাপন করা হয় কিন্তু লিথুয়ানিয়া এমন একটি দেশ যেখানে বছরে দুইটি দিনকে স্বাধীনতা দিবস হিসেবে উদযাপন করা হয়।

১৬ ফেব্রুয়ারি যেটি ‘Act of Reinstating Independence of Lithuania’ নামে পরিচিত, ১৯১৮ সালের এ দিন জার্মান শাসকদেরকে অগ্রাহ্য করে কাউন্সিল অব লিথুয়ানিয়া প্রথম তাদের স্বাধীনতা ঘোষণা করেছিল এবং পরেরটি ১৮ মার্চ যা ‘Act of Re Establishment of the state of Lithuania’ নামে পরিচিত। ১৯৯০ সালের এ দিনে লিথুয়ানিয়া তদান্তীন সোভিয়েত ইউনিয়ন থেকে বের হয়ে সর্বপ্রথম নিজেদেরকে আলাদা রাষ্ট্র হিসেবে ঘোষণা করে। বলাবাহুল্য লিথুয়ানিয়া হচ্ছে প্রথম ইউএসএর স্টেস্ট যারা সর্বপ্রথম সোভিয়েত জোট থেকে বের করে নিজেদেরকে স্বতন্ত্র স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে ঘোষণা করেছিল।

সাড়ে সাতটায় ফিরতি বাস লাটভিয়ার রিগাতে ফিরে আসার জন্য। সাউলিয়াস আমাকে তার গাড়িতে করে শিয়াউলিয়াইয়ের বাস স্টেশনে পৌঁছে দিলেন, গাড়িতে করে তার বাসা থেকে শিয়াউলিয়াইয়ের বাস স্টেশনের দূরত্ব ছয় মিনিটের মতো। বিদায়বেলা আমাকে তিনি জড়িয়ে ধরে বললেন আবার কোনও দিন লিথুয়ানিয়াতে আসবে তো। আমি উত্তর দিলাম অবশ্যই। তার বন্ধু আমাকে লিথুয়ানিয়ার একটি জনপ্রিয় চিজ রিটেইল ফ্যাক্টরি ডুইগাস প্রস্তুতকৃত চীজ উপহার দিলেন।

আমাকে তিনি বারবার বলছিলেন যে এটি না কি পৃথিবীর সেরা চিজ। আমার কাছেও এ চিজ মুখে দেওয়ার পর মনে হয়েছে সত্যি পৃথিবীর সবচেয়ে সুস্বাদু। মিষ্টি এবং নোনতা এ দুই ধরনের ভিন্ন স্বাদের সংমিশ্রণ যখন আপনার জিহ্বা স্পর্শ করবে তখন আপনার মনে হবে পৃথিবীতে এর থেকে স্বাদের কোনও কিছু হতে পারে না। আর লিথুয়ানিয়া এবং লাটভিয়া এ দুইটি দেশে আরও যে দুইটি জিনিস আমার কাছে সবচেয়ে ভালো লেগেছে তা হলো সাওয়ার ক্রিম এবং মেল্টেড চিজ।

লিথুয়ানিয়া আর লাটভিয়া ছাড়া আর অন্য কোনও দেশে আমি এ মেল্টেড চিজ খুঁজে পাইনি, সাওয়ার ক্রিম পূর্ব ইউরোপের অনেক দেশে পাওয়া গেলেও লিথুয়ানিয়া এবং লাটভিয়ার মতো করে এতো সুস্বাদুভাবে কোনও দেশ সাওয়ার ক্রিম প্রস্তুত করতে পারে না। লিথুয়ানিয়া এবং লাটভিয়া বেড়াতে গেলে সাওয়ার ক্রিম এবং মেল্টেড চিজ এ দুইটি জিনিস অবশ্যই ট্রাই করবেন। দেশ দুইটির মানুষের খাবারের সাথে এ দুইটি জিনিস বলতে গেলে অপরিহার্য উপাদান।

সামান্য কয়েক ঘণ্টার জন্য শিয়াউলিয়াইতে পা রেখেছিলাম কিন্তু সাউলিয়াস ও তার গার্লফ্রেন্ড এরিকা এবং একই সাথে তাদের বন্ধুদের থেকে যে ভালোবাসা ও উষ্ণ অভ্যর্থনা পেয়েছি সত্যি বারবার ফিরে যেতে চাইব লিথুয়ানিয়াতে। অসাধারণ সেখানে বসবাস করা মানুষগুলো। জানি না আর কোনও দিন সেখানে যাওয়া হবে কিনা তবে অবচেতন মনে বারবার আমি ফিরে যাই লিথুয়ানিয়াতে ফেলে আসা সেই সুন্দর মুহূর্তগুলোকে।

এমআরএম/পিআর

প্রবাস জীবনের অভিজ্ঞতা, ভ্রমণ, গল্প-আড্ডা, আনন্দ-বেদনা, অনুভূতি, স্বদেশের স্মৃতিচারণ, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক লেখা পাঠাতে পারেন। ছবিসহ লেখা পাঠানোর ঠিকানা - [email protected]