করোনাজয়ী স্লোভেনিয়া ও অন্যরকম ঈদ অনুভূতি

রাকিব হাসান রাফি
রাকিব হাসান রাফি রাকিব হাসান রাফি , স্লোভেনিয়া প্রতিনিধি
প্রকাশিত: ০৯:৪৫ পিএম, ২৩ মে ২০২০

‘ও মন রমজানের ওই রোজার শেষে এলো খুশির ঈদ
তুই আপনাকে আজ বিলিয়ে দে, শোন আসমানী তাগিদ’।

বছর ঘুরে আবারও মাহে রমজান, সিয়াম সাধনার পর ঈদ-উল-ফিতর আমাদের মাঝে সমাগত। আগামীকাল ইউরোপের অন্যান্য দেশের মতোও স্লোভেনিয়াতে ঈদ-উল-ফিতর উদযাপিত হবে তবে এবারের ঈদ যেনও খুশির পরিবর্তে এক হতাশার চাদরে মোড়া।

সত্যিকার অর্থে এ বছর তেমনভাবে কারও মাঝেই সে অর্থে ঈদ আনন্দ প্রতিফলিত হচ্ছে না বললে চলে। বৈশ্বিক মহামারি করোনাভাইরাস আজ গোটা পৃথিবীর মানুষের জীবনকে একটি নির্দিষ্ট স্থানে সীমাবদ্ধ করে রেখেছে। সামান্য কয়েক ন্যানোমিটারের এক আলোক আণুবীক্ষণিক বস্তুর কাছে গোটা পৃথিবীর মানুষই অসহায়।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার জরিপ অনুযায়ী সমগ্র পৃথিবীর ২১৫টি দেশ ও অঞ্চলে আজ এ করোনাভাইরাস দ্বারা সংক্রমিত হয়েছে। প্রতিদিন যেমন বিশ্বের বিভিন্ন হাজারো মানুষ এ প্রাণঘাতী করোনা দ্বারা সংক্রমিত হচ্ছেন, ঠিক তেমনিভাবে প্রতিনিয়ত ঝরে যাচ্ছে শত শত প্রাণ। গোটা পৃথিবী যেনও আজ মৃত্যুপুরী। এমনকি বিশ্ব অর্থনীতি আবারও এক ভয়াবহ দুর্যোগের সামনে দাঁড়িয়ে।

অন্য রকম এক রমজান দেখলো এবার গোটা দুনিয়াবাসী। এবার রমজানে ছিল না সে অর্থে কোনও আনুষ্ঠানিকতা। ছিল না কোনও তারাবি কিংবা জুমার আনন্দ। অনেকটা হতাশার মধ্য দিয়েই এবার রমজানকে বিদায় জানাতে হচ্ছে।

মধ্য ইউরোপের দেশ স্লোভেনিয়া বরাবর অন্য দেশ থেকে একটু ভিন্ন আমাদের দেশের মানুষের চোখে। প্রথমত এ দেশটি সে অর্থে আমাদের দেশের মানুষের কাছে পরিচিত নয়। দ্বিতীয়ত এ দেশটিতে সে অর্থে বাংলাদেশিদের বসবাস নেই। সব মিলিয়ে ৭,৮২৭.৪ বর্গমাইলের এবং একুশ লাখ জনসংখ্যাবিশিষ্ট এ দেশটিতে সব মিলিয়ে ৩০ থেকে ৪০ জনের মতো বাংলাদেশি বসবাস করেন।

ইউরোপের অন্যান্য দেশ বিশেষ করে প্রতিবেশি রাষ্ট্র ইতালি কিংবা অস্ট্রিয়া কিংবা স্পেন, ফ্রান্স, পর্তুগালের মতো স্লোভেনিয়াতে বসবাসরত বাংলাদেশিদের মধ্যে তেমন কোনও সুসংগঠিত কমিউনিটি না থাকায় এবং একই সাথে এখানে যারা প্রবাসী বাংলাদেশি রয়েছেন সামাজিক ও অর্থনৈতিক দিক থেকেও তাদের কারও তেমন শক্তিশালি অবস্থান না থাকায় ঈদের দিনও আসলে সুযোগ হয়ে উঠে না একে অন্যের সাথে এক হয়ে উৎসবের আনন্দে শামিল হওয়ার।

ঈদ আনন্দ বলতে গেলে এখানে অনেকটা একাকী। যদিও এ বছর ঈদের দিন রোববার এবং রোববার এখানে সাপ্তাহিক ছুটির দিন হিসেবে স্বীকৃত, অন্য সময় হলে দেখা যায় ঈদের দিনও অন্যান্য আট-দশটি সাধারণ দিনের মতো ব্যস্ততার সাথে অতিবাহিত হয়ে যায়। যারা শিক্ষার্থী তাদের ঈদের দিন চলে যায় ক্লাস, পরীক্ষা, থিসিস এবং ল্যাবের মধ্য দিয়ে এবং যারা কর্মজীবি তাদের জন্য ঈদের দিনটি অন্যান্য ব্যস্ত দিনগুলোর মতোই একটি অনাড়ম্বর দিন।

ইউরোপের অন্যান্য দেশের তুলনায় স্লোভেনিয়াতে করোনাভাইরাস পরিস্থিতি অনেকটা স্বাভাবিক। গত ১৫ মে ইউরোপের প্রথম কোনও দেশ হিসেবে স্লোভেনিয়া করোনাভাইরাসের এ মহামারির অবসান ঘোষণা করে। ফলে এখন থেকে দেশটিতে সব কিছু স্বাভাবিকভাবে চলতে শুরু করলেও বেশ কিছু ক্ষেত্রে এখনও কড়াকড়ি বিধিনিষেধ রয়ে গিয়েছে।

ইউরোপের অন্যান্য দেশের মতো স্লোভেনিয়ায় সে অর্থে ইমিগ্র্যান্টদের চোখে পড়ে না। স্লোভেনিয়াতে যারা বিদেশি নাগরিক রয়েছেন তাদের বেশির ভাগই মূলত এক সময় যুগোস্লাভিয়া ফেডারেশনের অন্তর্ভুক্ত ছিলো এমন দেশ যথা- ক্রোয়েশিয়া, বসনিয়া অ্যান্ড হার্জেগোভিনা, মেসিডোনিয়া, সার্বিয়া, এক সময় সার্বিয়ার দখলে থাকা আলবেনিয় অংশ যেটি আজকে কসোভো নামে পরিচিত এ সকল দেশের নাগরিক।

এটা ঠিক যে স্লোভেনিয়াতে ক্যাথলিক খ্রিস্টানিটির পর সবচেয়ে বেশি মানুষ ইসলাম ধর্মে বিশ্বাস করে এবং স্লোভেনিয়ার মোট জনসংখ্যার শতকরা আড়াই ভাগের মতো মানুষ মুসলিম সম্প্রদায়ের অন্তর্ভুক্ত। যুগোস্লাভ যুদ্ধ তথা তৃতীয় বলকান যুদ্ধের সময় সার্বদের বিভীষিকা থেকে বাঁচার জন্য বসনিয়া অ্যান্ড হার্জেগোভিনা ও কসোভো থেকে হাজারো মানুষ স্লোভেনিয়াতে পাড়ি জমিয়েছিলো নিরাপদ জীবনের সন্ধানে।

এরাই আজকে দেশটিতে বসবাসরত মুসলিম সম্প্রদায়ের প্রধান অংশ। গত শতাব্দীর ষাটের দশক থেকে স্লোভেনিয়ায় বসবাসরত ইসলাম ধর্মালম্বী মানুষেরা রাজধানী লুবলিয়ানাতে একটি অফিসিয়াল মসজিদ স্থাপনের প্রচেষ্টা চালিয়ে আসছিল। কিন্তু বিভিন্ন ধরনের আমলাতান্ত্রিক জটিলতা এবং একই সাথে দেশটির ডানপন্থি বিভিন্ন রাজনৈতিক জোটের বিরোধিতার কারণে তাদের সে প্রচেষ্টা আলোর মুখ দেখেনি।

অবশেষে দীর্ঘদিনের অক্লান্ত পরিশ্রমের পর এ বছরের ফেব্রুয়ারিতে অর্ধশতাব্দী পর স্লোভেনিয়ার রাজধানী লুবলিয়ানার শিশকাতে দেশটির ইতিহাসে প্রথম আনুষ্ঠানিক মসজিদের উদ্বোধন করা হয়। আশা ছিল যে হয়তো এবার ধুমধামের সাথে অন্তত ঈদের নামাজ আদায় করবো এ মসজিদে। অন্যান্য সময় যেটি হতো যে কোনও একটি নির্দিষ্ট বিল্ডিং থেকে একটি ফ্ল্যাট নিয়ে সেখানে মসজিদের কার্যক্রম পরিচালিত হতো।

জুমা কিংবা ঈদের নামাজ ছাড়া অন্যান্য নামাজ জামাতবদ্ধ হয়ে আদায়ের সুযোগ সে অর্থে ছিলো খুবই কম। এক বসনিয়ান বন্ধুর থেকে জানতে পারলাম করোনা পরিস্থিতির কারণে এ বছর স্লোভেনিয়ার সরকার ঈদ-উল-ফিতরের নামাজের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে। জামাতবদ্ধ জুমা এবং তারাবির নামাজবিহীন এক রমজানের পর জামাতহীন এক ঈদ-উল-ফিতরের সকাল। এমন ঈদ, এমন রমজান বোধ হয় এ শতাব্দীর কোনও মানুষই দেখেননি।

কোনও কিছু না হারালে মানুষ কোনও দিনও বুঝতে পারে না হারানোর বেদনা কতটা তীব্র হতে পারে। বাংলাদেশে থাকাকালীন মনে হতো বিদেশ মানেই সুখোলব্ধির সর্বোচ্চ অনুভূতি অথচ বিদেশে আসার পর মনে হয় সব কিছু কেবলমাত্র একটি মরীচিকা। এখন আর কেউই ঈদে নতুন জামা কিনে দেয় না। এখন আর কেউই ছেলেবেলার মতো সালামি দেয় না।

মা এর হাতে সকালে রান্না করা সেমাই কিংবা জর্দা এখন কেবল এক অলীক স্বপ্ন বৈ আর কিছুই নয়। বাবার সাথে করে এখন আর ঈদগাহে যাওয়াও হয় না, নামাজ শেষে কারও সাথে কোলাকুলিও করা হয় না। দুপুর বেলা পরিবারের সবার সাথে এক টেবিলে বসে বিরিয়ানি কিংবা পোলাও এর স্বাদও জোটে না আর। বন্ধু-বান্ধবের সাথেও ঘুরতে বের হওয়া হয় না এখন আর। ঈদ উপলক্ষে কেউ আর এখন দাওয়াত তো দেয় না। যান্ত্রিকতার ভীড়ে আসলে সকল অনুভূতি চৈত্রের দুপুরের মতো শুকিয়ে গিয়েছে।

অন্যান্য বছরে এ সময়টাতে হয়তো বা ইতালি কিংবা অস্ট্রিয়াতে চলে যেতাম। সেখানে যারা প্রবাসী বাংলাদেশি রয়েছেন তাদের সাথে করে মনে রাখার মতো একটি সময়ও অতিবাহিত করতে পারতাম। সীমান্ত সংযোগ বিচ্ছিন্ন থাকায় এ বছর ইতালি কিংবা অস্ট্রিয়াতেও যাওয়া সম্ভব হচ্ছে না। ঘরে রান্নায় ব্যবহার করার যতটুকু মশলা ছিলো সব শেষ হয়ে গিয়েছে, ইউরোপিয়ানদের মতো আধাসিদ্ধ মশলাবিহীন খাবার গিয়ে দিন কাটছে আমাদের। যা এক কথায় বিস্বাদের।

অন্যদিকে সামনে সেমিস্টার ফাইনালের চাপ আছেই। মিডটার্মে দুই সাবজেক্টে ফেল এসেছে। সেমিস্টার ফাইনালের আর বাকি আছে অল্প কিছুদিন। বাংলাদেশ ছেড়ে স্লোভেনিয়ায় এসে যখন এখানে নতুন করে অ্যাডমিশন নেওয়ার কারণে জীবন থেকে দুইটি বছর হারিয়ে গিয়েছে। পরিবার থেকে চাপ অনেক, তাড়াতাড়ি গ্র্যাজুয়েশন শেষ করতে হবে।

করোনা পরিস্থিতির কারণে সেই মার্চ থেকে ইউনিভার্সিটি বন্ধ। অনলাইনে শিক্ষা-কার্যক্রম পরিচালিত হলেও পুরো বিষয়টি ছিলও হতাশাজনক। ইউনিভার্সিটি খোলা থাকলে শিক্ষকদের তত্ত্বাবধায়নের থেকে যেভাবে ক্লাস করতে পারতাম অনলাইনে তার সিকিভাগও হচ্ছে না। চারদিকে যেখানে চোখ যায় শুধুই ঘোর অমাবস্যা ছাড়া আর কোনও কিছুই চোখে পড়ে না।

দেশে যেতে ইচ্ছে করছে ভীষণভাবে, করোনা পরিস্থিতির সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণে না আসা পর্যন্ত ফ্লাইটও ছেড়ে যাবে না বাংলাদেশ কিংবা স্লোভেনিয়ার কোনও জায়গা থেকেই। মহামারি করোনা ভাইরাস আমার মতো অনেকের জীবনটাকে সত্যি এক বন্দিদশায় ঠেলে দিয়েছে। একাকি জীবনের ক্ষত যেনও আরও গভীর হয়ে উঠেছে।

সামগ্রিক অবস্থা সম্পূর্ণভাবে সত্যি যেদিনকে সবার নিয়ন্ত্রণে আসবে এবং যেদিন সকল ফ্লাইট চলাচল পুনরায় আবার চালু করা হবে সেদিন সবার আগে আমি ছুটে যাবো আমার প্রিয় বাংলাদেশের দিকে। মা, বাবা, ছোট বোন আর নানীকে জড়িয়ে ধরবো আবার, পাশের বাসার ছোটো ভাই লাবিব আর সিয়ামের গাল দুটি টিপে দিবো আবার। যাদের সাথে জীবনে অন্যায় করেছি সকলের কাছে গিয়ে ক্ষমা চাইবো।

ঈদ সকলের জীবনে বয়ে নিয়ে আসুক অনাবিল শান্তি আর আনন্দ। মানুষের মধ্যাকার সকল ধরণের বিভেদ চিরতরে দূর হয়ে যাক। করোনাকে একটি বিশেষ কারণে ধন্যবাদ জানাতে হয় আর সেটি হচ্ছে করোনার এ পরিস্থিতির আবির্ভূত না হলে আমরা কখনও আশেপাশের মানুষের দুঃখ-কষ্টকে এভাবে সামনাসামনি প্রত্যক্ষ করতে পারতাম না।

তাই এবারের ঈদের মূলমন্ত্র হোক মানবতার কল্যাণে নিজেকে উৎসর্গ করা। সবাইকে জানাই পবিত্র ঈদ-উল-ফিতরের শুভেচ্ছা। ঈদ মোবারক

এমআরএম/জেআইএম

প্রবাস জীবনের অভিজ্ঞতা, ভ্রমণ, গল্প-আড্ডা, আনন্দ-বেদনা, অনুভূতি, স্বদেশের স্মৃতিচারণ, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক লেখা পাঠাতে পারেন। ছবিসহ লেখা পাঠানোর ঠিকানা - [email protected]