মা হাওয়ার শহর যেন এক ঘুমন্ত নগরী
মা হাওয়া (আ.) ইংরেজিতে যাকে বলে ‘ইভ’। হযরত হাওয়া (আ.) এর শহর জেদ্দা, যেখানে তিনি শায়িত আছেন। কথিত আছে, প্রথম পিতা হযরত আদম (আ.) ও প্রথম মাতা হযরত হাওয়াকে (আ.) দুনিয়ায় অবতরণ করান মহান আল্লাহ। আদমকে (আ.) শ্রীলঙ্কায় এবং হাওয়া ( আ.) সৌদি আরবের জেদ্দায়।
এখনও জেদ্দাতে মাক্ববারা হাওয়া (মা হাওয়া কবরস্থান) জনসম্মুখে শোভা পাচ্ছে। একটা সময় মা হাওয়া (আ.) এর কবর নির্দিষ্ট ছিল যার দৈর্ঘ্য ১২০মিটার প্রস্থ ৩ মিটার বিস্তৃত ছিল। ইতিহাস পর্যালোচনা করে দেখা যায়, হিজরি ষষ্ঠ শতকের আরব ভূগলবিদ ও ভ্রমণকারী ইবনে জুবায়ের মতে, জেদ্দায় ভ্রমণকালীণ মা হাওয়ার কবর নামে তিনি একটি সমাধি দেখেছিলেন। অপর আরব ভ্রমণকারী ইবনে বতুতাও জেদ্দায় মা হাওয়ার কবরের অবস্থানের বিষয়ে বলেছিলেন। তিনি হিজরি সপ্তম শতকে জেদ্দা ভ্রমণ করেছিলেন।
কথিত আছে, জেদ্দা নামের উৎস ও মা হাওয়া থেকে। ‘জেদ্দা’ আরবি শব্দ। এর অর্থ দাদি মা। হযরত হাওয়া (আ.) কে পুরো দুনিয়ার দাদিমা হিসেবে ও গণ্য করা হয় সে হিসেবে মা হাওয়ার শহরকে জেদ্দা হিসেবে নামকরণ করা হয়।
লোহিত সাগরের পাদদেশে নিতান্ত এক জেলে পল্লী থেকে গড়ে উঠা এ শহর সৌদি আরবের দ্বিতীয় বড় নগরী, শিল্প নগরী এবং প্রধান সমুদ্র বন্দর। দেশের অর্থনৈতিক রাজধানীও এই জেদ্দা। দেশটির ২য় বৃহত্তম ও ব্যস্ততম বিমান বন্দর এ জেদ্দায়।
মক্কা প্রদেশের সবচেয়ে বড় শহর, মক্কা-মদিনার দরজা খ্যাত এই জেদ্দা। যার প্রমাণ এখনো ‘বাব মক্কা’ (মক্কার প্রবেশ পথ) নামে একটি জায়গা আছে। প্রায় ১৬০০ বর্গ মাইল আয়তনের এ শহরে স্থানীয় নাগরিকসহ অভিবাসী নিয়ে প্রায় ৪৫ লাখ জনসংখ্যার বসবাস। দেশটির সর্ব বৃহৎ সমুদ্র বন্দর ও জেদ্দায় অবস্থিত। যার নাম জেদ্দা ইসলামী সমুদ্র বন্দর।
ইসলামি সহযোগিতা সংস্থা (ওআইসি) ও ইসলামি উন্নয়ন ব্যাংক (আইডিবি) এর সদর দপ্তরও এ জেদ্দায়। যেখানে প্রতিদিন পুরো বিশ্বের মুসলমানদের উন্নয়নের জন্য কাজ করে যাচ্ছে।
লোহিত সাগরের তীরে এই বন্দর শহর ১৯৮২ সাল পর্যন্ত সৌদি আরবের রাজধানী ছিল। শহরটিতে লোহিত সাগর তীরবর্তী সমস্ত দেশের মানুষের বসবাস। ফলে সাংস্কৃতিক দিক থেকে খুবই বৈচিত্র্যপূর্ণ। জেদ্দায় আসলেই দেখবেন, মিসরীয়রা খোলা জায়গায় ক্যাফেতে বসে হয় কফিতে চুমুক দিচ্ছেন অথবা হুক্কা টানছেন। কেউ আবার রাস্তার লাইট পোস্টের নিচে বসে বোর্ডগেমে মশগুল। ইয়েমেনিদের টেইলারিং দোকান রয়েছে অনেক। দেখা যাবে সেসব দোকানে মেঝেতে বসে অনেক রাত পর্যন্ত তারা পোশাক সেলাই করছেন।
জেদ্দার ফুটপাতে চোখে পড়বে হরেক রকম মসলা নিয়ে বসেছেন জিবুতি, এরিত্রিয়া এবং সোমালি নারীরা। জেদ্দার পুরনো শহরের পাথরে তৈরি সরুর সরু গলিতে আরবির সাথে সাথে আকছার আপনার কানে আসবে ইথিওপিয়ার ভাষা থেকে শুরু করে হিন্দি শব্দ। জেদ্দায় রয়েছে দৃষ্টিনন্দন সমুদ্র সৈকত এবং সৈকত এলাকায় রয়েছে পৃথিবীর সর্বোচ্চ ঝর্না ‘কিংস ফাউন্টেন বা রাজকিয় ঝর্না’
জেদ্দার অনেক আকর্ষণের মধ্যে কিংস ফাউন্টেন অন্যতম। কারণ এটিই পৃথিবীর সর্বোচ্চ ঝর্না। জেট প্রপেলারের সাহায্যে পরিচালিত এই ঝর্না সমুদ্রও পৃষ্ঠ থেকে ৮৫৩ ফুট উচ্চতায় পানি নিক্ষেপ করতে পারে। লোহিত সাগরে অবস্থিত এই চমৎকার ঝর্না পর্যটকদের কাছে খুবই আকর্ষণীয়। সাগরের লোনা পানি ব্যাবহার করে চলা এই ঝর্নাটিকে জেদ্দা শহরের প্রায় সব জায়গা থেকেই দেখা যায়।
বিশেষ করে রাতের বেলা এই ঝর্নার সৌন্দর্য অনেকগুন বেড়ে যায় যখন এর সাথে বিভিন্নও রঙের আলো সংযুক্ত করা হয়। হাজার হাজার দর্শনার্থী প্রতিদিন ভিড় জমায় এর সৌন্দর্য্য উপভোগ করার জন্য।
অনেকটা শপিং প্রিয় বিলাসী আরবীয়দের জন্য গড়ে উঠেছে জেদ্দা শহরে অনেক দৃষ্টিনন্দন শপিংমল । যেমন- রেডসি মল, কুর্নিশ মল ইত্যাদি। কয়েকটি শপিং মলের সমাহার নিয়ে জেদ্দা দক্ষিণাঞ্চলে গড়ে উঠেছে হারেস সাওয়ারিখ শপিং সেন্টার। যেখানে ক্রেতা-বিক্রেতা মিলে প্রতিদিন হাজার হাজার মানুষের জনাসমাগম হয়। যেখানে কাজ করে হাজার হাজার প্রবাসী। এই হারেস সাওয়ারিখে কয়েক হাজার প্রবাসী বাংলাদেশির নিজ ব্যবসা এবং চাকরির সুবাদে আনাগোনা হয় প্রতিনিয়ত। পুরো জেদ্দাজুড়ে বিভিন্ন কোম্পানি এবং দৈনিকভিত্তিক কাজ করে হাজার হাজর প্রবাসী বাংলাদেশি।
জেদ্দায় কয়েকটি এলাকা আছে। এগুলোকে আরবি অনারবি সবাই বাংলা মার্কেট বলে চিনি। যেমন গুরাইয়াত, গুলাইল। আজ জেদ্দা তথা পুরো সৌদি আরব যেন ঘুমন্ত শহর। মহামারি করোনার কাছে জেদ্দা তথা পুরো বিশ্ব ধরাশায়ী।
জেদ্দায় গড়ে উঠেছে ছোট বড় মিলে হাজার হাজার মসজিদ যেখানে জমায়েত হয় লাখ লাখ মুসল্লি। মসজিদের মিনার থেকে সুললিত কণ্ঠে প্রাণ আকুল হওয়া সুমধুর আজানের ধ্বনি ভেসে আসলেও। আজান পরবর্তী মুয়াজ্জিনের কান্না জড়িত কন্ঠে ঘোষণা হয় ‘ঘরে নামাজ পড়ুন’।
অরুনাভ অরুনিমা ছড়িয়ে সকালের আগমনী বার্তা দিলে ও শহুরেদের সেই সকাল সকাল কাজে বের হওয়ার তাড়া আজ আর নেই। শহরের ব্যস্ততা আর বাড়ে না।ঊর্ধ্বশ্বাসে কাউকে আর গন্তব্যে ছুটতে দেখা যায় না। সবাই ঘরের দরজার বন্ধ করে বসে আছে। নেই আজ ঐতিহ্যের শহর জেদ্দার বৈচিত্র্য, নেই আজ কোলাহল, নেই বিমান বন্দরের ফ্লাইট উঠানামা।
নেই সমুদ্র সৈকতের পর্যটকদের আনাগোনা, নেই ওমরা হাজীদের পদচারণায় মুখরিত হওয়া জেদ্দা হজ্ব টার্মিনাল। নেই সেই সকাল থেকে বিভিন্ন ক্যাপ্টেরিয়ার লাইনে দাঁড়ানো কাস্টমার। নেই সেই কফি হাউসে আরবীয়দের আড্ডার ফাঁকে ফাঁকে হুক্কার টান আর বের হয় না মুখ থেকে ক্যাপিচিনোএবং এক্সপ্রেসোর ধোঁয়া। আর শোনা যায় না কাপ পিরিচের টুংটাং শব্দ। নেই পার্কের সেই কোলাহল। দেখা যায় না আর সেই আরবীয়দের পরিবার পরিজন নিয়ে ফ্লাক্স ভরে চা খাওয়া (এক প্রকার উঞ্চ পানীয়) নিয়ে পার্কে বসে খেতে খেতে নির্মল হাওয়ায় ঘা ভেসে দেওয়া।
নেই সেই জেদ্দার ফুটপাতে বসে থাকা হরেক রকম মসলা নিয়ে জিবুতি, এরিত্রিয়া এবং সোমালি নারীরা। শোনা যায় না এখন, জেদ্দার পুরনো শহরের পাথরে তৈরি সরুর সরু গলিতে আরবির সাথে ইথিওপিয়ার ভাষা থেকে শুরু করে হিন্দি ভাষার শব্দ।
বৈশ্বিক মহামারি করোনাভাইরাসের কাছে অসহায় পরাজয় বাঘা বাঘা শক্তিশালী দেশ থেকে শুরু করে গোটা বিশ্ব। অবরুদ্ধ পুরো দূনিয়া। মৃত্যুর ভয়ে তটস্থ তামাম জাহান। তদ্রূপ ঐতিহাসিক জেদ্দা শহর এর ব্যতিক্রম নয়। জেদ্দা তথা পুরো সৌদি আরবজুড়ে করোনার সংক্রমণের বিস্তার ঠেকাতে প্রায় ১ মাস যাবৎ দেশটির সরকারি আধা-সরকারি ও বেসরকারি অফিস আদালত, স্কুল কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয় সকল শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ রয়েছে।
জেদ্দা শহরে অনির্দিষ্টকালের জন্য ২৪ ঘণ্টা কারফিউ বলবৎ রয়েছে। মনে হচ্ছে এই ঐতিহ্যপূর্ণ মা হাওয়ার শহর যা গোটা দুনিয়াজুড়ে স্বমহিমায় দাঁড়িয়ে থাকা এ শহর; যেন আজ অদৃশ্য মানব এক মহাশক্তির কাছে অসহায় পরাজয় বরণ করেছে। পুরো শহর যেন সুনসান নীরবতার চাদরে ঢাকা এক ঘুমন্ত নগরী।
জেদ্দা শহর তথা পুরো সৌদি আরবে স্থানীয় নাগরিকসহ প্রবাসীরা ঘরবন্দি হয়ে পড়েছে। নিজ ঘরে সবাই অবরুদ্ধ। হতাশা আর ভয় যেন পিছু ছাড়ছে না প্রবাসীদের। কর্মক্ষেত্র বন্ধ থাকায় কর্মহীন হয়ে পড়েছে লাখ লাখ প্রবাসী। অনেকের জমা টাকা ফুরিয়ে এসেছে।এ অবস্থায় প্রবাসী বাংলাদেশিরাও থাকা-খাওয়ার ব্যয় নির্বাহ নিয়ে পড়েছেন দুশ্চিন্তায়। মাস শেষে কীভাবে পরিশোধ করবে বাসা ভাড়া, কোথা থেকে যোগাড় করবে মেস বিল, পানির বিল,বিদ্যুৎ বিল।
প্রতিনিয়ত নিজের মধ্যে এসব প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে খুঁজতে দিন যায় রাত আসে। অপেক্ষার প্রহর শেষ হয় না। ইতোমধ্যে ‘লক ডাউন’ এর ফলে কিছু কিছু প্রবাসী আয়-রোজগারবঞ্চিত হয়ে দুর্বিষহ দিন যাপন করছেন। অনেক প্রবাসী আছেন যারা প্রতিমাসে দেশে টাকা পাঠালে, সেই টাকায় তাদের সংসার চলে। চলে বাচ্চাদের বা ছোট ভাই-বোনের লেখাপড়ার খরচ। চলে বৃদ্ধ মা-বাবা পরিবার-পরিজনের ওষুধ খরচ।
এই প্রবাসীরা সারারাত নির্ঘুম কাটায়। তাদের নয়নের দুই পাতা এক হয় না দুশ্চিন্তায়। এভাবে চলতে চলতে যদি আরও কয়েক মাস অতিবাহিত হয় তখন কী হবে? কীভাবে জোগাড় হবে তাদের দেশে রেখে আসা সংসারের ব্যয়? কোথা থেকে আসবে বাচ্চাদের লেখাপড়ার খরচ? কী উপায়ে আসবে বাবা-মার ওষুধের টাকা?
প্রবাসীদের বুকে জমে থাকা কষ্ট কেউ বুঝতে পারে না। হাজারো কষ্ট, প্রবঞ্চনা, বৈষম্য এবং দুশ্চিন্তার বোঝা মাথায় নিয়েও প্রতিনিয়ত আপনজনদের স্বপ্ন পূরণে নিজেকে স্বপে দেয়। হাসিমুখে বলে ‘আমি ভলো আছি। ‘দুশ্চিন্তা করো না’।
দু:খ লাগে তখন যখন প্রবাসীদের হেয় করে কথা বলে কিছু সুবিধাবাদী মানুষ। করোনায় প্রবাসীদের আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছেন ওইসব অতি উৎসাহী স্বার্থপরদের যারা দোকানে লিখে রাখেন ‘প্রবাসীদের প্রবেশ নিষেধ’। অথচ প্রবাসী তথা প্রবাসীদের প্রেরিত রেমিট্যান্স অর্থনীতির অন্যতম চালিকাশক্তি।
এই করোনা মহা দুর্যোগের সাগরে হাবুডুবু খেতে খেতে প্রবাসীরা ধার-দেনা করে হলেও দেশে টাকা পাঠানোর জন্য চেষ্টা করতে কৃপণতা করছে না ।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক কয়েকজন প্রবাসী বলেন, ভাই লজ্জার কথা এক মাস হয়ে গেছে বেকারত্বের বোঝা কাঁধে নিয়ে দিন যাপন করছি। জমা টাকা শেষ হয়ে আসছে। নিজে কী খাব? বাড়িতে কী পাঠাব? বাসা ভাড়াই কীভাবে দেব? ইত্যাদি। কত দিন এভাবে থাকবে?
এমআরএম/এমএস