চরম অব্যবস্থাপনা ও হট্টগোলে শেষ হলো নিউইয়র্কের ফোবানা সম্মেলন

কৌশলী ইমা কৌশলী ইমা , যুক্তরাষ্ট্র প্রতিনিধি
প্রকাশিত: ০৯:১৫ এএম, ০৩ সেপ্টেম্বর ২০১৯

চরম অব্যবস্থাপনা ও হট্টগোলের মধ্য দিয়ে শেষ হয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের ফেডারেশন অব বাংলাদেশি অ্যাসোসিয়েশন ইন নর্থ আমেরিকা (ফোবানা) সম্মেলন। চরম অব্যবস্থাপনার কারণে এটাকে ‘ব্যর্থ সম্মেলন’ বলে আখ্যায়িত করেছেন অনেকে।

শুক্রবার (৩০ আগস্ট) শুরু হওয়া এ সম্মেলন রোববার (১ সেপ্টেম্বর) শেষ হয়। নিউইয়র্কে অনুষ্ঠিত তিন দিনের পৃথক দুটি ফোবানা সম্মেলনে যা ঘটেছে তা গত ৩২ বছরে আর কখনোই ঘটেনি। চরম অব্যবস্থাপনা, অনিয়ম আর দর্শক-শ্রোতাদের জিম্মি করার ঘটনা দিয়ে শেষ হয়েছে প্রবাসে বাংলাদেশিদের মিলনমেলা নামে পরিচিত এ ফোবানা সম্মেলন। গত ৩০ আগস্ট নিউ ইয়র্কের লং আইল্যান্ডের নাসাউ কলিসিয়াম ও লাগোর্ডিয়া ম্যারিয়ট হোটেলে শুরু হওয়া ৩৩তম ফোবানার পৃথক পৃথক দুটি সম্মেলনের আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করা হয়।

আজ থেকে ৩২ বছর আগে ১৯৮৭ সালে ওয়াশিংটন ডিসি থেকে যাত্রা শুরু হয়েছিল এই ফোবানা সম্মেলনের। নিউইয়র্কের নাট্য ও সাংস্কৃতিক সংগঠক ড্রামা সার্কলের আয়োজনে এবারে ৩৩তম ফেডারেশন অব বাংলাদেশি অ্যাসোসিয়েশন্স ইন নর্থ আমেরিকার (ফোবানা) সম্মেলনের ৩ দিনেই লোক সমাগম ছিল একেবারেই কম। ১৭ হাজার আসনবিশিষ্ট নিউইয়র্কের লং আইল্যান্ডের নাসাউ কলিসিয়ামের মিলনায়তনে তিন দিনে প্রতিদিন গড়ে লোক সমাগম হয়েছিল ৭০০-৮০০। টিকিট কেটে ভেতরে ঢোকার পর প্রকৃতির ডাকে সাড়া দিতে কেউ বাইরে গেলে পুনরায় আর ভেতরে ঢুকতে পারবে না-এমন শর্ত জুড়ে দেয়া হয় দর্শকশ্রোতাদের। ফলে সাধারণ দর্শকরা নিরাপত্তাকর্মীদের হাতে জিম্মি হয়ে পড়েন।

ফোবানা কর্তৃপক্ষের এ ধরনের কর্মকাণ্ডে ক্ষুব্ধ হয়েছেন শতশত দর্শক। মিলনায়তনের ধারণক্ষমতা ১৭ হাজার কিন্তু লোক সমাগম ঘটে মাত্র ৭০০-৮০০, যা দেখে মনে হয়েছিল মিলনায়তনের একটি কোণাও ভরেনি। আর এ কারণেই এবারের নিউইয়র্কের ফোবানা সম্মেলনকে যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাসে সবচেয়ে ‘চরম ব্যর্থ’ বলে মন্তব্য করেছেন অনেকেই।

Fobana

রোববার তৃতীয় দিনের অনুষ্ঠানসূচিতে থাকা তপন চৌধুরী, রিজিয়া পারভীন, বেবী নাজনীন, ফাহমিদা নবী, সামিনা চৌধুরী ও শুভ্র দেবসহ জনপ্রিয় শিল্পীদের গান শুনতে বিভিন্ন অঙ্গরাজ্য থেকে ছুটে আসেন প্রবাসীরা। নির্ধারিত মূল্যে টিকিট কেটে ভেতরে প্রবেশ করেন। শিল্পীদের মঞ্চে ওঠার অপেক্ষায় প্রহর গুনতে থাকেন। কিন্তু ফোবানার পৃষ্ঠপোষকদের খুশি করতে আয়োজকদের অহেতুক ও অগোছালো কর্মসূচি দেখে দর্শকশ্রোতারা উত্তেজিত হয়ে পড়েন।

পৃষ্ঠপোষকদের ‘গুণগান’ করতেই অনুষ্ঠানের অধিকাংশ সময় নষ্ট হয় যায়। অল্প সময়ে ঠিকমতো গান গাইতে না পেরে ঢাকা থেকে আগত শিল্পীরা ক্ষুব্ধ হয়ে পড়েন। এ ছাড়াও প্রিয় শিল্পীদের গান শুনতে না পেরে দর্শকশ্রোতারাও হতাশ হয়ে বাড়ি ফেরেন।

দুদিনে অডিটোরিয়ামের ভাড়া বাবদ গুনতে হয়েছে তিন লাখ ডলার। ব্যক্তিগত ক্ষোভ আর ক্রোধের বশবর্তী হয়ে একই শহরে আরেকটি ফোবানা সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়েছে লাগোর্ডিয়া ম্যারিয়ট হোটেলে। চরম অব্যবস্থাপনা, অনিয়ম আর দর্শকশ্রোতাদের জিম্মি করার ঘটনার মধ্য দিয়ে শেষ হওয়া ফোবানা সম্মেলনের ভবিষ্যৎ নিয়ে নানা প্রশ্ন দেখা দিয়েছে।

৩৩তম ফোবানার আয়োজক ছিল নিউইয়র্কের নাট্য সংগঠন ড্রামা সার্কেল। সবার সেরা হতে সংগঠনটি ভেন্যু হিসেবে বেছে নেয় লং আইল্যান্ডের নাসাউ কলিসিয়ামের মিলনায়তন। দুদিন অর্থাৎ দ্বিতীয় ও তৃতীয় দিনের ভাড়া বাবদ আয়োজকদের গুনতে হয়েছে ৩ লাখ ডলার, যা বাংলাদেশি অর্থে ২ কোটি ৫৩ লাখ ৫৩ হাজার টাকা। নাট্য সংগঠন ড্রামা সার্কলের অনভিজ্ঞতা এবং দুর্বল প্রচারের কারণে প্রায় ১৭ হাজার আসন ক্ষমতার মিলনায়তনে দ্বিতীয় দিনে ৮ থেকে ১ হাজার দর্শকে উপস্থিতি দেখা গেছে। তৃতীয় দিনে তপন চৌধুরী, বেবী নাজনীন, রিজিয়া পারভীন, ফাহমিদা নবী, সামিনা চৌধুরী ও শুভ্র দেবসহ জনপ্রিয় শিল্পীদের কথা প্রচার করায় দুই থেকে আড়াই হাজার দর্শকের উপস্থিতি দেখা গেছে। কিন্তু তাদেরও হতাশ করেছেন আয়োজকরা। একটি দেশাত্মবোধক গান গাইবার পর জনপ্রিয় সঙ্গীতশিল্পী বেবী নাজনীনকে মঞ্চ ছাড়তে বলায় তিনি ক্ষুব্ধ হয়ে উঠেন।

বেবী নাজনীন মঞ্চ ছাড়ার আগেই মাইক হাতে নেন তপন চৌধুরী। তার একটি গান শেষ না হতেই মঞ্চে এসে তার সঙ্গে গলা মেলান আরেক জনপ্রিয় শিল্পী রিজিয়া পারভীন। এর আগে মঞ্চে একটি গান গেয়ে বিদায় নেন শুভ্র দেব।

Fobana

প্রয়াত শিল্পী মাহমুদুন্নবীকে সম্মাননা জানায় ড্রামা সার্কল। তার দুই মেয়ে জনপ্রিয় সঙ্গীতশিল্পী ফাহমিদা নবী ও সামিনা চৌধুরী সময় স্বল্পতার কারণে খালি গলায় দুই লাইন গেয়ে মঞ্চ থেকে বিদায় নেন। অথচ ফোবানা সম্মেলনের টাইটেল স্পন্সর হওয়ায় টাউন এমডি পক্ষের কর্ণধার রাহাত আল মুক্তাদিরের কবিতা এবং তার ছোট ভাই ফুয়াদ ও বন্ধুরা ব্যান্ডের গান গেয়ে পার করেছেন পুরো একটি ঘণ্টা। এসব নিয়ে দর্শকেরা ক্ষুব্ধ হন। শুরু করেন হট্টগোল।

অপরদিকে, কলকাতার জনপ্রিয় সঙ্গীতশিল্পী ইমন চক্রবর্তীকেও একটি পুরো এবং পরে অর্ধেক বাংলা গান গেয়ে মঞ্চ থেকে বিদায় নিতে হয়েছে। ইমন চক্রবর্তীকে ‘দেড়টি’ গান গাওয়ার জন্য সম্মানী দিতে হয়েছে আট হাজার ডলার বা ৬ লাখ ৭৬ হাজার ৮০ টাকা। বাংলাদেশের জনপ্রিয় দুইজন শিল্পী অভিযোগ করেছেন, তাদের বেলায় প্রাপ্য সম্মানী দেয়া হয়নি।
অনুষ্ঠানের সময় যখন শেষের পথে দর্শকেরা যখন প্রিয় শিল্পীদের গান শোনার জন্য অধীর অপেক্ষায়, তখনই মঞ্চে আসেন ফোবানা কর্মকর্তারা। তারা নতুন কমিটি এবং পরবর্তী ফোবানা সম্মেলনের কথা ঘোষণা করেন।

কর্মকর্তাদের ‘অতিকথনে’ দর্শকেরা ক্ষোভ প্রকাশ করলে আয়োজক সংগঠন ড্রামা সার্কলের সভাপতি ও ফোবানার সদস্য সচিব আবীর আলমগীর বলেন, ‘এটা ফোবানা কনসার্ট নয়, সম্মেলন। অতএব, আমাদের কথা শুনতে হবে।’ তার এ কথায় দর্শকেরা চিৎকার করে প্রতিবাদ জানাতে শুরু করেন।

মিলনায়তরে ভেতরে যখন ‘হ-য-ব-র-ল’ অবস্থা, বাইরে এক্সপো সেন্টারে তখন তীব্র হট্টগোল চলছিল। অর্ধশতাধিক স্টল মালিক মিলনায়তনের প্রধান ফটকের বাইরে বিক্ষোভ করছিলেন। তাদের হাতে নাজেহাল হয়ে পড়েন ফোবানার আয়োজক সংগঠন ড্রামা সার্কলের সাধারণ সম্পাদক পলাশ পিপলু। স্টল মালিকদের অভিযোগ, ১০-১২ হাজার লোকের উপস্থিতি ঘটবে বলে তাদের কাছ থেকে ২ হাজার ও ১ হাজার ডলার মূল্যে স্টল বরাদ্দ দেয়া হয়েছে। কিন্তু প্রবাসীদের স্বল্প উপস্থিতির কারণে তাদের স্টলের ভাড়াই ওঠেনি। পরে নাসাউ কলিসিয়ামের নিরাপত্তা কর্মীদের মধ্যস্থতায় আয়োজকরা ক্ষতিপূরণ দেয়ার অঙ্গীকার করলে স্টল মালিকরা শান্ত হন।

Fobana

তবে প্রতিশ্রুতি মোতাবেক তাদেরকে ক্ষতিপূরণ দেয়া হবে কি না তা নিয়ে আশঙ্কা করেছেন অনেকেই। কারণ ইতোপুর্বে অনেক ফোবানা সম্মেলনে এমন ঘটনা ঘটেছে। আ-দৌ কেউ তাদের ক্ষতিপূরণের অর্থ ফেরত পাননি।

এদিকে, ‘৩৩তম ফোবানা কনভেনশন’ নামে আরেকটি আসর বসেছিল নিউইয়র্কের লাগোর্ডিয়া ম্যারিয়ট হোটেলে। এর আয়োজক বাংলাদেশি আমেরিকান ফ্রেন্ডশিপ সোসাইটি। শুক্রবার সন্ধ্যায় কনভেনশনের উদ্বোধন করেন বিএনপির কেন্দ্রীয় ভাইস চেয়ারম্যান ও ঢাকার সাবেক মেয়র সাদেক হোসেন খোকা। অনুষ্ঠানের শেষদিনে বাংলাদেশিদের উপস্থিতি ছিল আরও হতাশাজনক। স্বল্প পরিসর, অগোছালো অনুষ্ঠানসূচি আর অপেশাদার শিল্পীর গান নৃত্য বিএনপির নেতাকর্মীদের মঞ্চে দাপাদাপিতে বিএনপির ‘কর্মী সম্মেলনে’ পরিণত হয়েছিল এ সম্মেলন। তবে এ অনুষ্ঠানটি ছিল সবার জন্য উন্মুক্ত। নিউইয়র্কের স্থানীয় শিল্পীরা সঙ্গীত ও নৃত্য পরিবেশন করেন।

এসআর/এমকেএইচ

প্রবাস জীবনের অভিজ্ঞতা, ভ্রমণ, গল্প-আড্ডা, আনন্দ-বেদনা, অনুভূতি, স্বদেশের স্মৃতিচারণ, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক লেখা পাঠাতে পারেন। ছবিসহ লেখা পাঠানোর ঠিকানা - [email protected]