রোহিঙ্গা সংকটে বাংলাদেশ
মিয়ানমারে ৭০০-৮০০ বছর ধরে বসবাসরত রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীদের সামরিক অভিযান, গণহত্যা বাড়িঘর জ্বালিয়ে চরম আতঙ্ক সৃষ্টি করে বাংলাদেশে বিতাড়িত করেছে। রোহিঙ্গাদের দুর্দশা অবর্ণনীয়। বিশ্বজুড়ে জনগণ মিয়ানমার সরকারের ভূমিকার নিন্দায় জানাচ্ছে।
রোহিঙ্গাদের বিতাড়িত করে সমস্যা বোঝার জন্য তাদের ইতিহাস নিয়ে বহু তথ্য প্রচারমাধ্যমে আসছে। নানা মহলের গবেষণার মাধ্যমেও উন্মোচিত হচ্ছে তথ্য ও ঘটনা। এসবের মধ্যে নানা মতলবে কোনো কোনো মহল থেকে মিথ্যা প্রচার দিয়ে সমস্যাকে জটিলও করে তোলা হচ্ছে।
রোহিঙ্গা সমস্যার বিষয়ে যেসব তথ্য সামনে এসেছে তাতে বোঝা যায়, সমস্যা অতি পুরনো ও অত্যন্ত জটিল। ৭০০-৮০০ বছর ধরে রোহিঙ্গারা মিয়ানমারের রাখাইন বা আরাকানে বসবাস করা সত্ত্বেও মিয়ানমার সরকার তাদের নাগরিক বলে স্বীকার করছে না। বৃহৎ শক্তিগুলো নিজেদের স্বার্থে সমস্যাটিকে ব্যবহার করে আসছে।
কফি আনানের নেতৃত্বে গঠিত কমিশন যে সুপারিশ ঘোষণা করেছিল, বাংলাদেশ তা বাস্তবায়নের জন্য চেষ্টা করে আসছে। এখনো সফল হয়নি। বৃহৎ শক্তিগুলোর কূটনীতি সমস্যাকে জটিল করে চলেছে। মিয়ানমার সরকারের বেপরোয়া ভূমিকার সামনে বাংলাদেশ সরকারকে অসহায়ের মতো দেখা যাচ্ছে।
রাশিয়া, চীন ও ভারত মিয়ানমারের পক্ষ অবলম্বন করে সমস্যার সমাধানের কথা বলছে। অনেক সরকার ও কর্তৃপক্ষ সম্পূর্ণ মানবিক বিপর্যয় দেখে সেদিক থেকে সমস্যার সমাধানের কথা বলছে। ইন্দোনেশিয়া, মালয়েশিয়া, তুরস্ক প্রভৃতি রাষ্ট্র বাংলাদেশের সঙ্গে থেকে সমস্যার সমাধানের কথা বলছে। যুক্তরাষ্ট্র ও জাতিসংঘ বাংলাদেশের ভূমিকার খুব প্রশংসা করছে কিন্তু যুক্তরাষ্ট্রের কথার ওপর আস্থা রাখা যায় না। আর জাতিসংঘে তো শেষ পর্যন্ত সাম্রাজ্যবাদী রাষ্ট্রগুলোরই সংঘ।
এদিকে রোহিঙ্গা ও অন্যান্য সংখ্যালঘু মুসলিম সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে গণহত্যার অপরাধে মিয়ানমার সরকারকে দোষী সাব্যস্ত করা হয়েছে আন্তর্জাতিক গণ-আদালতে। পার্মানেন্ট পিপলস ট্রাইব্যুনালের সাত সদস্যবিশিষ্ট প্যানেল ২০১৭ সালের (২২ সেপ্টেম্বর) এই রায় ঘোষণা করেন। সহিংসতার শিকার মিয়ানমারের রোহিঙ্গা, কাচিন ও অন্যান্য সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের ২০০ জনের সাক্ষ্য এবং তথ্যপ্রমাণের ভিত্তিতে এই রায় দেয়া হয়।
মালয়েশিয়ার রাজধানী কুয়ালালামপুরের মালায়া বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রধান বিচারক ড্যানিয়েল ফেইয়ারস্টেইনের নেতৃত্বে সাত সদস্যের একটি বেঞ্চ এ রায় দেন। রোমভিত্তিক প্রতীকী এই আদালতের নাম পার্মানেন্ট পিপলস ট্রাইব্যুনাল (পিপিটি)। বিগত শতাব্দীর ষাটের দশকে ভিয়েতনাম যুদ্ধের সময় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সেখানে ব্যাপক হারে যুদ্ধাপরাধ করে। তখন ব্রিটিশ দার্শনিক বার্ট্রান্ড রাসেল যুদ্ধাপরাধের বিচারের জন্য যে ধারণা দিয়েছিলেন, তার প্রেক্ষাপটেই পিপিটি প্রতিষ্ঠিত।
এ আদালত মূলত যুদ্ধাপরাধের শিকার মানুষের ভাষ্য তুলে ধরে বিশ্ব পরিমন্ডলে। কুয়ালালামপুরের মালয় বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন অনুষদে আর্জেন্টাইন ইন্টারন্যাশনাল অ্যাসোসিয়েশন অব জেনোসাইড স্কলারসের সাবেক প্রেসিডেন্ট বিচারক দানিয়েল ফিয়েরেস্তেইন রায় পড়ে শোনান।
আর্জেন্টাইন বিচারক ড্যানিয়েল বলেন, মিয়ানমার সরকার গণহত্যা, যুদ্ধাপরাধ এবং মানবতার বিরুদ্ধে করা অপরাধে দোষী সাব্যস্ত হয়েছে। মিয়ানমারে থাকা কাচিন এবং মুসলিম সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে গণহত্যা চালানোর অপরাধে সে দেশের সরকারকে দোষী সাব্যস্ত করে রায় দিয়েছেন ট্রাইব্যুনাল। এই প্রতীকী বিচারের রায় মানার কোনো আইনি বাধ্যবাধকতা কারও নেই। তবুও বিভিন্ন দেশে যুদ্ধাপরাধ তদন্ত-প্রক্রিয়ায় যুক্ত আইনবিদ, অধিকারকর্মী ও গবেষকরা এই গণ আদালতে মিলিত হয়েছিলেন মিয়ানমারের রোহিঙ্গাদের ওপর চলমান দমনাভিযান বন্ধের দাবি নিয়ে।
পিপলস ট্রাইব্যুনালের আমন্ত্রণে বাংলাদেশের জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান কাজী রিয়াজুল হকও এই শুনানিতে বিবৃতি দেন। সেপ্টেম্বরের দ্বিতীয় সপ্তাহে কক্সবাজারে রোহিঙ্গাদের কয়েকটি আশ্রয়কেন্দ্র ঘুরে দেখার অভিজ্ঞতা তিনি কুয়ালালামপুরে তুলে ধরেন। রায়ের পাশাপাশি পার্মানেন্ট পিপলস ট্রাইব্যুনাল ১৭টি সুপারিশ করেছে। অস্ট্রেলিয়ার সিডনির মেকুইয়ার বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের সাবেক প্রধান বিচারক গিল এইচ বোয়েরিঙ্গার কয়েকটি সুপারিশ ঘোষণা করেন।
তিনি বলেন, মিয়ানমারে রোহিঙ্গা, কাচিন ও অন্যান্য স¤প্রদায়ের বিরুদ্ধে সহিংসতার অনুসন্ধানের জন্য জাতিসংঘের তথ্য অনুসন্ধান দলকে অবশ্যই সে দেশে ভিসা এবং সহজে প্রবেশাধিকার দিতে হবে। মিয়ানমার সরকারকে অবশ্যই সংবিধান সংশোধন করতে হবে। নিপীড়িত সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের প্রতি বৈষম্যমূলক আইনের সংস্কার করতে হবে। তাদের অধিকার ও নাগরিকত্ব দিতে হবে।
সুপারিশের পাশাপাশি প্রস্তাবনায় বলা হয়, মিয়ানমার সরকারকে অবশ্যই দেশটির সংবিধান সংশোধন করতে হবে এবং সংখ্যালঘুদের অধিকার ও নাগরিকত্ব দিতে সব পক্ষপাতমূলক আইন প্রত্যাহার করতে হবে। এ ছাড়া বাংলাদেশ ও মালয়েশিয়ার মতো যেসব দেশ পালিয়ে যাওয়া রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দিয়েছে, তাদের আর্থিক সাহায্য দিতে আন্তর্জাতিক বিভিন্ন সম্প্রদায়কে এগিয়ে আসার আহ্বান জানানো হয়।
গণআদালতের বিচারক গিল এইচ বোয়েরিঙ্গার আরও বলেন, আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে সহিংসতা থেকে পালিয়ে আসা শরণার্থীদের আশ্রয় দেওয়া দেশ যেমন বাংলাদেশ ও মালয়েশিয়াকে অবশ্যই আর্থিক সহায়তা দিতে হবে। ট্রাইব্যুনালের অনুসন্ধান থেকে পাওয়া তথ্য, বিচার এবং সুপারিশ অবশ্যই আন্তর্জাতিক মহল এবং মানবাধিকার সংগঠনগুলোকে জানানো হবে যাতে সেগুলো মেনে চলার জন্য তারা মিয়ানমার সরকারকে চাপ দিতে পারে।
রায়ের পর ট্রাইব্যুনালের সাংগঠনিক কমিটির সভাপতি ও মালয়েশিয়ার বুদ্ধিজীবী চন্দ্র মোজাফফর অভিনন্দন জানিয়ে বলেন, এই রায় মিয়ানমার সরকারের অপরাধ চিহ্নিত করার ক্ষেত্রে তাৎপর্যপূর্ণ অগ্রগতি। ট্রাইব্যুনালের তথ্য অনুসন্ধান এবং বিচারকে ভিত্তি হিসেবে ব্যবহার করে আসিয়ান, আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতের পদক্ষেপ নেয়া উচিত। ১৯৭৯ সালে ইতালিতে ৬৬ আন্তর্জাতিক সদস্য নিয়ে দ্য পার্মানেন্ট পিপলস ট্রাইব্যুনাল (পিপিটি) প্রতিষ্ঠিত হয়।
প্রতিষ্ঠার পর থেকে মানবাধিকার এবং গণহত্যার সঙ্গে জড়িত অনেক মামলা নিয়ে ৪৩টি অধিবেশন হয়েছে এই ট্রাইব্যুনালে। পিপিটি ষাটের দশকে ভিয়েতনাম যুদ্ধের পটভূমিতে প্রখ্যাত ব্রিটিশ দার্শনিক বার্ট্রান্ড রাসেলের আন্তর্জাতিক যুদ্ধাপরাধের ধারণায় প্রতিষ্ঠিত। গত ২৫ আগস্ট মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে রোহিঙ্গাদের ওপর নির্যাতন ও গণহত্যা শুরু করে দেশটির সেনাবাহিনী। এরপর থেকে প্রাণ বাঁচাতে বাংলাদেশে আশ্রয় নিয়েছে কমপক্ষে চার লাখ ২০ হাজার রোহিঙ্গা। এদিকে মিয়ানমারের এ ধরনের আচরণে নড়েচড়ে বসে বিশ্বের বিভিন্ন দেশ ও সংস্থা। তাদের পক্ষ থেকে এর নিন্দা জানানোসহ রোহিঙ্গা হত্যাকান্ড বন্ধের আহ্বান জানানো হয়। কিন্তু এ সেনা অভিযান বন্ধে এখন পর্যন্ত কোনো পদক্ষেপ নেয়নি মিয়ানমার সরকার।
রোহিঙ্গা সমস্যাকে বাংলাদেশের জনগণ বাংলাদেশের জন্য অত্যন্ত বড় সমস্যা হিসেবে দেখছে কিন্তু আওয়ামী লীগ, বিএনপি, সিভিল সোসাইটি সেভাবে উপলব্ধি করছে বলে মনে হয় না। তাদের বক্তব্যেও পারস্পরিক ভিন্নতা ফুটে ওঠে। এনজিও মহল তাদের অবস্থানে থেকে কথা বলছে এবং কাজ করছে। এই বহুত্ববাদী বাস্তবতায় বাংলাদেশের জাতীয় অনৈক্য প্রকাশ পাচ্ছে। বাংলাদেশের রাজনীতিতে বহুত্ববাদ দারুণ জাতীয় অনৈক্যের পরিচয়কে প্রকটিত করছে।
ফলে রোহিঙ্গা সমস্যা নিয়ে দুর্যোগের মুহূর্তে বাংলাদেশ বিশ্ববাসীর সামনে নিজেকে ঐক্যহীন ও দুর্বল প্রমাণ করছে। আমরা চাই, বহুত্ববাদ নয়, বহুত্বমূলক সংহতি; আমরা চাই বৈচিত্র্যের মধ্যে ঐক্য। বহুত্ব ও বৈচিত্র্যকে যথোচিত গুরুত্ব দিয়ে ঐক্য। এনজিও ও সিএসও মহল থেকে প্রচারিত বহুত্ববাদ বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় অস্তিত্ব ও জনজীবনের জন্য সমূহ বিপদের কারণ হচ্ছে। বাংলাদেশের জাতীয় ঐক্যের কোনো সম্ভাবনাই এখন দেখা যাচ্ছে না
রোহিঙ্গাদের নিয়ে আন্তর্জাতিক মহলে একটি সূত্র চক্রান্ত চলছে । রোহিঙ্গা সমস্যা নিয়ে আন্তর্জাতিক চক্রান্ত আরও অনেক আগেই বাংলাদেশের বোঝা দরকার ছিল। বুঝে কাজ করা দরকার ছিল। এখন সমস্যা যে পর্যায়ে গেছে এবং বাংলাদেশ সরকারের ও রাজনৈতিক নেতৃত্বের যে অবস্থা, তাতে বাংলাদেশ কী করতে পারবে? বাংলাদেশের জনগণ ও সরকার দুর্দশাগ্রস্ত বিতাড়িত রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দিয়েছে সম্পূর্ণ মানবিক বিবেচনায়।
বাংলাদেশ তাদের মিয়ানমারের নাগরিক মনে করে। বাংলাদেশ চায়, মিয়ানমার তাদের ফেরত নিক এবং নাগরিকত্ব দিয়ে তাদের সচ্ছল-সম্মানজনক জীবনের অধিকারী করুক। কিন্তু মিয়ানমার তাদের মিয়ানমারের লোক মনে করে না। এমতাবস্থায় অবস্থা ঘনিভূত থেকে আরও ঘনিভূত হচ্ছে। তাই দলমত নির্বিশেষে জাতীয় ঐক্যের মাধ্যমে অবস্থা মোকাবেলা জরুরি।
প্রচ্ছদ প্রতিবেদন, রোহিঙ্গা সমস্যা ও সমাধান: আমাদের প্রতিবেশি রাষ্ট্র মিয়ানমার, আমরা অনেকে যাকে বার্মা বলেই বেশি চিনি, সেখানে বাংলাদেশ সীমান্তবর্তী আরাকান রাজ্যে রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর ওপর চরম দমন-পীড়ন চলছে। গণহত্যা চলছে বললেও বাড়িয়ে বলা হয় না।
বিদ্রোহীদের বিরুদ্ধে অভিযানের নামে নিরীহ রোহিঙ্গাদের নির্বিচারে হত্যা করা হচ্ছে। বাড়িঘর পুড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে, লুট করা হচ্ছে সহায়সম্পদ। প্রাণ বাঁচাতে হাজার হাজার অসহায় রোহিঙ্গা সীমান্তের সব পয়েন্ট দিয়ে স্রোতের মতো বাংলাদেশে ঢুকে আশ্রয় নিয়েছে।
ঘুম থেকে ওঠার পর আর ঘুমোতে যাওয়ার আগে এখন সবচেয়ে বেশি যে শব্দটা শুনি তা হলো ‘রোহিঙ্গা’। অনেকেই তাদের পক্ষে বিভিন্ন সামাজিক মাধ্যমে লেখালেখি করছে কিন্তু বেশিরভাগ মানুষই জানে না ‘রোহিঙ্গা’ কারা। আমরা যদি সহজভাবে চিন্তা করি ‘রোহিঙ্গা’ কারা, তাহলে আমাদের চোখের সামনে ভেসে ওঠে কিছু মানুষ বিশাল জলরাশির মাঝে খাবার পানি ও খাদ্য ছাড়া মৃত্যুর প্রহর গুনছে।
অভিযোগ করা হয়েছে, ২০১৭ সালের ২৫ আগস্ট ভোররাতে আরাকান রোহিঙ্গা সালভেশন আর্মি সংক্ষেপে ‘আরসা’ নামের একটি বিদ্রোহী সংগঠন সেনাবাহিনী ও পুলিশের ৩০টি ক্যাম্পে একযোগে হামলা চালায়। এই অভিযোগের সত্যতা যাচাইয়ের কোনো সুযোগ নেই। কিন্তু এর জেরে মিয়ানমার সেনাবাহিনী কমপক্ষে ১০০ রোহিঙ্গা গ্রাম পুড়িয়ে দিয়েছে। দেখামাত্র গুলি করছে। লাশ হয় নদীতে ভাসিয়ে দিচ্ছে অথবা আগুনে পুড়িয়ে দিচ্ছে।
মিয়ানমার সেনাবাহিনীর এই রোহিঙ্গাবিরোধী অভিযান নতুন না হলেও এবার তারা তাদের অতীতের রেকর্ড ভঙ্গ করেছে। ১৯৭৮ সালে প্রথম সামরিক হামলার মুখে রোহিঙ্গারা ভিটেমাটি থেকে উচ্ছেদ হয়ে বাংলাদেশে এসে আশ্রয় নেয়। তখন বিষয়টি সাময়িক মনে করা হলেও তা একটি স্থায়ী সমস্যা হিসেবে রয়ে গেছে। মাঝখানে নানা কূটনৈতিক উদ্যোগের কারণে কিছু শরণার্থী বার্মা ফিরিয়ে নিলেও বিভিন্ন ঘটনায় তারা আবার বাংলাদেশে ফিরে এসে এক মারাত্মক মানবিক সংকট তৈরি করেছে।
ধারণা করা হয়, আনুমানিক ৭ লাখ রোহিঙ্গা বাংলাদেশে আছে। বাংলাদেশের মতো একটি জনবহুল দেশের পক্ষে বছরের পর বছর কয়েক লাখ শরণার্থীর ভার বহন করা সম্ভব নয়। তার পরও মানবিকতার কথা বিবেচনা করে বাংলাদেশ দশকের পর দশক ধরে রোহিঙ্গা শরণার্থীদের থাকতে দিয়েছে। এবার যে হারে রোহিঙ্গারা আসছে তা আতঙ্কিত হওয়ার মতো।
সংকট সৃষ্টিকারী দেশটির নাম মিয়ানমার বা বার্মা। বার্মাকে অনেকে দুনিয়াছাড়া দেশ বলে থাকেন। ভারত ভাগের এক বছর পর ইংরেজরা বার্মাকে স্বাধীনতা দেয়। ১৯৪৮ সালে স্বাধীন বার্মার প্রথম প্রধানমন্ত্রী হন জেনারেল অং সান। কিন্তু কয়েক মাসের মধ্যেই অং সান এবং তার মন্ত্রিপরিষদের সব সদস্যকে ব্রাশফায়ারে হত্যা করে ক্ষমতা দখল করে সেনাবাহিনী। তখন থেকে বার্মা চলে যায় সামরিক শাসনের অধীন। লৌহকপাটের দেশ বলেই বার্মা পরিচিতি পায়।
পৃথিবীর আর কোনো দেশে এত দীর্ঘ সময় সামরিক শাসনাধীন চলার রেকর্ড নেই। বাইরের দুনিয়াকে বার্মা খুব হিসাবের মধ্যে নেয়-তার কোনো প্রমাণ পাওয়া যায় না। চরম স্বেচ্ছাচারী বার্মার সামরিক কর্তৃপক্ষ শুরু থেকেই আরাকান রাজ্যের রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীকে নিজ দেশের মানুষ বলে মনে করে না। ধর্মের দিক থেকে রোহিঙ্গারা মুসলমান, আবার তাদের ভাষা বাংলা। চট্টগ্রামের আঞ্চলিক ভাষার সঙ্গে রোহিঙ্গাদের ভাষার অভিন্নতার কারণে বার্মিজ শাসকরা কখনো তাদের বার্মার অধিবাসী বলে মনে করে না।
তাদের ‘বাঙালি’ বলা হয়। সমস্যাটা এখানেই। যেহেতু তাদের বহিরাগত মনে করা হয়, সেহেতু তাদের দেশছাড়া করার অধিকার বার্মার শাসকদের আছে বলে তারা মনে করে। একটি জনগোষ্ঠীকে নিশ্চিহ্ন করার যে পথ মিয়ানমার সেনাবাহিনী গ্রহণ করছে, তা একেবারেই সমর্থনযোগ্য নয়। এটা এথনিক ক্লিনজিং। এটা মানবতাবিরোধী অপরাধ। অথচ পৃথিবীর শক্তিধর দেশগুলো রোহিঙ্গানিধন পর্ব না দেখার ভান করে আছে। এখন তারা অন্ধ। এমনকি মুসলিম দেশগুলোকেও এ ব্যাপারে প্রতিবাদী হতে দেখা যাচ্ছে না।
‘উষ্মা’ এখানে কাজ করছে না। পাঠকদের জন্য রোহিঙ্গাদের ইতিহাস এবং বর্তমান অবস্থা তুলে ধরা হলো। রোহিঙ্গারা রাষ্ট্রহীন মানুষ। মায়ানমারের রাখাইন রাজ্যে তাদের বসবাস। রাখাইন রাজ্যের আদি নাম আরাকান। যদিও রোহিঙ্গাদের পূর্বপুরুষরা শতশত বছর ধরে সেখানে আছে কিন্তু মিয়ানমার-বার্মা সরকার রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীকে কখনো নাগরিক হিসেবে স্বীকৃতি দেয়নি। রাষ্ট্রহীন মানুষ হিসেবে রোহিঙ্গারা রাখাইন রাজ্যসহ প্রতিবেশী বাংলাদেশ ও থাইল্যান্ডের বিভিন্ন শরণার্থী শিবিরে বাস করে। জাতিসংঘের তথ্যমতে, রোহিঙ্গারা বর্তমানে বিশ্বের সবচেয়ে নির্যাতিত জনগোষ্ঠী।
খ্রিস্টীয় অষ্টম শতাব্দীতে আরাকান অঞ্চল শাসন করতো চন্দ্র বংশ। আরব বণিকদের একটা জাহাজ রামব্রী দ্বীপের তীরে ভেঙে পড়ে। কিছু আরব তীরে এসে স্থানীয়দের কাছে সাহায্য চায়। রাজা মহত ইং চন্দ্র তাদের সাহায্য করেন। কিছু আরব স্থানীয় নারীদের বিয়ে করে। এসব আরব বণিক বসতি স্থাপনের আর্জি করলে মহত ইং চন্দ্র তা মঞ্জুর করেন।
চতুর্দশ শতকে আরাকানে মুসলিমরা বসতি স্থাপণ করে। ততকালীন বৌদ্ধ রাজা নারেমেইখলি (যিনি তার রাজ্য পুনরুদ্ধার করেছিলেন গৌড়ের সুলতান জালালুদ্দিন শাহের সহযোগিতায়) তার রাজ দরবারে মুসলিম উপদেষ্টা তাদের গ্রহণ করেছিলেন। কিন্তু পরে দক্ষিণের বৌদ্ধ বর্মীরা আরাকান দখল করে নেয়, নারেমেইখলি পরাজিত হন। আরাকান দখলের পর বৌদ্ধ বর্মীরা সব রোহিঙ্গা মুসলিমদের তাড়িয়ে দিয়েছিল। তখন প্রায় ৩৫ হাজার রোহিঙ্গা ততকালীন ব্রিটিশ-ভারতের অন্তর্গত বাংলায় (বর্তমান চট্টগ্রাম এলাকায়) পালিয়ে গিয়েছিল।
মিয়ানমারের রোহিঙ্গা মুসলমানরা বিশ্বের সবচেয়ে ভাগ্যাহত জনগোষ্ঠী। এককালে যাদের ছিল স্বাধীন রাষ্ট্র, ক্ষমতা ও প্রভাব প্রতিপত্তি এখন তারাই সন্ত্রাসী বৌদ্ধদের অমানবিক নির্যাতনের শিকার। মিয়ানমারের মুসলিম জনগোষ্ঠীর ভাগ্য বিড়ম্বনার ইতিহাস যে কাউকে তাড়িত করবে। এই উপমহাদেশ ও দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ায় সর্বপ্রথম যে কয়টি এলাকায় মুসলিম বসতি গড়ে ওঠে, আরাকান তার মধ্যে অন্যতম। রোহিঙ্গারা সেই আরাকানী মুসলমানের বংশধর। এক সময় আরাকানে স্বাধীন মুসলিম রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হয়।
১৪৩০ সালে প্রতিষ্ঠিত মুসলিম শাসন দুইশ বছরেরও অধিককাল স্থায়ী হয়। ১৬৩১ সাল থেকে ১৬৩৫ সাল পর্যন্ত আরাকানে ব্যাপক দুর্ভিক্ষ হয়। এরপর মুসলিম শাসনের অবসান ঘটে। ১৬৬০ সালে আরাকান রাজা থান্দথুধম্মা নিজ রাজ্যে আশ্রিত মোঘল সম্রাট শাহজাদা সুজাকে সপরিবারে হত্যা করে। এরপর শুরু হয় মুসলমানের উপর তার নিষ্ঠুর অমানবিক অত্যাচার নিপীড়ন। প্রায় সাড়ে তিনশ বছর মুসলমানদের কাটাতে হয় এই দুর্বিষহ অবস্থার মধ্যে।
১৭৮০ সালে বর্মী রাজা বোধাপোয়া আরাকান দখল করে নেয়। সেও ছিল ঘোর মুসলিম বিদ্বেষী। বর্মী রাজা ঢালাওভাবে মুসলিম নিধন করতে থাকে। ১৮২৮ সালে বার্মা ইংরেজদের শাসনে চলে যায়। তবে ১৯৩৭ সালে বার্মা স্বায়ত্তশাসন লাভের পর বৌদ্ধদের পরিকল্পিত সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা ব্যাপক রূপ নেয় এবং তারা প্রায় ৩০ লাখ মুসলিম হত্যা করে। ১৯৪৮ সালে বার্মা স্বাধীনতা লাভ করে। কিন্তু মুসলিম জনগোষ্ঠীর ভাগ্যের কোনো পরিবর্তন ঘটেনি।
তারা থেকে যায় ভাগ্য বিড়ম্বিত। স্বাধীন দেশের সরকার তাদেরকে নাগরিকত্ব দূরে থাক মানবিক অধিকারটুকুও দেয়নি। নাসাকা বাহিনী ও বৌদ্ধদের হামলার শিকার হয়ে রোহিঙ্গা মুসলিমরা পার্শ্ববর্তী বাংলাদেশসহ বিশ্বের আনাচে-কানাচে আশ্রয় নিতে বাধ্য হয়েছেন। এরা বিশ্বের রাষ্ট্রহীন নাগরিক। ১৯৮২ সালে মিয়ানমারের সরকার রোহিঙ্গা মুসলিমদের নাগরিকত্ব বাতিল করে দেয় এবং সরকারিভাবে তাদেরকে সেখানে ‘বসবাসকারী’ হিসেবে উলেখ করা হয়।
তাদের ভোটাধিকার নেই। নেই কোনো সাংবিধানিক ও সামাজিক অধিকার। নিজ দেশে পরবাসী তারা। তারা মিয়ানমারের অন্য প্রদেশে অনুমতি ছাড়া যেতে পারে না। এক সময় যেখানে রোহিঙ্গারা ছিল সংখ্যাগুরু আজ সেখানে তারা সংখ্যালঘু। রাখাইন বৌদ্ধদের সেখানে এনে মুসলিমদের সংখ্যালঘু বানানো হয়েছে।
রোহিঙ্গারা পশ্চিম মিয়ানমারের রাখাইন স্টেটের উত্তরাংশে বসবাসকারী একটি জনগোষ্ঠী। ধর্মের বিশ্বাসে এরা অধিকাংশই মুসলমান। রাখাইন স্টেটের প্রায় এক-তৃতীয়াংশ হল রোহিঙ্গা। মায়ানমারের সরকারি হিসেব মতে, প্রায় আট লাখ রোহিঙ্গা আরাকানে বসবাস করে। রোহিঙ্গারা বর্তমান পৃথিবীর সবচেয়ে নিপীড়িত জনগোষ্ঠীগুলোর একটি।
মিয়ানমার সরকার রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীকে দেশটির নাগরিক হিসেবে স্বীকৃতি দেয়নি। মিয়ানমার সরকার ১৩৫টি জাতিগোষ্ঠীকে সংখ্যালঘু জাতি হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে, রোহিঙ্গারা এই তালিকার অন্তর্ভুক্ত নয়। মিয়ানমার সরকারের মতে, রোহিঙ্গারা হলো বাংলাদেশি, যারা বর্তমানে অবৈধভাবে মিয়ানমারে বসবাস করছে। যদিও ইতিহাস ভিন্ন কথা বলে। ইতিহাস বলে, রোহিঙ্গারা মিয়ামারে কয়েক শতাব্দী ধরে বসবাস করে আসছে।
মিয়ানমার সরকারের দাবি, রোহিঙ্গারা হলো ভারতীয়, বাঙালি ও চাঁটগাইয়া সেটলার, যাদেরকে ব্রিটিশরা আরাকানে এনেছে। যদিও ঐতিহাসিকভাবে এটি প্রতিষ্ঠত যে, ব্রিটিশরা বার্মায় শাসক হিসেবে আসার কয়েক শতাব্দী আগে হতেই রোহিঙ্গারা আরাকানে পরিষ্কার জাতি হিসেবে বিকশিত হয়েছিল।
বাংলাদেশ ও রোহিঙ্গা : মিয়ানমার সরকার রোহিঙ্গাদের দেশটির নাগরিক হিসেবে স্বীকৃতি দেয়নি এবং আরাকান সরকারের মতে, রোহিঙ্গারা বাংলাদেশি। কিন্তু ঐতিহাসিকভাবে এটি সত্য যে, রোহিঙ্গারা মিয়ানমারের আরাকানের উত্তরাঞ্চলের স্থায়ী অধিবাসী। কিন্তু তারপরও অর্ধশতাব্দী ধরে, মিয়ানমার সরকার রোহিঙ্গাদের বাংলাদেশে ‘পুশ ইন’ করেছে।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় জাপান বার্মা দখল করলে বার্মিজ জাতীয়তাবাদী ও জাপানীরা মিলে রোহিঙ্গাদের গণহত্যা, জাতিগত ধোলাই শুরু করে। এ সময় প্রায় পঞ্চাশ হাজার রোহিঙ্গা ভারত উপমহাদেশের বিভিন্নি অঞ্চলে পালিয়ে আসে। জেনারেল নে উইনের সময় আশির দশকে আদমশুমারির সময় রোহিঙ্গাদের বিদেশী ঘোষণা করে নিপীড়ণ করা। এ সময় প্রায় দুই লক্ষ রোহিঙ্গা বাংলাদেশে পালিয়ে আসে। উদ্বাস্তুরা গণহত্যা, ধর্ষণ, সন্তান চুরিসহ নানান ধরনের জাতিগত ধোলাইয়ের অভিযোগ আনে।
বিগত কয়েক দশক ধরে মিয়ানমার সরকার রোহিঙ্গাদেরকে বাংলাদেশ সীমান্তে পুশইন করছে। রুটিনমাফিক নির্যাতন করে রোহিঙ্গাদের বাধ্য করছে বাংলাদেশে অনুপ্রবেশ করতে। বর্তমানে সাত লাখের বেশি রোহিঙ্গা বাংলাদেশে আশ্রিত অবস্থায় বসবাস করছে। যদিও রিফিউজি হিসেবে বাংলাদেশে তালিকাভুক্ত রোহিঙ্গাদের সংখ্যা আরও কম।
রোহিঙ্গাদের প্রতি যা করছে মিয়ানমার সরকার, তা সমগ্র মানবতার বিরুদ্ধেই অপরাধ। এক হাজার বছরের বেশি সময় ধরে আরাকানে বিকশিত হতে থাকা রোহিঙ্গাদের নাগরিকত্ব সুবিধা না দেয়া, গ্যাটো সৃষ্টি করে সেখানে অমানবিক পরিবেশে থাকতে বাধ্য করা, জোরপূর্বক শ্রমে নিয়োগ করা, বিচারবর্হিভূতভাবে গ্রেফতার করা, মালিকানাস্বত্ব, সার্বজনীন শিক্ষা, চিকিৎসা, উপযোগ সেবা ও মৌলিক মানবাধিকার হতে বঞ্চিত করার মাধ্যমে নিমর্মতার শেষ সীমানাটুকু অতিক্রম করেছে মিয়ানমার সরকার।
আহমাদুল কবির/ সিনিয়র সহ-সভাপতি বাংলাদেশ প্রেস ক্লাব অব মালয়েশিয়া
এমআরএম/এমএস