শ্রমের অবমূল্যায়ন চলছেই

জমির হোসেন
জমির হোসেন জমির হোসেন , ইতালি প্রতিনিধি
প্রকাশিত: ০৯:১৮ এএম, ০১ মে ২০১৯

শ্রম মানুষের উপার্জনের প্রথম পদক্ষেপ। যত বেশি শ্রম তত বেশি আয়- এ আশা নিয়ে শ্রমজীবীরা উপার্জনের তাগিদে ছুটে চলেন। তবে শ্রমের মাঝে বিভাজন রয়েছে- উঁচু ও নিচু শ্রেণির শ্রমিক। তার মাঝে আছে আবার আয়ের ভেদাভেদ।

জীবনের চাহিদা মেটাতে আমৃত্যু কাজ করে যায় মানুষ। ভাগ্য পরিবর্তন করতে তারা দিনরাত শ্রম দেয়। কিন্তু শ্রমিকদের শ্রমের সঠিক মূল্য কে দেয়? অধিকাংশ শ্রমজীবী কোনো না কোনো শ্রমের সঙ্গে নিজেকে সম্পৃক্ত করছেন। ফলে বাঁচার তাগিদে নিজের মেধা ও শ্রম বিত্তশালী মানুষদের পায়ে লুটিয়ে দিয়ে বিনিময় করে শ্রম বনাম অর্থের।

বিত্তবানরা দিনমজুরের শ্রমের বিনিময়ে নিজের ব্যবসা প্রতিষ্ঠান প্রসার করতে থাকে। পরিতাপের বিষয় হলো, তারা বিনিয়োগ করে ভাগ্য পরিবর্তন করতে সক্ষম হয় আর শ্রমিকরা তাদের ভাগ্য পরিবর্তন করতে যুদ্ধ চালায়। কিন্তু তার পরেও সংসারে অভাব লেগেই থাকে।

শ্রমিকদের জীবন পার করতে হয় সংগ্রাম করে। তারা কোনো সরকারের আমলেই শ্রমের সঠিক মূল্যায়ন পায় না। বরং ন্যায্য অধিকার থেকে বঞ্চিত হতে হয়। নিজেদের দাবি আদায়ে আন্দোলনে নামলেও সরকারের তোপের মুখে পড়তে হয় শ্রমিকদের।

১৯৮৯ সালে প্রথমবারের মতো পৃথিবীর মোট জনসংখ্যা সম্পর্কিত তথ্য প্রকাশ করা হয়। দেখা যায়, ওই সময় জনসংখ্যা ছিল প্রায় ৫০০ কোটি। ২০১৭ সালে তা বৃদ্ধি পেয়ে দাঁড়িয়েছে সাড়ে ৭শ কোটিতে। এর মধ্যে ভারত ও চীনেই প্রায় ২৭৫ কোটি মানুষের বাস। এর আগে অর্থাৎ ২০১৬ সাল ৬ ফেব্রুয়ারি পৃথিবীর জনসংখ্যা ৭৪০ কোটিতে ছিল। বর্তমানে তা প্রায় ৭৫০ কোটির বেশি ছাড়িয়ে গেছে।

এ জনসংখ্যার বড় একটি অংশ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে কাজ করে জীবনের চাহিদা মেটায়। দেখা গেছে, যৌবনে কর্মস্থলে যোগদানের পর বার্ধক্যে চলে গেছে, কিন্তু ভাগ্যের তেমন কোনো পরিবর্তন হয়নি। লাগামহীন পরিশ্রম করে যাচ্ছে ভাগ্য উন্নয়নের জন্য। তাদের উন্নয়ন না হওয়ার বড় কারণ, অবমূল্যায়ন। শ্রমিক অবমূল্যায়নের একটি বড় দৃষ্টান্ত ঢাকার সাভারের রানা প্লাজা ট্রাজেডি।

আন্তর্জাতিক শ্রমিক দিবস, যা মে দিবস নামেই সবাই জানে। প্রতি বছর ১ মে বিশ্বজুড়ে দিবসটি উদযাপন করা হয়। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে শ্রমজীবী মানুষ এবং শ্রমিক সংগঠন রাজপথে সংগঠিতভাবে মিছিল ও শোভাযাত্রার মাধ্যমে দিবসটি পালন করে। বিশ্বের প্রায় ৮০টি দেশে ১ মে জাতীয় ছুটির দিন এবং অনেক দেশে এটি বেসরকারিভাবে পালন করা হচ্ছে।

হে মার্কেটের ট্রাজেডি কম-বেশি সবার জানা আছে। ১৮৮৪ সাল যুক্তরাষ্ট্রের শিকাগো শহরে শ্রমিকরা দৈনিক ৮ ঘণ্টা কাজ করার প্রস্তাব নিয়ে আন্দোলন শুরু করে। এ দাবি কার্যকর করতে সময় বেঁধে দেয় হয় ১৮৮৬ সালের ১ মে পর্যন্ত। এভাবেই চলতে থাকে আন্দোলন।

একাধিকবার মালিকপক্ষের কাছে দাবি জানানো হয়, কিন্তু সামান্যতম সাড়া মেলে না। এরপর এ ঘটনা নিয়ে একটি পত্রিকায় লেখা প্রকাশ হলে বিষয়টি আলোড়ন তৈরি করে। পরে এ আন্দোলন চরম রূপ নিল। শিকাগো শহর হয়ে ওঠে প্রতিবাদ-বিদ্রোহের বিশাল মঞ্চ।

ধীরে ধীরে উভয় পক্ষের সংঘর্ষ স্থায়ী হয়ে উঠল। মালিক-বণিকরা প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করে দিল। পুলিশ আগে থেকেই শ্রমিকদের ওপর নির্মম নির্যাতন চালায়। শুধু তাই নয়, শ্রমিকদের ওপর গুলি চালাতে পুলিশকে বিশেষ অস্ত্র কিনে দেয় ব্যবসায়ীরা। সেই সময় পহেলা মে যুক্তরাষ্ট্রে প্রায় তিন লাখ শ্রমিক কাজ ফেলে রাস্তায় নেমে আসেন। এভাবে আন্দোলন আরও ঘনীভূত হয়।

এ দিন আন্দোলন চরম রূপ নেয়। সেদিন দৈনিক আট ঘন্টা কাজের দাবিতে শ্রমিকরা হে মার্কেটে জমায়েত হয়। কে বা কারা বোমা নিক্ষেপের পর শ্রমিকদের ওপর গুলি চালায় পুলিশ। এতে প্রায় ১০ থেকে ১২ শ্রমিক ও পুলিশ নিহত হয়।

হে মার্কেটের ঘটনার পর এক পর্যায়ে শ্রমিকদের শ্রমের বিভাজন একটা জায়গায় আসে, কিন্তু শ্রমের আসল মূল্য অনেকটা আগের মতই রয়ে গেল। অবমূল্যায়নের গণ্ডির মধ্য থেকে শ্রমের আসল মূল্য উঠে আসতে পারেনি। যেন লড়াই করেও শ্রমিকদের জয় নিশ্চিত হয়নি। বহু বছর তো পার হয়ে গেল, শ্রমের ন্যায্য মূল্য কবে পাবে শ্রমিকরা?

লেখক, সাধারণ সম্পাদক, অল ইউরোপ বাংলাদেশ প্রেস ক্লাব।

এমএসএইচ/জেআইএম

প্রবাস জীবনের অভিজ্ঞতা, ভ্রমণ, গল্প-আড্ডা, আনন্দ-বেদনা, অনুভূতি, স্বদেশের স্মৃতিচারণ, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক লেখা পাঠাতে পারেন। ছবিসহ লেখা পাঠানোর ঠিকানা - [email protected]