পানামার জঙ্গলে শুধু লাশ আর লাশ, থেমে নেই বাংলাদেশিরাও
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে কর্মসংস্থানের আশায় বিকল্প পথ খুঁজছে অভিবাসন প্রত্যাশী বাংলাদেশিদের একটি অংশ। এজন্য তারা দক্ষিণ আমেরিকার দেশ- ব্রাজিল, বলিভিয়া, ইকুয়েডর, কলাম্বিয়া, পানামা হয়ে মেক্সিকো রুটকেই ব্যবহার করছে। পাড়ি দিতে হচ্ছে ভয়ঙ্কর জঙ্গল ‘ড্যারিয়ান গ্যাপ’। এই দুর্গম বনপথে রয়েছে বিষাক্ত সাপ আর ভয়ঙ্কর নানা প্রাণী। পাড়ি দিতে গিয়ে অনেকেরই জীবন বিপন্ন হচ্ছে।
‘৪ দিন ধরে কোনো খাবার পায়নি, শুধু নদীর পানি খেয়ে থাকতাম। ১১ দিন ধরে ঘুম নেই। আমেরিকার উদ্দেশ্যে দেশ ছাড়ার ১ মাস পর আমি পানামার ভয়ঙ্কর জঙ্গল হয়ে পৌঁছায় আমেরিকায়। তবে এখানে যে ভালো আছি এমনটাও নয়। এক আত্মীয়র বাড়িতে লুকিয়ে আছি। পুলিশের ভয়ে কাজ খুঁজতেও পারছি না। প্রশাসন যদি জানতে পারে তাহলে আমাকে জেল ভরবে।’ বলছিলেন ‘ড্যারিয়েন গ্যাপ’ পার হয়ে সদ্য আমেরিকায় যাওয়া এক তরুণ।
কিভাবে পৌঁছালেন জানতে চাইলে বলেন, ‘স্থলপথে কমপক্ষে সাতটি দেশ পাড়ি দিয়ে পৌঁছাতে হয় পানামার ভয়ঙ্কর জঙ্গলে। পানামা-কলম্বিয়া সীমান্ত হয়ে কিছুদুর গেলেই স্বপ্নের দেশ যুক্তরাষ্ট্র। যেখানে ওঁত পেতে থাকে মৃত্যু। দালালকে দশ লাখ টাকা জোগাড় করে দিয়েছি। শুধু আমি একা নয় প্রতিদিন হাজার হাজার মানুষ এ পথ ব্যবহার করছে। তবে বেশিরভাগই না ফেরার দেশে চলে যাচ্ছে। কত লাশ দেখেছি তার কোন হিসেব নেই।’
‘জঙ্গল দিয়ে যখন আসছিলাম তখন খুব ভয় করছিল। সব সময় গা শিহরে উঠতো। এ যেন মৃত্যু ফাঁদ। শুধু বাংলাদেশি নয় বিশ্বের বিভিন্ন দেশের মানুষ এ পথ ব্যবহার করছে। তবে বেশিরভাগই পথিমধ্যে মারা যাচ্ছে। হয়তোবা আমি পরজনমে ভালো কাজ করেছিলাম বলেই জানে বেঁচে আছি। এখন যে কি হবে আল্লাহই ভালো জানে।’ বলছিলেন এ যুবক।
বাংলাদেশি বহু তরুণরা না বুঝে এ মুত্যুর ফাঁদে পা বাড়াচ্ছে। ভাগ্যক্রমে যারা বেঁচে যান তাদের অনেকেরই ঠাঁই হয় কারাগারে। পরম সৌভাগ্যবান কেউ কেউ হয়তো ভয়ঙ্কর নিরাপত্তা বেষ্টনি আর উঁচু দেওয়াল পার হয়ে কোন রকমে পৌঁছাতে পারেন স্বপ্নের দেশে।
প্রতিবছর হাজার অভিবাসন প্রত্যাশী প্রায় ১০টি দেশ পাড়ি দিয়ে আমেরিকার সীমান্ত এলাকায় পৌঁছায়। এরপর সুযোগ বুঝে সীমান্ত পাড়ি দিয়ে যুক্তরাষ্ট্রে ঢোকার চেষ্টা করে। এই কন্টকাকীর্ণ পাহাড়ী পথ পাড়ি দিতে গিয়ে ঝরছে বহু অভিবাসন প্রত্যাশীর প্রাণ। ঝুঁকিপূর্ণ এই পথে খাবারের অভাবেও অনেকে ধুঁকে ধুঁকে মৃত্যুর মুখে ঢলে পড়েন।
একটি এনজিও’র পরিসংখ্যান অনুযায়ী, গত দুই বছরে যেসব অভিবাসী জীবনের ঝুঁকি নিয়ে ড্যারিয়েন গ্যাপ পাড়ি দিয়েছেন এর মধ্যে তৃতীয় অবস্থানে রয়েছেন বাংলাদেশিরা। বিপদসংকুল এই রুটের নানান জায়গায়, অস্থায়ী আবাসগুলোতে দেখা গেছে বাংলা লেখনি। অনিশ্চিত পথে পা বাড়ানোর আগে নিজের নাম-পরিচয় লিখে গেছেন এসব বাংলাদেশি।
প্রতিবছর পানামা’র ড্যারিয়েন গ্যাপ পাড়ি দিতে গিয়ে মারা যাচ্ছেন প্রায় ১০ হাজার মানুষ। এই দুর্গম সড়কের যেখানে সেখানে মানুষের খুলি এবং হাড়গোড়ও পড়ে থাকতে দেখা গেছে। তবু স্বপ্নের দেশে পৌঁছাতে মরিয়া হাজার হাজার অভিবাসন প্রত্যাশী।
জানা গেছে, কাতার, ব্রাজিল, সেন্ট্রাল আমেরিকার বিভিন্ন দেশ, মেক্সিকোতে রয়েছে আদম দালালদের নেটওয়ার্ক। এসব দেশের সীমান্তরক্ষীসহ ইমিগ্রেশন কর্তৃপক্ষের সঙ্গেও এদের লেন-দেনের ব্যাপার রয়েছে। যদিও চূড়ান্ত গন্তব্য যুক্তরাষ্ট্রে আসার পরও অনেকেরই দিন কাটে ডিটেনশন সেন্টারে। এক পর্যায়ে অনেককেই নিজ দেশে ফিরে যাবার ঘটনাও ঘটছে।
এ সীমান্ত সম্পর্কে যাদের ধারণা আছে তাদের সঙ্গে আলাপ করে জানা গেছে ভয়াবহ সব তথ্য। মধ্য ও দক্ষিণ সীমান্তের শত মাইলজুড়ে প্রবাহিত খরস্রোতা রিও গ্রান্ডে নদী। পাহাড় আর জঙ্গলে ঘেরা এই নদীর ওপারেই মেক্সিকো। দুই দেশের সীমান্তে কড়া টহল, জল-স্থল আর আকাশ পথে সশস্ত্র সীমান্তরক্ষীর বিচরণ।
এমআরএম/এমএস