কঠিন চ্যালেঞ্জে মালয়েশিয়া প্রবাসীরা
প্রত্যাশা ও জীবন সংগ্রামের চ্যালেঞ্জ নিয়েই প্রতিনিয়ত যুদ্ধে টিকে থাকতে হচ্ছে প্রবাসীদের। পরিবারের সুখের আশায় বছরের পর বছর বিদেশে পড়ে থাকতে হয় বাংলাদেশিদের। তাদের উপার্জনের ওপর নির্ভর করে দেশে থাকা পরিবার। পরিজনদের আকাশচুম্বী চাওয়া-পাওয়ার অনেকটাই নির্ভর করে প্রবাসীদের ওপর। হাসিমুখে তাদের সর্বোচ্চটুকু দিয়ে যাচ্ছে দেশকে।
কেউ কেউ পরিবারের মুখে হাসি ও স্বচ্ছলতা ফিরিয়ে আনলেও অনেকেই প্রবাসে অসহায়ত্বের গ্লানি টানছেন। পদে পদে তারা প্রতারণার শিকার হচ্ছেন। ফাঁদ পেতে বসেছেন প্রতারকরা। অবৈধতার অভিশাপ নিয়ে প্রবাসে থাকার ইচ্ছে না থাকলেও নামধারি কিছু প্রতিষ্ঠান আর দালালদের খপ্পরে পড়তে হচ্ছে অনেককেই। অথচ ব্রান্ডিং বাংলাদেশ গড়তে এ সারথিদের রয়েছে অগ্রণী ভূমিকা।
একদিকে ইমিগ্রেশন পুলিশের কড়া অভিযান। অন্যদিকে দালাল মাধ্যমে এসে গ্রেফতার হয়ে মালয়েশিয়ার বন্দি জীবন পার করছেন বহু বাংলাদেশি।
২০১৬ সালে দেশটিতে কর্মরত অবৈধ অভিবাসীদের বৈধতার ঘোষণা দেন মালয়েশিয়া সরকার। ধাপে ধাপে সময় বাড়িয়ে দীর্ঘ আড়াইটি বছর চলে বৈধকরণ প্রক্রিয়া। শেষ হয় চলতি বছরের ৩০ জুন।
এই সময়ের মধ্যে জন্ম নিল অনেক প্রতারকের। ফিটফাট অফিস বানিয়ে বৈধ করে দেয়ার নামে খেটে খাওয়া অবৈধ কর্মীদের কাছ থেকে মোটা অঙ্কের টাকা হাতিয়ে উধাও হয়েছে প্রতারকরা। আবার কেউ-কেউ ফোনে হুমকিও দিচ্ছে।
মাথার ঘাম পায়ে ফেলে বৈধ হওয়ার জন্য এসব প্রতারকদের হাতে অর্থকড়ি আর পাসপোর্ট তুলে দিলেও তাদের কপালে জোটেনি বৈধতা। এসব অবৈধদের সংখ্যা প্রায় ৭০ হাজারেরও বেশি বলে ধারণা করা হচ্ছে। তারা এখন ইমিগ্রেশন এবং পুলিশের ভয়ে পালিয়ে বেড়াচ্ছেন।
ওই প্রতারকরা একজন অবৈধ কর্মীকে সিটিং এবং ফিটিং করে তাদের মাধ্যমে বৈধ হওয়ার জন্য। যখন তার ফাঁদে পড়ল তখনই শুরু করে দিল মারিং-কাটিং। অনুসন্ধানে জানা গেছে, মালয়েশিয়া সরকার অবৈধ কর্মীদের বৈধ করার জন্য দুটি প্রোগ্রাম চালু রেখেছিল। একটি হচ্ছে রি-হিয়ারিং অন্যটি হচ্ছে ই-কার্ড। এ দুটি প্রোগ্রামকে ঘিরে গড়ে উঠেছিল শক্তিশালী একটি মিডলম্যান চক্র। বৈধ হওয়া ও মালিকের কাছে কাজ পাওয়া, সব জায়গাতেই এ চক্রকে টাকা দিয়ে টিকে থাকতে হতো কর্মীদের। কর্মীদের বৈধ করে দেয়ার নামে ৫-১০ হাজার রিঙ্গিত জনপ্রতি হাতিয়ে নিয়েছে।
বাংলাদেশি অবৈধ কর্মীর কাছ থেকে টাকা নিয়েছেন তাদের বৈধ করে দেয়ার নামে। বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই কর্মীদের বৈধ করতে পারেননি। কর্মীদের টাকাও ফেরত দিচ্ছেও না। উল্টো কর্মীদের পুলিশের ভয় দেখানো হচ্ছে। এভাবে এ চক্রের কাছে জিম্মি হয়ে থাকতে হচ্ছে কর্মীদের।
এ ছাড়া মালিক তাদের অর্ধেক মজুরিতে কাজ করিয়ে নিচ্ছে। আবার বৈধতার নামে টাকা নিচ্ছে। ফলে হাড়ভাঙা খাটুনি খেটে মাস শেষে নিজে খেয়ে পরে বাঁচতেই কষ্ট হচ্ছে অবৈধ কর্মীদের। মানবেতর জীবন কাটাতে হচ্ছে তাদের।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে মালয়েশিয়ায় নিযুক্ত বাংলাদেশের হাইকমিশনার মুহা. শহিদুল ইসলাম বলেন, প্রায় ১০ লাখের অধিক বাংলাদেশি মালয়েশিয়ায় রয়েছেন। প্রতিদিন একভাগ লোক সমস্যায় পড়লে ১০ হাজার হয়। আর ১০ হাজার লোকের সমস্যা সমাধান করতে ১৫ মিনিট করে ব্যয় হলে ১৫-২০ দিন সময় লাগে। অতএব অভিযোগ থাকতেই পারে। তবে সুনির্দিষ্ট অভিযোগ দিলে দূতাবাস অবশ্যই ব্যবস্থা নেবে।
নেপালের নাগরিকরা সমস্যায় পড়লে রাষ্ট্রদূতসহ টিম চলে যায়, কিন্তু বাংলাদেশিরা বিপদে পড়লে দূতাবাসের কোনো সহযোগিতা পান না প্রবাসীদের এমন অভিযোগের প্রেক্ষিতে শহিদুল ইসলাম বলেন, মালয়েশিয়ার বিভিন্ন শহরে নেপালের আলাদা টিম রয়েছে, যেটা বাংলাদেশের নেই। জহুরবারুতে ঘটনা ঘটলে কুয়ালালামপুর থেকে টিম যাওয়া সম্ভব নয়। কিন্তু নেপাল যেতে পারে কারণ বিভিন্ন শহরে দূতাবাসের আলাদা টিম রয়েছে। তার পরেও আমাদের কর্মীদের সমস্যা সমাধানে যথাসাধ্য কাজ করে যাচ্ছেন।
দূতাবাসে সেবা নিতে গেলে দুর্ব্যবহারের স্বীকার হন প্রবাসীরা এমন অভিযোগের প্রেক্ষিতে হাইকমিশনার বলেন, এ অভিযোগ পুরোপুরি সত্য নয়। কারণ ঢাকা থেকে ৩২ জনের টিম এসে শুধু পাসপোর্টের জন্য কাজ করছে। এটা কিন্তু অনেক বড় একটি বিষয়। তারপরও সমস্যা অভিযোগ থাকতেই পারে। জেলে বন্দিদের ব্যাপারে জানতে চাইলে শহিদুল ইসলাম বলেন, প্রতিদিন কোনো না কোনো অভিযানে আটক হচ্ছেন প্রবাসীরা। তবে সংখ্যা বলাটা কঠিন।
তিনি বলেন, শ্রম সচিবের নেতৃত্বে আলাদা কমিটি বিষয়টি নিয়ে কাজ করছে। সম্প্রতি দেশটির সিমুনিয়া ক্যাম্প পরিদর্শন করা হয়েছে বাংলাদেশি বন্দিদের সাজা শেষে দেশে দ্রুত পাঠাতে ক্যাম্প কর্তৃপক্ষের সঙ্গে আলোচনা হয়েছে। চলতি মাসেই ৮০ জন দেশে ফিরতে পারবেন। মালয়েশিয়ার প্রতিটি ক্যাম্পে ছুটে যাচ্ছেন আমাদের টিম বাংলাদেশি শনাক্ত করে দ্রুত দেশে পাঠানোর ব্যবস্থা অব্যাহত রয়েছে।
বাংলাদেশের প্রায় ১ কোটি মানুষ মধ্যপ্রাচ্য, ইউরোপ ও আমেরিকার বিভিন্ন দেশে বসবাস করে। বিগত ২০১৭-১৮ অর্থবছরে ১ হাজার ৪৯৮ কোটি (১৪.৯৮ বিলিয়ন) ডলারের রেমিট্যান্স দেশে পাঠিয়েছেন প্রবাসীরা, যা দেশের জিডিপির ১২ শতাংশ। প্রবাসীদের পাঠানো রেমিট্যান্স আমাদের অর্থনীতিকে যুগ যুগ ধরে সমৃদ্ধ করে আসছে।
যে অর্থ দিয়ে আমরা বিলাসিতা করি সেই অর্থ উপার্জনে তাদের পরিশ্রমের কথা আমাদের বিবেচনায় থাকে না। এসব আর্থিক যোদ্ধা, যাদের রেমিট্যান্সের টাকায় আমাদের অর্থনীতি সমৃদ্ধ হচ্ছে, তাদের ব্যাপারে আমাদের ইতিবাচক মনোভাব থাকা উচিত।
দেশে ও প্রবাসে অফিসিয়াল কাজকর্মে তাদেরকে ফাস্ট ট্র্যাকের আওতায় সেবা প্রদান করার উদ্যোগ নেয়া প্রয়োজন। বিদেশে বাংলাদেশ দূতাবাসকে প্রবাসীদের কল্যাণ সাধনে আন্তরিক ভূমিকা পালন করতে হবে। প্রবাসীরা যাতে কোথাও কোনো ধরনের হয়রানির শিকার না হন সে বিষয়ে সংশ্লিষ্ট মহলের খেয়াল রাখা উচিত।
তাদের রেমিট্যান্স পাঠানো সহজীকরণ, নিরাপদ বিনিয়োগের ক্ষেত্র এবং বিদেশ ফেরতদের জন্য স্বাস্থ্যবীমা চালু করতে হবে। ফলে দেশের সম্পদের সুষ্ঠু পরিচর্যা হবে। রেমিট্যান্স বৃদ্ধি পাবে। দেশের অর্থনীতি সমৃদ্ধ হবে। সর্বোপরি, প্রবাসীরা ভালো থাকলে ভালো থাকবে বাংলাদেশ।
এমআরএম/এমকেএইচ