স্বপ্ন পূরণে ওমান : কিস্তির জ্বালায় পরিবার

‘বেসরকারি একটি সমিতি থেকে ঋণ নিয়ে এবং ভিটেমাটি বিক্রি করে ওমানে এসেছি। প্রতি মাসেই মোটা অংকের কিস্তি দিতে হয়। যদি কোনো মাসে একটা কিস্তি বাকি পড়ে তাহলে আমার পরিবারকে কটূ কথা শুনতে হয়। এমনকি সমিতির লোকেরা গালিগালাজও করে। ব্যাংকের লোকেরাও টাকার জন্য বাড়ি এসে বসে থাকে।’

কথাগুলো বলছিলেন ওমানপ্রবাসী সোহাগ হোসেন। বলেন, ‘কয়েক বছর আগে ফ্রি ভিসায় মরুময় দেশ ওমানে আসি। দেশটিতে দালালের কথা অনুযায়ী কাজ পেলেও বেতন অনেক কম পাচ্ছি, যা পাই তাতে সংসারই চলে না। লোনের টাকা দিতে হিমশিম খেতে হয়। পোড়া কপাল হলে যা হয়।’

তিনি বলেন, ‘বাড়িতে সময়মতো টাকা দিতে না পারলে ব্যাংকের লোকজন ঝামেলা করে। সমিতির লোকজন তো বসেই থাকে। স্ত্রী অথবা ভাই-বোনের থাকে বিলাসী চাহিদা, সবার চাহিদা ঠিকঠাক পূরণ না করতে পারলেই শুরু হয় পারিবারিক অশান্তি। এই অশান্তি থেকেই সংসার ভেঙে যায়। আবার অনেকেই করেন আত্মহত্যার মতো জঘন্য কাজ।’

কথায় আছে যার দেশে কাজ নাই সেই নাকি যায় বিদেশ। কথাটি সম্পূর্ণ সত্য না হলেও কিছুটা মিল পাওয়া যায় প্রবাসী রেমিট্যান্স যোদ্ধাদের মাঝে। সাধারণত মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে অদক্ষ শ্রমিক পাড়ি জমান ভাগ্য বদলের স্বপ্ন নিয়ে। আত্মীয়-স্বজন এমনকি প্রিয়তমা স্ত্রী ও সন্তানদের রেখে মাসের পর মাস বছরের পর বছর প্রবাসে পরবাসী জীবন কাটাচ্ছে লাখো প্রবাসী রেমিট্যান্স যোদ্ধা।

একজন প্রবাসী যখন তার পাসপোর্ট করতে চায় তখন দালাল থেকে শুরু করে চারদিকে ভোগান্তির শিকার হতে হয়। এরপর ভিসা থেকে শুরু করে মেডিকেল, ফিঙ্গারপ্রিন্টসহ বিভিন্ন সেক্টরে কত ভোগান্তি। ম্যানপাওয়ার নামক আরেক জালিয়াতির কবলেও পড়তে হয় বিদেশগামীদের, এখানেই শেষ নয় ভোগান্তির, বিদেশগামী অদক্ষ শ্রমিকদের বেসিক ধারণা দিতে খোলা হয়েছে ট্রেনিং সেন্টার। এখানেও অর্থের বিনিময়ে সনদ মিলছে।

এতগুলো ধাপ পাড়ি দেয়ার পর আসে ভিসার পালা, যেহেতু মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে সরকারিভাবে যাওয়ার কোনো সুযোগ নেই। তাই এ সুযোগ কাজে লাগাচ্ছে মধ্যস্বত্বভোগীরা। যে ভিসা ইন্ডিয়া অথবা পাকিস্তানিরা ৫০ হাজার টাকায় নিতে পারে সেই একই ভিসা বাংলাদেশিরা বিক্রি করছে ২ থেকে ৩ লাখ টাকায়।

তিনি বলেন, গ্রামের খেটে খাওয়া অসহায় মানুষটি তার পরিবারের মুখে হাসি ফোটানোর স্বপ্ন নিয়ে ভিটেমাটি বিক্রি করে পরিশোধ করেন ভিসার টাকা। দেশে প্রবাসীদের জন্য একটি প্রবাসী কল্যাণ ব্যাংক থাকলেও প্রবাসীরা কতটুকু সুবিধা ভোগ করছে একমাত্র প্রবাসীরাই বলতে পারবে।

‘এভাবেই ভোগান্তির মধ্য দিয়ে পথচলা শুরু একজন প্রবাসী রেমিট্যান্স যোদ্ধার। দেশের ভোগান্তিই কি শেষ? এত সহজেই একজন প্রবাসীর জীবন যুদ্ধ শেষ হয়ে যাবে এমনটি মনে করলে ভুল হবে। প্রবাসে যাওয়ার পর শুরু হয় নতুন এক জীবন, আত্মীয়-স্বজন, বন্ধু-বান্ধব রেখে নতুন এক দেশে ভিন্ন পরিবেশে শুরু হয় জীবনের নতুন আরেক সংগ্রাম। সকাল ৬টা থেকে সন্ধ্যা ৬টা নাগাদ ৪৫ ডিগ্রি তাপমাত্রায় কাজ করে সন্ধ্যায় বাসায় এসে গোসল করে রান্না করতে করতেই রাত ১০টা বেজে যায়। মধ্যপ্রাচ্য রাত ১০টা মানে বাংলাদেশে রাত তখন ১টা।’

সোহাগ বলেন, একজন প্রবাসী যখনই মাস শেষে বেতন পায়, তখন তার খরচের জন্য অল্প কিছু টাকা রেখে বাকি টাকাই দেশে পাঠিয়ে দেয় শুধু আপনজনদের মুখে হাসি ফোটাতে। ঠিকমতো না খেয়ে না ঘুমিয়ে উত্তপ্ত রোদের মাঝে কাজ করে আবার অনেকেই মাসে ঠিকমতো বেতন পান না।

সব প্রবাসীর পক্ষ থেকে সরকারের কাছে একটাই দাবি, প্রবাসী রেমিট্যান্স যোদ্ধাদের যেন একটু মূল্যায়ন করা হয়। এই প্রবাসীরাই পরিবার ও দেশের জন্য নিজের সবকিছু বিলিয়ে দিচ্ছে। সঠিক উপায়ে যেন বাংলাদেশিদের বিদেশ পাঠানোর উদ্যোগ নেয়া হয়। আর যেন কেউ আমার মতো ভিটেমাটি বিক্রি করে সর্বস্ব হারিয়ে পরবাসী না হয়।

এমআরএম/জেআইএম

প্রবাস জীবনের অভিজ্ঞতা, ভ্রমণ, গল্প-আড্ডা, আনন্দ-বেদনা, অনুভূতি, স্বদেশের স্মৃতিচারণ, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক লেখা পাঠাতে পারেন। ছবিসহ লেখা পাঠানোর ঠিকানা - [email protected]