মালয়েশিয়ায় সবজি চাষে ভাগ্য ফিরল নিরবের
ভাগ্য পরিবর্তনের আশায় স্টুডেন্ট ভিসায় নিরব মালয়েশিয়ায় আসেন। প্রথমে বিভিন্ন সমস্যার মুখোমুখী হন। পর্যটন নগরী মালয়েশিয়ার প্রত্যন্ত অঞ্চলে এমন হাজার হাজার বাংলাদেশি রয়েছেন যাদের প্রথম পর্বের ইতিহাস খুবই কষ্টের। নতুন দেশে কষ্টের বহু কারণ রয়েছে। ভাষা, সংস্কৃতি, রাস্তা-ঘাট সবই অচেনা-অজানা। ফলে প্রতি পদে পদে অপমান, হয়রানির শিকার হতে হয় নতুনদের।
প্রথমে এদেশে এসে খুব খারাপ লাগতো, কিছুই বুঝতাম না। অভাবের কারণে বাসা ভাড়া দিতে পারিনি। তাছাড়া পড়াশোনার খরচ আছে। দিন-রাত পরিশ্রম করেছি। হাতে ফোসকা পড়েছে, আবার সেই ফোসকা পড়া হাতেই কাজে গিয়েছি। একটা সময় আমি অন্যের হয়ে কাজ করেছি এখন আমার আন্ডারে ১০-১২ জন মালয়েশিয়ান লোক চাকরি করে জীবিকা নির্বাহ করছে। আজ আমি সত্যিই খুশি। অভাব অনটন নেই। মালয়েশিয়ায় আজ আধুনিক মডেলের গাড়ি চালাচ্ছি, বেশ ভালো আছি বলছিলেন মালয়েশিয়া প্রবাসী নিরব।
মালয়েশিয়ায় যারা কাজ না পেয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে তাদেরও কাজ দিয়ে সহযোগিতা করছেন নিরব। বেকারদের জন্য প্রেরণার উৎস হয়ে দাঁড়িছে নিরবের মতো প্রবাসী বাংলাদেশিরা। রাজধানী কুয়ালালামপুর বা আশপাশের শহরগুলোতে চোখে পড়ার মতো বাংলাদেশি অনেক প্রতিষ্ঠান রয়েছে। এছাড়া মালয়েশিয়ায় মাল্টি মিডিয়া কোম্পানি, বিভিন্ন শিল্প-প্রতিষ্ঠান, ব্যাংক বীমাতে বাংলাদেশিদের ঈর্ষণীয় সফলতা রয়েছে।
শরীয়তপুরের ছেলে মো. নীরব হোসেন মালয়েশিয়ায় নিজের স্বপ্ন যেমনি পূরণ করেছেন তেমনি প্রবাসী বাংলাদেশিদের স্বপ্ন পূরণে পিছিয়ে নেয়। তার সহযোগিতায় মালয়েশিয়ায় বহু বাংলাদেশি দেশে নিয়মিত টাকা পাঠানোর স্বপ্ন দেখছে। নিরবের প্রতিষ্ঠানেই কাজ করছে বহু বাঙালি।
সফলতার রহস্য জানতে চাইলে নিরব জানায়, এক ব্রিটিশ বন্ধুর অনুপ্রেরণায় মালয়েশিয়ার মাটিতে কৃষি কাজ শুরু করি। পাহাড় ঘেরা গেন্তিং হাইল্যান্ড এলাকায় সবজি ফার্ম করার উদ্যোগ নিই।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, শরীয়তপুরের ভেদরগঞ্জ থানার মনুয়া গ্রামের মুক্তিযোদ্ধা হাজী আব্দুল আজিজের একমাত্র ছেলে মো. নিরব হোসেন। ২০০১ সালে উচ্চশিক্ষার জন্য পাড়ি জমান মালয়েশিয়ায়। প্রথমে হোটেল ম্যানেজমেন্টে পড়াশোনা শুরু করেন। পাশাপাশি একটি রেস্টুরেন্টে পার্টটাইমের চাকরি করতেন। চাকরি করার সময় পরিচয় হয় ব্রিটিশ নাগরিক অ্যালেস্টারের সঙ্গে। দু’জনই একটি থ্রি-স্টার রেস্টুরেন্টে চাকরি করতেন।
নিরবের ইচ্ছা ছিল মালয়েশিয়া থেকে পড়াশোনা শেষ করে ইউরোপের ভালো কোনো দেশে পাড়ি জমানো। কিন্তু ব্রিটিশ নাগরিকের পরামর্শে থেকে যান মালয়েশিয়ায়। তিনিই মূলত নিরব হোসেনকে পরামর্শ দেন মালয়েশিয়াতে সবজি ফার্ম করার। সেই থেকেই স্বপ্ন দেখতে শুরু করেন নিরব।
কীভাবে জমি পেলেন জানতে চাইলে নিরব জানান, কলেজে পড়াকালীন পরিচয় হয় মালয়েশিয়ার পাহাং রাজ্যের রয়েল পরিবারের তরুণী ফাতেমা বিনতে ইসমাইলের সঙ্গে। একদিন ক্লাস শেষে ফাতেমার কাছে তার স্বপ্নের কথা বলতেই ফাতেমা গ্যান্টিং হ্যায়ল্যান্ডে তাদের নিজেদের জমির কথা বলেন এবং তার পিতা মোহাম্মদ ইসমাইল উদ্দীনের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেন।
নিরব জানায়, মালয়েশিয়া ব্যবসা শুরু করতে লোকাল অভিভাবকের প্রয়োজন হয়। আকার হাসিল এসডি এন বিএইসডি নামক কোম্পানির তত্ত্বাবধানে সবজি চাষে গেন্টিং গ্রিন গার্ডেনের ব্যবস্থা করি।
রাজধানী কুয়ালালামপুর শহর থেকে ৪৭ কিলোমিটার দূরে মাটি থেকে ৮৫০ মিটার ওপরে পাহাড়ের ওপর গেন্টিং নামক স্থানে ৫ একর জমির মধ্যে সবজি চাষ শুরু করি। বাগানে উৎপাদন হয় বিশ্বমানের কয়েক প্রকার সালাদ পাতা যার মধ্যে লেটুস পাতা, লোল্লো বিয়ানদো, রেডি সচিও, ওয়াটারক্রেস, বাটার লেটুস, রকেট-আরুগুলা, রেড ওরাস, গ্রিন রোমাইন, ড্যান্ডেলিয়ন পাতা।
এখানকার সালাদ পাতা মালয়েশিয়ার ফাইভস্টার হোটেল, কেএফসি, ম্যাকডোনালস, নান্দুস, স্টারহাবের মতো সুপারশপ ছাড়াও সিংগাপুর এবং দুবাইয়ে রফতানি করা হয়। এছাড়া জার্মান, ইউরোপ ও অস্ট্রেলিয়ায় রফতানি করা হয় নিরবের সবজি।
নিরব বলেন, জার্মান, ইতালি, ফ্রান্স, অস্ট্রেলিয়া, সিঙ্গাপুর, থাইল্যান্ড, জাপান, ইংল্যান্ড ও নিউজিল্যান্ডসহ বিভিন্ন দেশে ব্যবসায়ীকরা আমার এ সবজি বাগান সফর করেছেন। যার মধ্যে নেদারল্যান্ডের এনজা কোম্পানি, টোকিওর সাকাতা ও জার্মানির বায়ার নামক ৩টি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে কাজ শুরু হয়েছে। আগামী জুন মাসে তিনি নিউজিল্যান্ডের উদ্দেশে রওনা দেবেন। সেখানে তিনি নিজস্ব সালাদ ফার্মের ব্যবসা শুরু করতে যাচ্ছেন।
এমআরএম/এমএস