যুক্তরাষ্ট্রে গাড়ি প্রকৌশলে বাংলাদেশি নারী

অনন্ত সাইফ
অনন্ত সাইফ অনন্ত সাইফ , মিশিগান প্রতিনিধি
প্রকাশিত: ০৫:১২ এএম, ১৪ জুন ২০১৭

মেরি বারা, যুক্তরাষ্ট্রের সর্ববৃহৎ গাড়ি নির্মাণ প্রতিষ্ঠান জেনারেল মটরসের সিইও। গাড়ি ইন্ডাস্ট্রিজে প্রধানের দায়িত্বে তিনি প্রথম নারী। জেনারেল মটরসের অত্যন্ত প্রতিকূল সময়ে হাল ধরেন তিনি। অল্প সময়ে প্রতিষ্ঠানেক বেশ ভাল অবস্থানে নিয়ে আসেন।

২০১৫ ও ২০১৬ সালে কোম্পানিটি রেকর্ড লভ্যাংশের মুখ দেখে। এর সব শ্রমিক-প্রকৌশলী টার্গেটের ১৬৭ ভাগ বেশি সাফল্য অর্জন করেন। এতে ফোর্বস ম্যাগাজিন ও ফরচুন ম্যাগাজিন সেরা নারী নেতৃত্ব, ক্ষমতাধর ব্যবসায়ী, অটো ইন্ডাস্ট্রিজে ক্ষমতাধর নারী হিসেবে মেরি বারাকে মনোনীত করে।

সময়ের পরিবর্তনের সঙ্গে বেড়েছে নারী চালক। এছাড়া গাড়ি ক্রয় থেকে ‍শুরু করে গাড়ি চালনা ও গাড়ি প্রকৌশলে বিশ্বের অন্যান্য নারীরা যেখানে এগিয়ে, সেখানে বাংলাদেশি নারীরাই বা পিছিয়ে থাকবে কেন?

এ ক্ষেত্রে দিন-দিন এগিয়ে যাচ্ছেন যুক্তরাষ্ট্র প্রবাসী বাংলাদেশি নারীরা। প্রকৌশল বিদ্যায় পড়াশোনা শেষে অনেকেই এখন কাজ করছেন বিখ্যাত গাড়ি নির্মাণ ও গাড়ির যন্ত্রাংশ নির্মাণ প্রতিষ্ঠানে। নিজেদের মেধা, মনন আর একাগ্রতা দিয়ে পুরুষের সঙ্গে সমানতালে আজ সফলতার স্তরে পৌঁছেছেন বাংলাদেশি নারীদের অনেকেই। বাংলাদেশি কমিউনিটিতে তার সফল নেতৃত্ব দিয়ে যুক্তরাষ্ট্রে উজ্জ্বল করেছেন স্বজাতি ও স্বদেশকে।

মিশিগানের গাড়ির নগরী ডেট্রয়েট এবং তার পাশের শহরগুলোতে যুক্তরাষ্ট্রের প্রধান তিনি প্রতিষ্ঠান জেনারেল মটরস, ফোর্ড কোম্পানি ও ফিয়াট ক্রাইসলার। এছাড়াও রয়েছে টোয়োটা, নিসান, হুন্দাই, মার্সিডিজের প্রকৌশলী কেন্দ্র। আরও গড়ে উঠেছে ছোট-বড় অনেক যন্ত্রাংশ নির্মাণকারী প্রতিষ্ঠান। প্রায় প্রতিটি অটোমোটিভ প্রতিষ্ঠানে রয়েছে বাংলাদেশি নারী প্রকৌশলী।

এদের একজন তানজিমা মুস্তারিন। ফিচার ওনার, ড্রাইভার নোটিফিকেশন,কানেক্টিভিটি পদে জেনারেল মটরসে টেকনিক্যাল লিডার হিসাবে প্রথম বাংলাদেশি নারী তিনি। বুয়েট থেকে ইলেকট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং শেষ করে উচ্চশিক্ষার্থে যুক্তরাষ্ট্রে আসেন। পারডু ইউনিভার্সিটি থেকে মাস্টার্স শেষে জেনারাল মটরসে কর্মজীবন শুরু।

১৯৯৮ সালে গাড়ি প্রকৌশলী হিসাবে কাজ শুরুর পর এরইমধ্যে কাজ করেছেন গাড়ির বিভিন্ন ইলেকট্রিক্যাল গ্রুপে। সফটওয়ার লিড ও ইন্সট্রুমেন্ট ক্লসাটারের দায়িত্বেও ছিলেন। কাজের পাশাপাশি তিনি বাংলাদেশের প্রকৌশলীদের সহায়তা দিতে সদা উন্মুখ। মার্কিন মু্ল্লুকে প্রকৌশলীদের সব অনুষ্ঠানে সক্রিয় তিনি।

একই প্রতিষ্ঠানে স্টিয়ারিং হুইল ও ড্রাইভার এয়ার ব্যাগ, প্রকৌশলী ম্যানেজার হিসেবে কর্মরত মৌলি আহমেদ। গাড়ি প্রকৌশলে কাজ শুরু অটোমোটিভ সাপ্লায়ার কোম্পানি ডেলফাই অটোমোটিভ সিস্টেমসে। পরে মেগনা অটোমোটিভসে। ২০১০ সালে জেনারেল মটরসের পথচলা শুরুর পর ২০১৬ সালের নভেম্বরে প্রথম বাংলাদেশি নারী হিসাবে প্রকৌশলী ম্যানেজার হিসেবে পদোন্নতি পান।

মৌলি মিশিগান স্টেট ইউনিভার্সিটি থেকে ইলেকট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং করেছেন। চাকরির পাশাপাশি বাংলাদেশি প্রকৌশলীদের সংগঠন ‘আবিয়া’র মিশিগান শাখার সেক্রেটারি দায়িত্ব সামলেছেন তিনি।

জেনারেল মটরসের লিড এনালাইসিস প্রকৌশলী আফরোজা আক্তার। গাড়ি প্রকৌশলে কাজ শুরু করেন ২০০০ সালে। ডেলফাইসহ আরও তিনটি প্রতিষ্ঠানে কাজ করেছেন। সাড়ে ১০ বছর আছেন জেনারেল মটরসে। নতুন টুল-টেকনোলজি উদ্ভাবনে কাজ করেছেন, এ বিষয়ে বৈজ্ঞানিক গবেষণাপত্র প্রকাশিত হয়েছে তার।

বুয়েটের যন্ত্রপ্রকৌশল বিষয়ে ব্যাচেলর ও ইউনিভার্সিটি অব সাউথ ক্যারলিনা থেকে মাস্টার্স করেছেন। কাজের পাশাপাশি বিভিন্ন সামাজিক ও কমিউনিটি প্রোগ্রামে সক্রিয় অংশ নেন। ছিলেন প্রকৌশলীদের সংগঠনের সেক্রেটারি। এছাড়া মিশিগান সায়েন্স সেন্টারের সায়েন্স, টেকনোলজি, ইঞ্জিনিয়ারিং ও ম্যাথ (স্টিম) প্রজেক্টের রোল মডেল হিসাবে কাজ করছেন। উইমেন ইন মোশনেরও সদস্য তিনি।

বেকার সায়েন্স অলিম্পিক টিমের কোচ হিসাবে যুক্তরাষ্ট্রের  জাতীয় পর্যায়েও গিয়েছেন তিনি। সফল নেতৃত্বগুণে বাংলাদেশি কমিউনিটিতে জনপ্রিয় মুখ আফরোজা।

বশ (Bosch) কোম্পানিতে ক্যালিব্রেশন প্রকৌশলী রেজওয়ানা হক। চট্টগ্রাম প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় থেকে তড়িৎ প্রকৌশল শেষ করে দেশেই এক প্রাইভেট প্রতিষ্ঠানে কাজ করেন। বিয়ের পর আসেন আমেরিকায়। সন্তানের জন্ম, লালন-পালনে কিছু সময় গেলে ফের ভর্তি হন মাস্টার্স প্রোগ্রামে। মাস্টার্স শেষে জার্মান অটোমটিভ সাপ্লায়ার বশ-এ চাকরি শুরু করেন। ২০১২ সালে গাড়ির বডি ইলেকট্রিক ও হিউম্যান –মেশিন ইন্টারফেস গ্রুপে কাজ করছেন। পরিবার, কর্মজীবনে ব্যস্ততার পাশাপাশি সময় দেন প্রবাসী বাংলাদেশিদের বিভিন্ন সংগঠনে। বাংলাদেশি আমেরিকান ডেমোক্র্যাটিক ককাসের (বিএডিসি) কার্যনির্বাহী কমিটির সহ সভাপতি ছিলেন তিনি।

ফিয়েট ক্রাইস্লার আটোমোটিভ কোম্পানির এরো থারমাল প্রকৌশলী মাসুমা খন্দকার। বুয়েট থেকে যন্ত্র প্রকৌশল শেষে বাংলাদেশে এক প্রাইভেট প্রতিষ্ঠানে কাজ করেন। পরে ওয়েন স্টেট ইউনিভার্সিটি ডেট্রয়েট থেকে মাস্টার্স শেষে প্রায় সাত বছর বর্তমান চাকরিতে। এখন বাংলাদেশি প্রকৌশলীদের সংগঠনে সক্রিয় সদস্য। এখানে নতুন পড়তে আসা বাংলাদেশি শিক্ষার্থীদের পছন্দের নাম মাসুমা।

নিগার সুলতানা রিম্পি ফোর্ড মোটর কোম্পানির সিস্টেম প্রকৌশলী। বাংলাদেশে মিলিটারি ইনস্টিটিউট অব সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজি থেকে তড়িৎ প্রকৌশল সম্পন্ন করে গ্রামীণফোনে বছরখানেক কাজ করেছেন। পরে উচ্চৎশিক্ষার্থে ওকলাহোমা স্টেট ইউনিভার্সিটি থেকে তড়িৎ ও কম্পিউটার প্রকৌশলে মাস্টার্স শেষ করেন। এরপর যোগ দেন ফোর্ড-এ। এখন সামাজিক ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে সক্রিয় অংশগ্রহণ তার।

একই প্রতিষ্ঠানের গ্লোবাল ক্যাপাসিটি প্লানিংয়ে রয়েছেন মেহনাজ চৌধুরী। জর্জিয়া ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজি থেকে ইন্ডাস্ট্রিয়াল এবং সিস্টেম ইঞ্জনিয়ারিংয়ে ব্যাচেলর শেষে অ্যামাজন, টার্গেটসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে কাজ করেছেন। ২০১৫ সালে যোগ দেন ফোর্ড মোটরে। ইতোমধ্যে হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ফিন্যান্স ও প্লানিংয়ে সার্টিফিকেট কোর্সও করেছেন।

জেনারেল মটরসে ব্যাটারি প্রকৌশলী হিসেবে রয়েছেন নিপা দে। কাজ করছেন প্রায় ৩ বছর। এইচএসসি শেষে বাবা-মায়ের সঙ্গে আসেন যুক্তরাষ্ট্রে। নিউইয়র্কে কমিউনিটি কলেজ ও নিউইয়র্ক সিটি কলেজ থেকে কেমিক্যাল প্রকৌশলে ব্যাচেলর শেষ করে মিশিগানে জেনারেল মটরসে চাকরি নেন। উন্নত ব্যাটারি প্রযুক্তির বিভিন্ন টেস্ট, ভ্যালিডেশন, প্রজেক্ট লিডার বিভিন্ন পদে কাজ করে চলেছেন তিনি।

জিনাত নাজনিন লিজা ভ্যালেও এর হয়ে জেনারাল মটরসে গাড়ির রেয়ারভিও ক্যামেরার কাজ করেন। এর আগে প্যাসিভ সেফটি ডিজাইনে অটোলিভ এবং এল্পস ইলেকট্রিকের হয়ে কাজ করেছেন। জিনাত মিশিগানের ওকল্যান্ড ইউনিভার্সিটি থেকে ইলেকট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে ব্যাচেলর শেষ করেছেন।

ভেলিডেশন প্রকৌশলী হিসাবে ২০১২ সালে জেনারেল মটরসে আসেন অনিয়া কুতুব। বর্তমানে গাড়ি নির্মাণ লাইনের ম্যানুফ্যাকচারিং প্রসেস সিমুলেশনে কাজ করছেন। খুলনা প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় থেকে যন্ত্র প্রকৌশলে ব্যাচলর শেষে  যুক্তরাষ্ট্রের ওয়েন স্টেট বিশ্ববিদ্যালয় থেকে মাস্টার্স করেছেন। দুই সন্তানের জননী অনিয়া কাজের পাশাপাশি সামাজিক বিভিন্ন কাজ নিয়েও ব্যস্ত।

২০০৮ সালে জেনারেল মটরসে অটোমোটিভ কন্ট্রোল প্রকৌশলী হিসেবে কাজ শুরু করেন শামসুর নাহার। কাজ করেছেন ইঞ্জিন কেলিব্রেশনে, হাইব্রিড এল্গরিথম ও সফটয়ার ডেভেলপমেন্টে।

একই প্রতিষ্ঠানে রয়েছেন করবী বাশার। পাওয়ার ইলেকট্রিক ইনভারটার ডিজাইনে কাজ করেছেন ফিয়েট ক্রাইস্লার অটোমটিভসে।

জেনারাল মটরসে কম্পিউটার আইডেড ইঞ্জিনিয়ারিং (সিএই) হিসেবে আছেন বাংলাদেশি কানাডিয়ান ফারাহ আহমেদ। নবম শ্রেণিতে পড়ার সময় পরিবারের সঙ্গে কানাডায় চলে আসেন। অটোয়া ইউনিভার্সিটি থেকে কেমিক্যাল প্রকৌশলে ব্যাচেলর  ও পরিবেশ প্রকৌশলে মাস্টার্স করে আড়াই বছর ধরে জেনারেল মটরসে কর্মরত।

ফারজানা রহমান, জেনারেল মটরসের সিএই প্রকৌশলী,  স্টাকচারাল এনালাইসিস ট্রান্সমিশন সিস্টেম। বুয়েট থেকে ২০০৯ সালে যন্ত্র প্রকৌশলে ব্যাচেলর এবং আমেরিকার আউবারন ইউনিভার্সিটি থেকে  যন্ত্র প্রকৌশলে মাস্টার্স সমাপ্ত করেছেন।

সাদিয়া নাসরিন। বুয়েট থেকে যন্ত্র প্রকৌশলে ব্যাচেলর, যুক্তরাষ্ট্রের ওকলাহোমা স্টেট ইউনিভার্সিটি থেকে মাস্টার্স ও ওহাইয়ো স্টেট ইউনিভার্সিটি থেকে পিএইচডি ডিগ্রি নিয়ে গাড়ি নির্মাণ কোম্পানিতে চাকরি শুরু করেছেন চলতি মাসে। ছিলেন বাংলাদেশ স্টুডেন্ট অ্যাসোসিয়েশনের প্রেসিডেন্ট।

যুক্তরাষ্ট্রে বাংলাদেশি সফল নারীদের তালিকায় আরও রয়েছেন ফিয়াট ক্রাইস্লার অটোমটিভ কোম্পানির ব্যবস্থাপক সোমা হক, জেনারেল মটরসের আইটি টেস্ট এনালিস্ট সায়েদা আহমেদ, ফোর্ড মোটরের সাইফা, জেনারেল মটরসে তাসনিম এলিন, তাঞ্জিন হায়দার, শারমিন আক্তার, আদিবা ইসলাম, লিসা বেগম, রেজিনা নবী, সায়েদা আহমেদ, ফিয়াট ক্রাইসলারে হোসনে আরা,  সাবরিনা রহমা সহ অনেকে।

‘যে রাঁধে সে চুল ও বাঁধে’ এ প্রবাদকে প্রতিনিয়ত সত্যে পরিণত করে চলেছেন এসব নারীরা। যুক্তরাষ্ট্রে গাড়ি নির্মাণ প্রতিষ্ঠান দিন দিন নিজের মেধা ও দক্ষতার স্বাক্ষর রেখে এগিয়ে চলেছেন তারা, সেইসঙ্গে প্রতিনিয়ত উজ্জ্বল করে চলেছেন দেশের মর্যাদা।

এসআর/আরআইপি

প্রবাস জীবনের অভিজ্ঞতা, ভ্রমণ, গল্প-আড্ডা, আনন্দ-বেদনা, অনুভূতি, স্বদেশের স্মৃতিচারণ, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক লেখা পাঠাতে পারেন। ছবিসহ লেখা পাঠানোর ঠিকানা - [email protected]