‘জামায়াত একটি আদর্শ, যা রাষ্ট্র-সমাজের জন্য ক্ষতিকর’
‘দেরিতে হলেও সরকার আমাদের দাবি অনুধাবন করেছে ও আমলে নিয়েছে, স্বাগত জানাই। তবে পরবর্তী পরিস্থিতি সামাল দিতে জাতীয় ঐক্য গড়ে তুলে রাজনৈতিক সংগ্রাম অব্যাহত রাখতে হবে। পাশাপাশি ধাপে ধাপে অন্য ধর্মভিত্তিক দল ও সাম্প্রদায়িক রাজনীতি নিষিদ্ধ করা বাঞ্ছনীয়।’
কথাগুলো বলছিলেন ইতিহাসের অধ্যাপক, গবেষক মুনতাসীর মামুন। একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির এই প্রতিষ্ঠাতা সদস্য দীর্ঘদিন ধরে ধর্মভিত্তিক রাজনীতি নিষিদ্ধের দাবি করে আসছেন।
বিষয়টি নিয়ে মুখোমুখি হন জাগো নিউজের। একান্ত আলাপে জামায়াত-শিবির নিষিদ্ধ হওয়া ও পরবর্তী পরিস্থিতি থেকে উত্তরণে নানা পরামর্শ দিয়েছেন তিনি। সাক্ষৎকার নিয়েছেন সালাহ উদ্দিন জসিম।
গত তিন দশকে জামায়াতের যে অর্থনৈতিক শক্তি সৃষ্টি হয়েছে, সেটি অটুট থাকলে জামায়াতের প্রায় কোনো ক্ষতিই হবে না। অর্থাৎ, এ নিষেধাজ্ঞা কার্যকর করতে হলে অর্থনৈতিক ভিত্তির কথা যেমন সরকারকে ভাবতে হবে, তেমনি জামায়াতি মওদুদী আদর্শের বিরুদ্ধে রাজনৈতিকভাবে সংগ্রাম চালিয়ে যেতে হবে।
জামায়াত-শিবির নিষিদ্ধ হলো, আপনার প্রতিক্রিয়া কী?
আমরা গত ৩০ বছর এটা নিয়ে আন্দোলন করে আসছি। জাহানারা ইমাম থেকে শাহরিয়ার কবির- বিশেষ করে ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি, আমরা এবং নাগরিক সমাজের অনেকে গত তিন দশক জামায়াত-শিবির নিষিদ্ধ করার দাবি তুলেছি। সরকার দেরিতে হলেও বিষয়টি অনুধাবন করেছে এবং জামায়াত-শিবির নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছে। আমরা এটিকে স্বাগত জানাই।’
- আরও পড়ুন
- ‘জামায়াতকে নিষিদ্ধ করা প্রয়োজন, কিন্তু এটাই যথেষ্ট নয়’
- জামায়াত-শিবির নিষিদ্ধ, গেজেট জারি
- অন্য ব্যানারে এলেও জামায়াতের রাজনীতি নিষিদ্ধ হবে: ইনু
কোনো সংঘাতের আশঙ্কা আছে কি না?
জামায়াত-শিবির নিষিদ্ধ হওয়ার পর স্বাভাবিকভাবে দেশ ও দেশের বাইরে একটি অভিঘাত হবে। দেশের অভ্যন্তরে অনেকে বলবেন, গণতন্ত্র সংকুচিত করা হচ্ছে। আইনগত প্রক্রিয়া ঠিক নেই। এটি করা উচিত নয়। বিদেশে অনেকে প্রায় একই রকম কথা বলবেন। আমাদের কথা খুব পরিষ্কার- যে আইনে জামায়াত-শিবিরকে নিষিদ্ধ করা হয়েছে, তা যুক্তিযুক্ত। গত ৫০ বছর তারা বিভিন্নভাবে অন্তর্ঘাতমূলক কার্যক্রম চালিয়ে আসছে এবং সম্প্রতি যে ঘটনা ঘটেছে, স্পষ্টত তার জন্য সিংহভাগ দায়ী জামায়াত। সুতরাং, এটি (নিষিদ্ধ করা) ছাড়া সরকারের উপায় নেই। এই নিষিদ্ধের ফলে জামায়াতের অন্তর্ঘাতমূলক কাজকর্ম বাড়তে পারে।
শেখ হাসিনা থাকার কারণে যুদ্ধাপরাধের বিচার সম্ভব হয়েছিল। তিনিই পেরেছেন জামায়াতকে নিষিদ্ধ করতে। এর বিরুদ্ধে জাতীয় ঐক্য গড়ে প্রতিরোধ গড়তে তিনিই একমাত্র নেতৃত্ব দিতে পারবেন।
পরিস্থিতি মোকাবিলায় আপনার পরামর্শ কী?
নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা ও তা কার্যকর করা দুটি আলাদা বিষয়। গত তিন দশকে জামায়াতের যে অর্থনৈতিক শক্তি সৃষ্টি হয়েছে, সেটি অটুট থাকলে জামায়াতের প্রায় কোনো ক্ষতিই হবে না। অর্থাৎ, এই নিষেধাজ্ঞা কার্যকর করতে হলে অর্থনৈতিক ভিত্তির কথা যেমন সরকারকে ভাবতে হবে, তেমনি জামায়াতি মওদুদী আদর্শের বিরুদ্ধে রাজনৈতিকভাবে সংগ্রাম চালিয়ে যেতে হবে।
কেননা, মূল হচ্ছে জামায়াত একটি আদর্শ, যা রাষ্ট্র-সমাজের জন্য ক্ষতিকর। তবে আওয়ামী লীগের পক্ষে একা এটি করা সম্ভব হবে না। তাদের সমমনা রাজনৈতিক দল, নাগরিক সমাজ, তাদের দল (আওয়ামী লীগ) থেকে আগে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়া নেতাদের নিয়ে এবং তরুণ সমাজকে নিয়ে এ সংকট মোকাবিলা করতে হবে। শেখ হাসিনা থাকার কারণে যুদ্ধাপরাধের বিচার সম্ভব হয়েছিল। তিনিই পেরেছেন জামায়াতকে নিষিদ্ধ করতে। এর বিরুদ্ধে জাতীয় ঐক্য গড়ে প্রতিরোধ গড়তে তিনিই একমাত্র নেতৃত্ব দিতে পারবেন।
জামায়াত ছাড়াও অনেক ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দল আছে, যারা সরকার উৎখাত ও বাংলাদেশকে ধর্মভিত্তিক একটি মৌলবাদী দেশ হিসেবে গড়তে চান। জামায়াতের পরে এরা থেকে যাবে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বিনষ্ট করার জন্য এবং সরকারকে হটানোর জন্য।
জামায়াত-শিবির নিষিদ্ধই কি সমস্যার সমাধান করবে?
না। আমরা সব সময় বলেছি, বঙ্গবন্ধু যে রাজনীতিতে ধর্ম নিষিদ্ধ করেছিলেন, সেই ক্লজটি আরোপ করতে। কেননা জামায়াত ছাড়াও অনেক ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দল আছে, যারা সরকার উৎখাত ও বাংলাদেশকে ধর্মভিত্তিক একটি মৌলবাদী দেশ হিসেবে গড়তে চান। জামায়াতের পরে এরা থেকে যাবে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বিনষ্ট করার জন্য এবং সরকারকে হটানোর জন্য। সরকার হয়তো ভবিষ্যতে সেটা চিন্তা করতে পারে। কিন্তু এখন আপাতত যেটুকু করেছে, তাতেই আমরা তাদের স্বাগত জানাই। ধাপে ধাপে অগ্রসর হওয়াই বাঞ্ছনীয়।
বৃহস্পতিবার (১ আগস্ট) স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জননিরাপত্তা বিভাগ থেকে প্রজ্ঞাপন জারি করে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী ও দলটির ছাত্র সংগঠন বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবির নিষিদ্ধ করেছে সরকার। এতে বলা হয়, সরকারের কাছে যথেষ্ট তথ্য-প্রমাণ রয়েছে যে, বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী এবং এর অঙ্গ সংগঠন বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবির সম্প্রতি সংঘটিত হত্যাযজ্ঞ, ধ্বংসাত্মক কার্যকলাপ ও সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডে সরাসরি এবং উসকানির মাধ্যমে জড়িত ছিল। সরকার বিশ্বাস করে যে, জামায়াত ও শিবিরসহ এর সব অঙ্গ সংগঠন সন্ত্রাসী কার্যকলাপের সঙ্গে জড়িত রয়েছে। তাই ‘সন্ত্রাসবিরোধী আইন, ২০০৯’ এর ধারা ১৮(১) এ দেওয়া ক্ষমতাবলে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী এবং বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবিরসহ এর সব অঙ্গ সংগঠনকে রাজনৈতিক দল ও সংগঠন হিসেবে নিষিদ্ধ ঘোষণা করলো।
এসইউজে/এএসএ/জিকেএস