প্লাটিনাম জয়ন্তী

কোথায় দাঁড়িয়ে আছে আওয়ামী লীগের মূলনীতি?

সালাহ উদ্দিন জসিম
সালাহ উদ্দিন জসিম সালাহ উদ্দিন জসিম , জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক
প্রকাশিত: ০৩:২৬ পিএম, ২৩ জুন ২০২৪

নানা ঝড়-ঝঞ্ঝার মধ্য দিয়ে ৭৫ বছর পার করেছে আওয়ামী লীগ। দীর্ঘ পথ পরিক্রমায় দলটির অর্জন অনেক। সবচেয়ে বড় অর্জন হলো দলটির নেতৃত্বে শোষণ-বঞ্চনার বিরুদ্ধে আন্দোলন করে একটি স্বাধীন দেশের অভ্যুদয়। স্বাধীন বাংলাদেশেও দলটির অবদান অনস্বীকার্য। স্বাধীনতার পর বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে তিন বছর, শেখ হাসিনার নেতৃত্বে পাঁচ মেয়াদে ক্ষমতায় আওয়ামী লীগ। এ সময়ে নানা সূচকে এগিয়েছে দেশ।

দীর্ঘ এই সময়ে আওয়ামী লীগের গঠনতান্ত্রিক প্রক্রিয়া কতটুকু এগিয়েছে। গঠনতন্ত্রের মূলনীতিই বা কোথায় দাঁড়িয়ে তা নিয়ে বিচার-বিশ্লেষণের সময় এসেছে। গঠনতন্ত্রের ২(ক) অনুযায়ী, আওয়ামী লীগের মূলনীতি চারটি- বাঙালি জাতীয়তাবাদ, গণতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতা ও সমাজতন্ত্র তথা শোষণমুক্ত সমাজ ও ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা।

রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলেন, ‘বাংলাদেশে আওয়ামী লীগ বিকল্পহীন দল। একমাত্র বৈধ দল। তবে দলটি তার মূলনীতি থেকে অনেক দূরে সরে গেছে। আওয়ামী লীগ ভালো কাজ করুক, দেশ বাঁচাক।’ অবশ্য আওয়ামী লীগ নেতারা বলছেন, দলটি তার মূলনীতি এবং স্বকীয়তার ওপর ৭৫ বছর ধরে দাঁড়িয়ে। বাংলাদেশ স্বপ্ন দেখে, আওয়ামী লীগ সেই স্বপ্ন সম্ভব করে।

চারটি মূলনীতি এখনো সংবিধানে আছে। কিন্তু সমাজতন্ত্রের নামে বাংলাদেশে চলছে নগ্ন পুঁজিবাদ। ধর্মনিরপেক্ষতার নামে ধর্মনির্ভরতা, সবকিছুই সংবিধানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক, বঙ্গবন্ধুর আদর্শের সঙ্গে সাংঘর্ষিক।- অধ্যাপক সৈয়দ আনোয়ার হোসেন

ইতিহাসের অধ্যাপক সৈয়দ আনোয়ার হোসেন জাগো নিউজকে বলেন, ‘আওয়ামী লীগ বাংলাদেশের প্রাচীনতম ও বৃহত্তম দল। প্রতিষ্ঠাকালীন যে আদর্শ ছিল, বঙ্গবন্ধুর যে আদর্শ ছিল, তার থেকে আওয়ামী লীগ অনেক দূরে সরে গেছে। সেটা হয়তো অনেক সময় পরিবর্তনের খাতিরে। কিন্তু উইনস্টন চার্চিলের একটি কথা আছে- ‘পরিবর্তনে সমস্যা নেই, যদি তা সঠিক লক্ষ্য অনুসারে হয়।’

‘যে পরিবর্তন আওয়ামী লীগ এনেছে, সেগুলো সঠিক লক্ষ্য অনুসারে নয়। বঙ্গবন্ধু ১০ জানুয়ারি ১৯৭২ বলেছিলেন, ‘বাংলাদেশ একটি আদর্শ রাষ্ট্র হবে, যা কোনো ধর্মভিত্তিক হবে না।’ তিনি ’৭২ এর সংবিধানেও তাই করেছিলেন। অমর্ত্য সেনও ওয়াশিংটনে বলেন, ‘বঙ্গবন্ধুর কাছ থেকে ধর্মনিরপেক্ষতা নীতি শিখতে হতো বিশ্বের অনেক নেতাকে।’ আওয়ামী লীগ ২০১১ সালে ১৫তম সংশোধনীতে রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম করলো। এই ধারাটি বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে বা বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের আদর্শের সঙ্গে সম্পূর্ণ সাংঘর্ষিক। অবৈধ সামরিক স্বৈরশাসক হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদ এটা করেছিলেন। সেটাই আওয়ামী লীগ সংরক্ষণ করলো।’

আওয়ামী লীগের চার মূলনীতি নিয়ে তিনি বলেন, ‘চারটি মূলনীতি এখনো সংবিধানে আছে। কিন্তু সমাজতন্ত্রের নামে বাংলাদেশে চলছে নগ্ন পুঁজিবাদ। আর ধর্মনিরপেক্ষতার নামে ধর্মনির্ভরতা, সবকিছুই সংবিধানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক, বঙ্গবন্ধুর আদর্শের সঙ্গে সাংঘর্ষিক। বঙ্গবন্ধু যথার্থ গণতন্ত্র ও জনগণের অংশীদারত্ব প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছিলেন বাকশালের মাধ্যমে। তা তো এখন দেখছি না।’

ইতিহাসের এই অধ্যাপক বলেন, ‘এখন দেখি, শতকরা ৮০ শতাংশ গণবৈষম্য। এতে প্রবৃদ্ধিতে আমরা আওয়ামী লীগের কাছে ঋণী। কিন্তু উন্নয়ন হচ্ছে না। তবে আওয়ামী লীগের সভানেত্রী শেখ হাসিনা ১৯৮১ সালে না ফিরলে আওয়ামী লীগ খণ্ডিত হয়ে যেত। আওয়ামী লীগ যে এক আছে, এতকিছুর পরেও এটি যথেষ্ট। তবে আওয়ামী লীগের রাজনীতি ধসে গেছে এজন্য যে ব্যবসায়ীদের এখন মনোনয়ন দেওয়া হচ্ছে।’

আরও পড়ুন

‘ব্যবসায়ীরা রাজনীতিতে এসেও ব্যবসা ছাড়া কিছু বোঝেন না। উপরন্তু বঙ্গবন্ধু যা করেননি, তিনি ৫৭ তে মন্ত্রী পদ থেকে পদত্যাগ করে দল গোছানোর কাজে এগিয়ে এসেছিলেন। ১৯৭৪ এ তিনি (বঙ্গবন্ধু) প্রধানমন্ত্রী থাকলেন, কিন্তু দলের সভাপতি করলেন কামরুজ্জামানকে। শেখ হাসিনা এত বছর হয়ে গেলো ক্ষমতায়, এখনো দল এবং সরকার একাকার থাকলো, যা অগণতান্ত্রিক।’ যোগ করেন অধ্যাপক সৈয়দ আনোয়ার হোসেন।

তিনি আরও বলেন, ‘সবকিছু মিলিয়ে আওয়ামী লীগের কাছে আমাদের যে প্রত্যাশা ছিল- সে প্রত্যাশা ও প্রাপ্তির সমীকরণ হয়নি। তবে আওয়ামী লীগ বিকল্পহীন বাংলাদেশে। অন্য দুটি দলের সঠিক জনসমর্থন থাকলেও বৈধ দল নয়। আওয়ামী লীগ বৈধ দল। আওয়ামী লীগের প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীতে শুভেচ্ছা রইলো। আওয়ামী লীগ ভালো কাজ করুক, দেশকে বাঁচাক।’

এই দলটি কোনো মৌলবাদী রাজনৈতিক দল নয়, আদর্শভিত্তিক উদার গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক দল। আওয়ামী লীগ বাংলাদেশের জনগণের আপন রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান। ৭৫ বছর ধরে বাঙালির সব মহৎ অর্জনে আওয়ামী লীগ মুখ্য ভূমিকা পালন করে আসছে।- আবু সাঈদ আল মাহমুদ স্বপন

আওয়ামী লীগের সাবেক সাংগঠনিক সম্পাদক ও নাগরিক ঐক্যের সভাপতি মাহমুদুর রহমান মান্না জাগো নিউজকে বলেন, ‘চারটি মূলনীতির কোনো নীতিতেই আওয়ামী লীগ এখন আর নেই। আওয়ামী লীগ মূলত একটা নষ্ট ও নীতিভ্রষ্ট দল। আওয়ামী লীগ পলিসির বাইরে থাকা দল। আওয়ামী লীগ রীতিমতো জনগণের ওপর নির্যাতনকারী ও জবরদখলকারী দলে পরিণত হয়েছে।’

তিনি বলেন, ‘চার মূলনীতির মধ্যে সমাজতন্ত্র তো আওয়ামী লীগ আগেই ছেড়েছে। এটা নিয়ে আমার কোনো অভিযোগ নেই। কারণ আমি নিজেও সমাজতন্ত্রকে এখন ঠিক মনে করি না। কিন্তু তার বদলে আওয়ামী লীগের ঘোষণাপত্র ঠিক করা হয়েছে, আমিও সেই কমিটির সদস্য ছিলাম। খোলা বাজার, কল্যাণ অর্থনীতি বা কল্যাণ রাষ্ট্রের দিকে আসার পরিকল্পনা করা হলো। আওয়ামী লীগ এখন সেই জায়গাতেও নেই।’

‘গণতন্ত্রের কথা বেশি বলার দরকার নেই, গত তিন মেয়াদে নির্বাচনকে নির্বাসনে পাঠিয়েছে তারা (আওয়ামী লীগ)। কোনো কিছুরই ধার ধারে না। বাকি থাকলো জাতীয়তাবাদ, সেটাও বিরাট মসিবতে পড়েছে। কারণ বাংলাদেশের এখন ফরেন পলিসি ভারতীয় হয়ে গেছে। খোদ প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, ভারতকে আমি যা দিয়েছি, আর কেউ দেয়নি। পেয়েছেন কী, তার কোনো জবাব নেই। সম্প্রতি ভারত সফরে দুই প্রধানমন্ত্রী মিলে যে কথা বলেছেন, সেখানে বাংলাদেশের স্বার্থের কথা আছে বলে আমার মনে হয়নি। তাছাড়া বর্ডারে হত্যা, ব্যবসায় অসমতা, আমাদের নতজানু পররাষ্ট্রনীতি আমরা বহু দেখেছি।’

তবে ভিন্নমত জানিয়ে দলটির সাংগঠনিক সম্পাদক ও জাতীয় সংসদের হুইপ আবু সাঈদ আল মাহমুদ স্বপন জাগো নিউজকে বলেন, ‘আওয়ামী লীগ তার মূলনীতি ও স্বকীয়তার ওপর ৭৫ বছর ধরে দাঁড়িয়ে আছে। এই দলটি কোনো মৌলবাদী রাজনৈতিক দল নয়, আদর্শভিত্তিক উদার গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক দল। আওয়ামী লীগ বাংলাদেশের জনগণের আপন রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান। ৭৫ বছর ধরে বাঙালির সব মহৎ অর্জনে আওয়ামী লীগ মুখ্য ভূমিকা পালন করে আসছে।’

তিনি বলেন, ‘আওয়ামী লীগ সব সময়ই বিশ্ব বাস্তবতা এবং বাংলাদেশের জনগণের রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক ও আর্থ-সামাজিক চাহিদা, আকাঙ্ক্ষা, মানসিকতা ধারণ করে বৃহত্তর জনকল্যাণের লক্ষ্যে সময়ের চাহিদা মোতাবেক নীতির উৎকর্ষ সাধন করে চলেছে। গণতন্ত্র, জাতীয়তাবাদ ও ধর্মনিরপেক্ষতা মূলনীতি থেকে আওয়ামী সরে যায়নি।’

স্বপন বলেন, ‘আওয়ামী লীগ সমাজতান্ত্রিক চেতনা মার্কসবাদ- লেনিনবাদ বা মাওবাদের সমাজতান্ত্রিক চিন্তা-চেতনা ধারণ করে না। বাংলাদেশের সংবিধানে বর্ণিত সমাজতান্ত্রিক নীতিকে ধারণ করে। সময় ও জনগণের আকাঙ্ক্ষা ধারণ করতে না পারলে কোনো রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানের বিকাশ হয় না, এমনকি জনসমর্থন হারিয়ে ফেলে। চলমান বিশ্ব বাস্তবতা ও বাংলাদেশের জনগণের আকাঙ্ক্ষা ধারণ করার আওয়ামী লীগের অন্তর্নিহিত শক্তি ৭৫ বছর ধরে বাংলাদেশের মূল রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান ধারাবাহিকভাবে বলিয়ান রেখেছে। বাংলাদেশ স্বপ্ন দেখে, আওয়ামী লীগ সেই স্বপ্ন সম্ভব করে।’

১৯৪৯ সালের ২৩ জুন পুরান ঢাকার ঐতিহ্যবাহী রোজ গার্ডেনে পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগ প্রতিষ্ঠার মধ্য দিয়ে এ রাজনৈতিক দলটি প্রতিষ্ঠিত হয়। প্রতিষ্ঠার সময় জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কারাগারে আটক ছিলেন। তাকে যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক করা হয়। কেন্দ্রীয়ভাবে নিখিল পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগ করা হলেও পরবর্তীসময়ে অসাম্প্রদায়িক রাজনৈতিক আদর্শের অধিকতর প্রতিফলন ঘটানোর জন্য এর নাম ‘আওয়ামী লীগ’ করা হয়।

১৯৫৪ সালের নির্বাচনে বিজয়ের পর ১৯৫৫ সালে অনুষ্ঠিত আওয়ামী মুসলিম লীগের কাউন্সিলে দলের নাম থেকে মুসলিম শব্দটি বাদ দেওয়া হয়। আর ‘পূর্ব পাকিস্তান’ শব্দ দুটি বাদ পড়ে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় থেকে। বাংলাদেশে স্বাধীনতা ঘোষণা করার পর থেকে প্রবাসী সরকারের সব কাগজপত্রে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ নাম ব্যবহার শুরু হয়।

১৯৭০ সাল থেকে এই দলের নির্বাচনী প্রতীক নৌকা। পরবর্তীসময়ে দেশের অন্যতম প্রাচীন সংগঠনটি বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধসহ প্রতিটি গণতান্ত্রিক, রাজনৈতিক ও সামাজিক আন্দোলনে নেতৃত্ব দিয়ে এ দেশের গণমানুষের সংগঠনে পরিণত হয়।

এসইউজে/এএসএ/জিকেএস

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।