পুনর্গঠন প্রক্রিয়ায় ধীরগতি, সংকটে বিএনপি
দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পর পুনর্গঠন কার্যক্রম সম্পন্ন করতে না পারায় বিএনপিতে শৃঙ্খলা বিপর্যয় দেখা দিয়েছে। দলটির নেতাকর্মীদের মধ্যে বেড়েছে সন্দেহ, অবিশ্বাস আর বিভাজন। সম্প্রতি হাতেগোনা কয়েকটি কর্মসূচি নিয়ে মাঠে নেমেছে বিএনপি। কিন্তু তাতে নেতাকর্মীদের উপস্থিতি ছিল হতাশাজনক।
তবে বিএনপির দায়িত্বশীলরা বলছেন, দলের পুনর্গঠন চলমান প্রক্রিয়া। এতে বারবার বাধা দিচ্ছে সরকার। তাই সংগঠনকে শক্তিশালী করতে সময় নিয়ে বুঝে শুনেই পুনর্গঠন করা উচিত।
মেয়াদ শেষ ৫ বছর আগেই
বিএনপির গঠনতন্ত্র অনুযায়ী তিন বছর পরপর সম্মেলন (কাউন্সিল) করে জাতীয় নির্বাহী কমিটি নির্বাচন করার কথা। সর্বশেষ নির্বাহী কমিটির কাউন্সিল অনুষ্ঠিত হয় ২০১৬ সালের ১৯ মার্চ। সেই কমিটির মেয়াদ শেষ হয়েছে পাঁচ বছর আগেই। দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পর গত ২১ ফেব্রুয়ারি ঝালকাঠি জেলা বিএনপির সদস্য মো. রফিকুল ইসলাম জামালকে জাতীয় নির্বাহী কমিটির ধর্মবিষয়ক সম্পাদক পদে নিযুক্ত করা হয়। এরপর ১৯ মার্চ জাতীয় নির্বাহী কমিটির আন্তর্জাতিক বিষয়ক সম্পাদক অ্যাডভোকেট মাসুদ আহমেদ তালুকদারকে বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা কাউন্সিলের সদস্য, কমিটির গণশিক্ষা বিষয়ক সম্পাদক অধ্যক্ষ সেলিম ভূঁইয়াকে সাংগঠনিক সম্পাদক (কুমিল্লা বিভাগ) ও সহ-আন্তর্জাতিক বিষয়ক সম্পাদক মোহাম্মদ রাশেদুল হককে দলের আন্তর্জাতিক সম্পাদক পদে মনোনীত করা হয়। এরপর থেকে এখন পর্যন্ত কেন্দ্রীয় কমিটিতে আর কোনো নেতার পদোন্নতি বা পদাবনতি হয়নি।
পুনর্গঠন হলে গতিশীল হয় সংগঠন
বিএনপির নির্বাহী কমিটির সদস্য অ্যাডভোকেট রফিক সিকদার জাগো নিউজকে বলেন, ‘যথাসময়ে পুনর্গঠন হলে যেমন সংগঠন গতিশীল হয় তেমনি সেটা না হলে অস্বস্তিকর পরিবেশ তৈরি হয়, সংগঠন দুর্বল হয়। পরিস্থিতির কারণে নিয়মিত কাউন্সিল হচ্ছে না। দলে যেটা হচ্ছে এটা স্বাভাবিকও বলা যাবে না, ধীরগতিও বলা যাবে না। এটা চলমান। তবে এতে কাউন্সিলের যে প্রতিপাদ্য বিষয় সেটা পূরণ করবে না। আমরা চাই দলের নেতৃত্ব বিকশিত হবে।’
রফিক সিকদার বলেন, ‘বাংলাদেশে সুস্থ ধারার রাজনীতি চলছে না বিধায় শুধু বিএনপি নয় সব রাজনৈতিক দল এক ধরনের অসুস্থ প্রতিযোগিতায় মেতে উঠেছে। গণতন্ত্র চর্চা করতে পারছে না।’
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বিএনপির কেন্দ্রীয় কমিটির একজন সহ-সম্পাদক বলেন, দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পর নেতাকর্মীদের পক্ষ থেকে নির্বাহী কমিটির সভার তাগিদ এবং দল পুনর্গঠনের দাবি ছিল হাইকমান্ডের প্রতি। কিন্তু নেতাকর্মীদের সেই দাবির কোনো প্রতিফলন নেই। যে কারণে বিএনপি রাজপথের কর্মসূচিতে ফিরতে পারছে না। দল এবং অঙ্গ সহযোগী সংগঠনগুলোর যারা ব্যর্থ হয়েছেন, তারা এখনও বহাল রয়েছেন। এ কারণে ত্যাগী নেতাকর্মীদের মধ্যে অবমূল্যায়নের শঙ্কা রয়েছে।
আরও পড়ুন
প্রবল সন্দেহ-অবিশ্বাস
বিএনপি দলীয় সূত্র জানায়, দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পর দলের নেতাকর্মীদের মধ্যে পারস্পরিক সন্দেহ ও অবিশ্বাস প্রবল আকার ধারণ করেছে। একটা অংশ মনে করছে, দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান স্থায়ী কমিটির নেতাদের গুরুত্ব না দিয়ে তুলনামূলক জুনিয়র কয়েকজন নেতার মতামতের ভিত্তিতে গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নিচ্ছেন।
বিএনপির আরেকটি অংশ মনে করছে, দলের সিনিয়র নেতাদের সঙ্গে সরকার ও প্রতিবেশী দেশের সুসম্পর্ক রয়েছে, যে কারণে ভারতীয় পণ্য বর্জন আন্দোলনে তারা সরব হতে পারছেন না। মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর মহাসচিব হিসেবে থাকলেও তিনি কার্যকর ভূমিকা পালন করতে পারছেন না, ভারতে থেকে সালাউদ্দিন আহমেদ দলের ছায়া মহাসচিবের দায়িত্ব পালন করছেন।
এছাড়া বিএনপির মিডিয়া সেল ও দপ্তর পাশ কাটিয়ে ‘জার্নালিস্ট’ হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপ তৈরি করেছেন দলের স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. আব্দুল মঈন খান। দলের মহাসচিব হওয়ার দৌড়ে মঈন খানের এই আয়োজন বলে প্রচার রয়েছে।
এদিকে বিএনপির গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্তের ক্ষেত্রে তারেক রহমান যে সব জুনিয়র নেতাকে গুরুত্ব দেন বলে প্রচার রয়েছে, তারা আন্দোলনে না থেকে আত্মগোপনে ছিলেন কেন সে নিয়েও দলের একটি অংশের নেতাকর্মীদের মধ্যে বেশ সন্দেহ রয়েছে।
আন্দোলনের অর্থ আত্মসাতের অভিযোগ
দলের সাংগঠনিক সম্পাদকদের বিরুদ্ধে আন্দোলনের অর্থ আত্মসাতের প্রতিবেদন গণমাধ্যমে প্রকাশিত হলেও তার আনুষ্ঠানিক প্রতিবাদ দিতে পারেনি বিএনপি।
আন্দোলনের অর্থ আত্মসাৎ প্রসঙ্গে বিএনপির খুলনা বিভাগীয় ভারপ্রাপ্ত সাংগঠনিক সম্পাদক অনিন্দ্য ইসলাম অমিত বলেন, ‘এটা একটা অপপ্রচার। বাস্তবতা হলো সরকারের ইন্ধনে এই নিউজগুলো করানো হচ্ছে, যাতে নেতাকর্মীদের মধ্যে বিশ্বাস-অবিশ্বাসের দ্বন্দ্ব তৈরি করা যায়। আওয়ামী লীগ গত ১৭ বছর হাজারো চেষ্টা করেও বিএনপিকে ভাঙতে পারেনি। বিএনপি থেকে কোনো লোক তার দলে ফেরাতে পারেনি। এতকিছুর পরেও যখন তারা হতাশ হয়ে যায়, তখন তারা এগুলো করে। শুধু সাংগঠনিক সম্পাদক নন, দেখবেন দলের ঊর্ধ্বতন পর্যায়ে এই কথাগুলো ওঠে। মাঝে মধ্যে শুনবেন সিনিয়র-জুনিয়রদের মধ্যে মতপার্থক্য। এগুলো আসলে বিভিন্ন এজেন্সি করে। সরকারি গোয়েন্দা সংস্থাগুলো এ নিউজগুলো তৈরি করে। এখন তো গণমাধ্যমের স্বাধীনতা নেই। ফরমায়েশি রিপোর্ট প্রকাশ হয়। গণমাধ্যমও যে স্বেচ্ছায় করে তা নয়, তারাও বাধ্য হয়ে এই রিপোর্টগুলো প্রকাশ করে।’
বিষয়টি নিয়ে বিএনপির ময়মনসিংহ বিভাগীয় সাংগঠনিক সম্পাদক সৈয়দ এমরান সালেহ প্রিন্স বলেন, ‘এটা নিয়ে আমার কোনো মন্তব্য নেই। দলের পক্ষ থেকে আন্দোলন-সংগ্রামের জন্য অর্থ দেওয়া হয় কি না বা দেওয়া হয়েছে কি না জানা নেই। এগুলো আমরা দলের অভ্যন্তরে আলোচনা করতে চাই। আন্দোলনের পুরো সময়জুড়ে আমি জেলে ছিলাম। আমার জানা নেই এই অর্থ দেওয়া হয়েছে কি না।’
আরও পড়ুন
ভারতীয় পণ্য বর্জন
বিএনপির নেতাকর্মীরা জানান, ভারতীয় পণ্য বর্জন ইস্যুতে দলের সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী কাশ্মীরের চাদর ছুড়ে ফেলেন এবং তার অনুসারীরা সেটা পুড়িয়ে দেন। অথচ কাশ্মীরের মানুষ ভারতের কেন্দ্রীয় সরকারের নির্যাতনের শিকার। রিজভী ভারতের কেন্দ্রীয় সরকারের নির্যাতনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করতে গিয়ে কাশ্মীরের নির্যাতিত মানুষের বিরুদ্ধে অবস্থান নিলেন নাকি ব্যক্তিগত হতাশা থেকে করছেন সেটা নিয়েও প্রশ্ন রয়েছে।
শ্রাবণের ওপর হামলা
সম্প্রতি ছাত্রদলের সাবেক সভাপতি বিএনপির জাতীয় নির্বাহী কমিটির সদস্য কাজী রওনুকুল ইসলাম শ্রাবণ রাজধানীতে তার কয়েকজন অনুগামীসহ হামলার শিকার হন। দলের পক্ষ থেকে ছাত্রলীগ নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে এই হামলার অভিযোগ করা হয়। তবে দলের অভ্যন্তরে প্রচার রয়েছে, স্বেচ্ছাসেবক দলের সাবেক সহ-মহিলা বিষয়ক সম্পাদক অস্ট্রেলিয়া প্রবাসী মুন্নি চৌধুরী বিএনপির ছাত্র বিষয়ক সম্পাদক রকিবুল ইসলাম বকুলের বিরুদ্ধে নৈতিক স্খলনসহ যেসব অভিযোগ এনেছেন তাতে শ্রাবণের হাত রয়েছে। এজন্য বকুল ছাত্রলীগের নেতাকর্মীদের ব্যবহার করে শ্রাবণকে শিক্ষা দিয়েছেন। তবে জাগো নিউজের কাছে মুন্নি চৌধুরীর সোশ্যাল মিডিয়ার পোস্টের সঙ্গে নিজের যোগ অস্বীকার করেন শ্রাবণ এবং বকুলের পক্ষ থেকে তার ওপর হামলা হয়েছে সেটাও মানতে নারাজ তিনি।
হ-য-ব-র-ল পরিস্থিতি
বিএনপি সূত্র জানায়, যথাযথ পুনর্গঠন না হওয়ায় বিএনপিতে হ-য-ব-র-ল পরিস্থিতি চলছে। গত ১ মে আন্তর্জাতিক শ্রমিক দিবসে নয়াপল্টনে সমাবেশ করে জাতীয়তাবাদী শ্রমিক দল। ১১ মে সমাবেশ করে জাতীয়তাবাদী যুবদল। সেখানে নেতাকর্মীদের উপস্থিতি ছিল হতাশাজনক। সর্বশেষ গত ৩০ মে বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা জিয়াউর রহমানের ৪৩তম মৃত্যুবার্ষিকী উপলক্ষে আলোচনা সভা ছিল রাজধানীর ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউশনে। সেখানে ছিল না কোনো ব্যানার, হলরুমে দেখা যায়নি জিয়াউর রহমানের ছবি। বিএনপির মিডিয়া সেলের আহ্বায়ক জহির উদ্দিন স্বপন কারা মুক্তির তিন মাস পরেও দায়িত্বে ফিরতে পারেননি।
নেতারা যা বলছেন
বিএনপির পুনর্গঠন প্রসঙ্গে সাংগঠনিক সম্পাদক সৈয়দ এমরান সালেহ প্রিন্স বলেন, ‘পুনর্গঠন চলমান প্রক্রিয়া। কাউন্সিলের পরিবেশ থাকলে আমরা এক সপ্তাহের মধ্যে কাউন্সিল করতে পারি কিন্তু সেই পরিবেশ নেই। যে কারণে মৃত্যুজনিত এবং বহিষ্কারজনিত বা অন্য কারণে যে সব পদ শূন্য, সেই শূন্যপদ পূরণের জন্য চেয়ারপারসনকে গঠনতন্ত্র মোতাবেক যে ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে সে অনুযায়ী শূন্যপদ পূরণ করা হচ্ছে।’
ভারপ্রাপ্ত সাংগঠনিক সম্পাদক অনিন্দ্য ইসলাম অমিত বলেন, ‘সময়ের সাথে পরিস্থিতি বিবেচনায় যদি নির্ধারিত সময়ে পুনর্গঠন প্রক্রিয়া সম্পন্ন করা যায় তাহলে সাংগঠনিক কাঠামোটা বরাবরই মজবুত থাকে। বিভিন্ন কারণে সাংগঠনিক কাঠামো নাজুক হয়। একটা সাইক্লোনের পর কী হয়? উপকূলীয় অঞ্চলের যে ঘরগুলো ভেঙে গেছে, সেটা গেছে। আর যে ঘরগুলো ঠিক আছে, সেটাও নাজুক হয়ে গেছে। তো সেটা রিপেয়ার করতে হয়। আমরা যেভাবেই বলি না কেন গত বছরের ২৮ অক্টোবর থেকে শুরু করে ৭ জানুয়ারি পর্যন্ত বিএনপি নেতাকর্মীদের ওপর যে জুলুম-নির্যাতন ও স্টিমরোলার চলছে, স্বাভাবিকভাবে সংগঠন কিছু জায়গায় হলেও ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এই বাস্তবতা অস্বীকার করতে পারবো না। সেক্ষেত্রে একটা অনুকূল পরিবেশে দ্রুততম সময়ের মধ্যে দুর্বলতা যেগুলো চিহ্নিত হয়েছে, সেগুলো ঠিক করে সংগঠন মজবুত করা যায়।’
যুগ্ম মহাসচিব হাবিব উন-নবী খান সোহেল বলেন, দল সংগঠিত করার প্রক্রিয়া তো চলতে থাকে। কমিটিগুলোর মেয়াদ শেষ হলে তা পরিপূর্ণ হয়। এমন কোনো পরিবেশ তৈরি হয়নি যে সবকিছু হুড়োহুড়ি করে করতে হবে। পার্টি চিন্তাভাবনা করে। এটা নিয়ে ব্যস্ত হওয়ার কিছু নেই। দল যখন যেটা ভালো মনে করবে সেটা করবে। বরং তাড়াহুড়া করতে গেলে ভুল হতে পারে।
ভাইস চেয়ারম্যান শামসুজ্জামান দুদু বলেন, দেশের সামগ্রিক পরিস্থিতি বিবেচনা করে কাউন্সিল করা সম্ভব হচ্ছে না। ক্ষমতাসীনদের নির্যাতনে দলের কর্মকাণ্ড পরিচালনা করাই কষ্টকর। এখনো অনেক নেতাকর্মী কারাগারে। প্রতিনিয়ত গ্রেফতার করা হচ্ছে। দলের চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া বন্দি। ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান দেশের বাইরে। এরপরও সাংগঠনিক তৎপরতা চলছে। তবে নির্দিষ্ট করে বলা যাচ্ছে না কাউন্সিল কবে হবে।
বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য বেগম সেলিমা রহমান জাগো নিউজকে বলেন, সাংগঠনিক পুনর্গঠন একটি চলমান প্রক্রিয়া। এরই মধ্যে দলের কেন্দ্রীয় নির্বাহী কমিটির কিছু শূন্যপদ পূরণ করা হয়েছে। বাকিগুলো যথাসময়ে পূরণ করা হবে।
সেলিমা রহমান বলেন, ‘আমরা এখন আন্দোলনের মধ্যে আছি। তারপরও কাউন্সিল করার চেষ্টা ও ইচ্ছা আমাদের আছে। সেটাও আমরা সময় মতো করব।’
কেএইচ/এমএমএআর/এএসএম