মাঠের কর্মসূচিতে সরব থাকতে চায় বিএনপির মিত্ররা
বিগত কয়েক বছরের মধ্যে ২০২৩ সালে রাজপথে বেশ সক্রিয় ছিল বিএনপি। সরকারের পদত্যাগ ও নির্বাচনকালীন নিরপেক্ষ সরকারের দাবিতে সারাবছরই সমাবেশ, র্যালি, গণসংযোগের মতো কর্মসূচি পালন করে দলটি। তবে ২৮ অক্টোবর সমাবেশ ঘিরে সংঘর্ষের পর কোনো আন্দোলনই সে অর্থে বেগবান হয়নি। নির্বাচন বর্জনের দাবিতে লিফলেট বিতরণের মতো ‘নমনীয়’ কর্মসূচিতেই সীমাবদ্ধ ছিল বিএনপি ও মিত্রদের আন্দোলন।
৭ জানুয়ারির নির্বাচন পরবর্তী সময়ে আন্দোলনের নির্দিষ্ট কোনো রূপরেখা জনগণের সামনে তুলে ধরতে পারেননি দলটির নেতারা। বিএনপির কোনো কোনো নেতা মধ্যবর্তী নির্বাচনের দাবি জানালেও এ দাবি আদায়ে কোনো কর্মসূচি এখনো দৃশ্যমান নয়। এর সঙ্গে আবার যুক্ত হয়েছে ভারতীয় পণ্য বর্জন ইস্যু। দলগতভাবে ভারতীয় পণ্য বর্জনের ঘোষণা না দিলেও বিএনপির অনেক নেতা এর পক্ষে বক্তব্য-বিবৃতি দিচ্ছেন। ফলে ভারতীয় পণ্য বর্জনের ইস্যুতে বিএনপির অবস্থান মিত্রদের কাছে স্পষ্ট নয়।
পাশাপাশি দীর্ঘদিনের মিত্র জামায়াতে ইসলামীর সঙ্গে বেশ কয়েকবছর ধরে দূরত্ব তৈরি হয়েছে। দূরত্ব কমিয়ে আন্দোলনে জামায়াতকে পাশে টানার আবদারও আছে কোনো কোনো মিত্র দলের। নির্বাচন বর্জনকারী সবাইকে নিয়েই জাতীয় ঐক্য গড়ে ঈদুল আজহার পর মাঠের কর্মসূচিতে ফিরতে বিএনপির কাছে প্রস্তাব রেখেছেন মিত্র দলগুলোর শীর্ষ নেতারা।
ঐক্যবদ্ধ আন্দোলন হওয়া দরকার। বিচ্ছিন্ন আন্দোলন করার কারণে জোরালো লড়াই করতে পারছি না। যে কারণে সব দলকে নিয়ে একটি প্ল্যাটফর্মে আসার কথা বলেছি।
বিএনপির মিত্র দলগুলোর নেতারা বলছেন, গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের জন্য জাতীয় ঐক্য গড়ে রাজপথের কর্মসূচির মাধ্যমে নতুন নির্বাচনের দাবি আদায়ের বিকল্প নেই। তবে বিএনপির দায়িত্বশীল নেতারা বলছেন, মিত্রদের প্রস্তাবনা নিয়ে দলের সর্বোচ্চ ফোরামে আলোচনা হবে। এরপর ফের শরিকদের সঙ্গে বৈঠক করে আন্দোলন কর্মসূচির সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।
কথা হয় বাংলাদেশ লিবারেল ডেমোক্রেটিক পার্টির মহাসচিব শাহাদাত হোসেন সেলিমের সঙ্গে। জাগো নিউজকে তিনি বলেন, ‘সবাইকে নিয়ে মাঠের কর্মসূচিতে নামার জন্য বিএনপির কাছে আমরা প্রস্তাব রেখেছি, যাতে মধ্যবর্তী নির্বাচনের দাবি আদায় করা যায়।’
সূত্র জানায়, দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পর মিত্র দলগুলোর সঙ্গে কিছুটা দূরত্ব তৈরি হয় বিএনপির। এ দূরত্ব ঘোচাতে গত ১২ মে থেকে মিত্র দলগুলোর সঙ্গে ধারাবাহিক বৈঠক করছেন বিএনপি নেতারা। গণতন্ত্র মঞ্চ, জাতীয়তাবাদী সমমনা জোট, লিবারেল ডেমোক্রেটিক পার্টি (এলডিপি), গণফোরাম, পিপলস পার্টি, গণঅধিকার পরিষদ (নুর), গণঅধিকার পরিষদ (রেজা), বাংলাদেশ লেবার পার্টি (ইরান), এনডিএম এবং বাংলাদেশ সাধারণ ছাত্র অধিকার সংরক্ষণ পরিষদের নেতাদের সঙ্গে বৈঠক করেছেন তারা। এসব বৈঠকে ঈদুল আজহার পর আন্দোলনের বিষয়ে আলোচনা হয়েছে।
ভারত-জামায়াত ইস্যুতে মিত্রদের চাপ
মিত্রদের সঙ্গে ধারাবাহিক বৈঠকে ভারতীয় পণ্য বর্জন এবং জামায়াতে ইসলামীকে নিয়ে যুগপৎ আন্দোলন ইস্যুতে পক্ষে-বিপক্ষে মতামত উঠে এসেছে। এছাড়া কর্মসূচি এবং লিয়াজোঁ কমিটি শক্তিশালী করার প্রস্তাব উঠেছে।
- আরও পড়ুন
দুকূল হারানো নেতাদের কি দলে ফেরাবে বিএনপি?
কী বার্তা দিচ্ছে লু’র ঢাকা সফর?
অস্তিত্ব সংকটে বাম ছাত্ররাজনীতি
শাহাদাত হোসেন সেলিম বলেন, ‘ভারতীয় পণ্য বর্জন ইস্যুতে আমরা বিএনপির সাপোর্ট চাই না, আমরা জনগণের সাপোর্ট চেয়েছি। ভারতীয় পণ্য বর্জন আন্দোলনে বিএনপির সঙ্গে আমাদের কোনো বোঝাপড়া নেই।’
তিনি বলেন, ‘জামায়াতে ইসলামী, ইসলামী আন্দোলনসহ যেসব দল আন্দোলনে ছিল সবাইকে নিয়ে ঐক্যবদ্ধ হয়ে রাজপথের কর্মসূচির কথা বলেছি।’
ন্যাশনাল পিপলস পার্টির (এনপিপি) চেয়ারম্যান ফরিদুজ্জামান ফরহাদ বলেন, ‘আমরা ভারতীয় পণ্য বর্জনের পক্ষে নই। তবে ভারতীয় আগ্রাসনের বিপক্ষে। সীমান্ত হত্যাকাণ্ড, অভিন্ন নদীর ন্যায্য পানির হিস্যা ইস্যুতে বিএনপির অবস্থান পরিষ্কার করতে হবে।’
ধারাবাহিকভাবে সরকারবিরোধী আন্দোলন করতে হবে। নিত্যপ্রয়োজনীয় ইস্যুতে রাজনৈতিক আন্দোলনের পাশাপাশি সামাজিক আন্দোলন গড়ে তোলা প্রয়োজন। কারণ যুক্তরাষ্ট্রের কাছে জনগণের যে আশা ছিল সেটা পূরণ হয়নি। স্বীকার করি বা না করি আমরা বিদেশনির্ভর হয়ে গিয়েছিলাম।
বৈঠকে ডান-বাম সবাইকে নিয়ে ঐক্যবদ্ধ আন্দোলন গড়ে তোলার কথা বলা হয়েছে বলেও জানান ফরিদুজ্জামান ফরহাদ।
গণ অধিকার পরিষদের একাংশের সাধারণ সম্পাদক মুহাম্মদ রাশেদ খান বলেন, ‘ঐক্যবদ্ধ আন্দোলন হওয়া দরকার। বিচ্ছিন্ন আন্দোলন করার কারণে জোরালো লড়াই করতে পারছি না। যে কারণে সব দলকে নিয়ে একটি প্ল্যাটফর্মে আসার কথা বলেছি।’
ভারতীয় পণ্য বর্জন ইস্যুতে বিএনপির অবস্থান সম্পর্কে রাশেদ বলেন, ‘বিএনপি মনে করে জনগণের পক্ষ থেকে ভারতীয় পণ্য বর্জন আন্দোলন গড়ে উঠেছে। এর জনপ্রিয়তা আছে এবং জনগণের এ আন্দোলনের পেছনে যৌক্তিকতা রয়েছে। বিএনপির কোনো নিষেধাজ্ঞা নেই, নেতিবাচক মন্তব্যও নেই। এ নিয়ে পজিটিভ- নেগেটিভ কোনো মন্তব্য করেনি বিএনপি, নিরপেক্ষ ভূমিকা পালন করছে।’
মধ্যবর্তী নির্বাচন ইস্যুতে বিভক্তি
ফরিদুজ্জামান ফরহাদ বলেন, ‘মধ্যবর্তী নির্বাচনের দাবি আদায়ের আন্দোলনের কথা বলা হচ্ছে। জনগণকে সম্পৃক্ত করে জনগণের ইস্যু নিয়ে কর্মসূচির কথা বলেছি। বিদ্যুৎ বিল, পানির বিল বন্ধ করার কথা বলেছি। প্রাথমিকভাবে আলোচনা হয়েছে, আগামীতে কর্মসূচি ঠিক করা হবে।’
- আরও পড়ুন
পরিশ্রমী নেতৃত্ব নেই শ্রমিক দলে
বিএনপি-জামায়াত এক পথে, চোখ ভবিষ্যতের আন্দোলনে
পদোন্নতি নিয়ে বিএনপিতে তীব্র অসন্তোষ
এ বিষয়ে রাশেদ খান বলেন, ‘মধ্যবর্তী নির্বাচনের কোনো লক্ষণ দেখছি না। নতুন নির্বাচন হতে পারে। অনেকে আলোচনায় আনছেন, তবে এটা একটা ফাঁদ হতে পারে। কারণ মধ্যবর্তী নির্বাচনের কথা বলে একটা সম্ভাবনা তৈরি করে আবার যখন এটা বাস্তবায়ন হবে না, তখন জনগণ হতাশ হবে। সরকারের পতন ঘটিয়ে আমাদের নতুন নির্বাচনের জন্য কাজ করতে হবে। সেক্ষেত্রে মাঠ পর্যায়ে আন্দোলনের বিকল্প নেই।’
মিত্র দলগুলোর সঙ্গে যুগপৎ আন্দোলনের কর্মকৌশল নিয়ে আলোচনা হচ্ছে। জোট শরিকরা নানান পরামর্শ ও প্রস্তাব দিয়েছেন। এসব প্রস্তাব ও মতামত নিয়ে বিএনপির নীতিনির্ধারণী ফোরামে আলোচনার পর শরিকদের সঙ্গে আরও বৈঠক হবে।
তিনি আরও বলেন, ‘ধারাবাহিকভাবে সরকারবিরোধী আন্দোলন করতে হবে। নতুন আন্দোলন পরিকল্পনার প্রস্তাবনা রেখেছি। এক দফার আন্দোলন নিয়ে আমরা দ্বিধান্বিত। নিত্যপ্রয়োজনীয় ইস্যুতে রাজনৈতিক আন্দোলনের পাশাপাশি সামাজিক আন্দোলন গড়ে তোলা প্রয়োজন। কারণ যুক্তরাষ্ট্রের কাছে জনগণের যে আশা ছিল সেটা পূরণ হয়নি। স্বীকার করি বা না করি আমরা বিদেশনির্ভর হয়ে গিয়েছিলাম।’
বিএনপির সঙ্গে বৈঠকের শাহাদাত হোসেন সেলিম বলেন, ‘দেশের অর্থনীতির বেহাল দশা, বিদ্যুতের নাজুক পরিস্থিতি। গ্যাস সংকট, দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতিসহ সার্বিক পরিস্থিতি বিবেচনা করে ইস্যুভিত্তিক কর্মসূচি নিয়ে মাঠে নামার কথা বলেছি আমরা।’
মিত্রদের সঙ্গে বৈঠক নিয়ে কী বলছে বিএনপি
বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য নজরুল ইসলাম খান বলেন, ‘জামায়াতকে যুগপৎ আন্দোলনে সম্পৃক্ত করার প্রস্তাব এসেছে। ভিন্নমতও আছে। এটি বিশদ আলোচনার বিষয়। এক বৈঠকেই এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়া সম্ভব নয়।’
তিনি বলেন, ‘সব দল ও জোটের আদর্শ আলাদা। তাই আগামী দিনে গণতন্ত্রবিরোধী সরকার হটাতে বৃহত্তর আন্দোলন গড়ে তোলার বিকল্প নেই।’
এসব বিষয়ে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, ‘মিত্র দলগুলোর সঙ্গে যুগপৎ আন্দোলনের কর্মকৌশল নিয়ে আলোচনা হচ্ছে। জোট শরিকরা নানান পরামর্শ ও প্রস্তাব দিয়েছেন। এসব প্রস্তাব ও মতামত নিয়ে বিএনপির নীতিনির্ধারণী ফোরামে আলোচনার পর শরিকদের সঙ্গে আরও বৈঠক হবে।’
কেএইচ/কেএসআর/জেআইএম