কী বার্তা দিচ্ছে লু’র ঢাকা সফর?

সালাহ উদ্দিন জসিম
সালাহ উদ্দিন জসিম সালাহ উদ্দিন জসিম , জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক
প্রকাশিত: ০৬:০৮ পিএম, ১৫ মে ২০২৪
ঢাকায় অবতরণের পর ডোনাল্ড লু, ঢাকায় নিযুক্ত মার্কিন রাষ্ট্রদূত পিটার হাস/সংগৃহীত

বিএনপি-আওয়ামী লীগকে কাছাকাছি এনে একটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচন করাতে চেয়েছিল যুক্তরাষ্ট্র। বিগত তিন নির্বাচনের আগেই দফায় দফায় চেষ্টা করে ব্যর্থ হন দেশটির কূটনীতিকরা। দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে নানান হুংকার-হুঁশিয়ারি দিলেও শেষমেশ নমনীয় দেখা যায় মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তরকে।

দেশটির দক্ষিণ ও মধ্য এশিয়াবিষয়ক সহকারী পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডোনাল্ড লু’র চতুর্থবারের মতো বাংলাদেশ সফরেও সেই ধারা অব্যাহত থাকার ইঙ্গিত মিলছে। পাশাপাশি কিছু অস্বস্তিকর বিষয় উল্লেখ করে দুর্নীতি, সরকারের স্বচ্ছতা, জবাবদিহিতা, বিনিয়োগ, যুক্তরাষ্ট্রে বাংলাদেশি শিক্ষার্থীদের পড়াশোনার বিষয়ে কথা বলেন তিনি।

সফরের প্রথম দিন দেশের সুশীল সমাজের সঙ্গে কথা বলে শ্রম ও মানবাধিকার এবং আর্থিক পরিস্থিতি নিয়ে আলোচনা করেন। রাতে প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টার আমন্ত্রণে নৈশভোজে যোগ দিয়ে ফিলিস্তিন, স্যাংশন্স, রোহিঙ্গাসহ নানা ইস্যুতে কথা বলেন।

বুধবার (১৫ মে) পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের বৈঠক শেষে সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলেন লু। সেখানে কিছু অস্বস্তির কথা বললেও অতীত ভুলে নতুন ইতিবাচক শুরুর কথা বলেন তিনি।

কী বার্তা দিচ্ছে লু’র ঢাকা সফর?

লু বলেন, দুই দেশের নাগরিকদের মধ্যে নতুন করে আস্থা গড়ে তুলতে আমার এ সফর। গত বছর বাংলাদেশ ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে অনেক উত্তেজনা ছিল। এখানে একটি অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের জন্য আমরা কঠোর পরিশ্রম করেছি। এখন আমরা নতুন একটি অধ্যায় প্রত্যাশা করছি।

‘আমাদের সম্পর্কের অস্বস্তিকর বিষয়গুলো নিয়ে কাজ করতেই আমি আজ মন্ত্রীর সঙ্গে আলোচনা করেছি। আমাদের অনেকগুলো অস্বস্তিকর বিষয় আছে। র্যাবের বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা, শ্রম আইন সংশোধন, মানবাধিকার ও ব্যবসায়িক পরিবেশ সংস্কার ইত্যাদি। অস্বস্তিকর বিষয়গুলো নিয়ে কাজ করতে আমরা ইতিবাচক বিষয়গুলো নিয়ে সহযোগিতা বাড়াতে চাই’- যোগ করেন লু।

ডোনাল্ড লু’র এ সফর নিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক ড. আমেনা মহসিন জাগো নিউজকে বলেন, ‘নির্বাচনের পরে যে এজেন্ডা নিয়ে এসেছেন, তার মধ্যে আছে ইন্দো-প্যাসিফিক ও জলবায়ু পরিবর্তনের মতো গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। পাশাপাশি অবশ্যই স্যাংশন্সের বিষয়ে আলাপ-আলোচনা করে আমরা কী করে এগোতে পারি, সেটিও আসবে। আমার মনে হয়, কূটনীতিতে সব সময় আলাপ-আলোচনা চালিয়ে যাওয়াই বেটার। সে জায়গা থেকে আমি বিষয়টি ইতিবাচকভাবেই দেখছি।’

আরও পড়ুন

নির্বাচনের আগের সফর আর এখকার মধ্যে তফাৎ দেখেন কি না জানতে চাইলে আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের এই শিক্ষক বলেন, ‘নির্বাচনের আগে এসেছিলেন, তখন তাদের (যুক্তরাষ্ট্র) একটা পজিশন ছিল। নির্বাচন তো হয়ে গেছে। ওরা যা বলেছিল, তা তো তারা বাস্তবায়ন করেনি। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মতো দেশ বা যে কোনো দেশ কিন্তু শুধু কিছু আইডিয়ালসের ওপর ভিত্তি করে তাদের পররাষ্ট্রনীতি পারসু করে না। তাদের এন্টারেন্সটাই মূল থাকে। এ অঞ্চলে যে প্রতিদ্বন্দ্বিতাগুলো হচ্ছে, সেখানে এন্টারেন্স ও আধিপত্য ধরে রাখাই বড় ব্যাপার। রাষ্ট্রের সঙ্গে তাদের স্বার্থের ওপর ভিত্তি করে পররাষ্ট্রনীতি চলে। যেহেতু নতুন সরকার এসে গেছে, এই সরকারের সঙ্গে তো তাদের চালিয়ে যেতে হবে। যে ধারাবাহিকতা চলছে, এর ওপরই চলবে।’

আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক ও জাতীয় সংসদের হুইপ আবু সাঈদ আল মাহমুদ জাগো নিউজকে বলেন, ‘যুক্তরাষ্ট্রের মতো একটি দেশের সাউথ অ্যান্ড সেন্ট্রাল এশিয়ার অ্যাসিসট্যান্ট সেক্রেটারি ফর স্টেটের বাংলাদেশ সফর নিঃসন্দেহে অর্থবহ একটি কূটনৈতিক উদ্যোগ। তার এ সফর সম্পর্কে ‘পাগলে কি না বলে ছাগলে কি না খায়’ টাইপের কথাবার্তা একটি মহল থেকে তোলা হয়েছে। সেটি নিয়ে মাতামাতি করা বা প্রোপাগান্ডা ছড়ানো এক ধরনের দেউলিয়াপনা।’

‘তিনি আসছেন একটি সার্বভৌম ও মর্যাদাবান রাষ্ট্রের সঙ্গে দুই দেশের সম্পর্ক অধিকতর উন্নয়ন এবং অভিন্ন স্বার্থ নিয়ে কাজ করার জন্য। যারা মনে করছেন অপর একটি রাষ্ট্রের মন্ত্রী এসে আমাদের অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক বিষয়ে হস্তক্ষেপ করবেন তারা এখনো মানসিকভাবে স্বাধীন হতে পারেননি অথবা বিকলাঙ্গ মানসিকতা বহন করেন।’

তিনি আরও বলেন, ‘তারা ত্রিশ লাখ প্রাণের বিনিময়ে অর্জিত স্বাধীনতা ভুলে যান এবং বাংলাদেশের নেতা শেখ হাসিনার বিশ্ব রাজনীতির উচ্চতা সম্পর্কে সম্যক অবহিত নন। তার এ সফর দুই দেশের অভিন্ন স্বার্থ সম্পর্কে অধিকতর কাজ করার ক্ষেত্রে একটি নতুন দিগন্তের সূচনা করবে।’

লু’র এ সফরকে তার নিজ দেশের এজেন্ডা বাস্তবায়নের জন্য বলে মনে করেন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এবং সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের। মঙ্গলবার (১৪ মে) সচিবালয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে তিনি বলেন, মার্কিন সহকারী পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডোনাল্ড লু নিজ দেশের এজেন্ডা বাস্তবায়নে আলোচনা করতে এসেছেন। তাকে আমরা নিমন্ত্রণ করে আনছি না, তারা তাদের বিভিন্ন প্রয়োজনে এদেশে আসেন। সম্পর্ক থাকলে আসতে হয়। তাদের ভিসানীতিসহ কোনো ইস্যুকেই আমরা কেয়ার করি না। তিনি কোনো মন্ত্রীও নন, তাকে নিয়ে এত মাতামাতি কেন?

এর আগে, সোমবার (১৩ মে) পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদ বলেন, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে আমাদের সম্পর্ক অত্যন্ত চমৎকার। তবে র্যাবের নিষেধাজ্ঞা ও ভিসানীতি আমাদের সম্পর্কের ক্ষেত্রে কিছুটা রেখাপাত করেছে। যুক্তরাষ্ট্রের দক্ষিণ ও মধ্য এশিয়াবিষয়ক সহকারী পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডোনাল্ড লু’র ঢাকা সফরে র্যাবের ওপর আরোপিত নিষেধাজ্ঞা ও ভিসানীতি তুলে নেওয়ার বিষয়ে আমরা আলোচনা করবো।’

তিনি বলেন, ‘মার্কিন প্রশাসন থেকে যারাই বাংলাদেশে সফর করুক না কেন, আমাদের সম্পর্ককে এগিয়ে নেওয়ার লক্ষ্যে একসঙ্গে কাজ করবো। সেখানে অর্থনৈতিক সম্পর্ক আছে, আমাদের নানা ক্ষেত্রে সহযোগিতা আছে।’

তিনদিনের সফরে ঢাকায় এসেছেন যুক্তরাষ্ট্রের দক্ষিণ ও মধ্য এশিয়াবিষয়ক সহকারী পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডোনাল্ড লু। বাংলাদেশের দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পর প্রথমবার ঢাকা সফরে এলেন মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তরের এই কর্মকর্তা। এ পর্যন্ত চারবার ঢাকা সফর করেন তিনি। এর আগে ডোনাল্ড লু ঢাকা সফর করেন গত বছরের ১৪ ও ১৫ জানুয়ারি। সে সময় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশে স্বচ্ছ, গ্রহণযোগ্য ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন নিয়ে নানা তৎপরতা দেখিয়েছে। এরপর ৭ জানুয়ারির নির্বাচনের আগে লু নভেম্বরের মাঝামাঝি সময়ে আওয়ামী লীগ ও বিএনপিকে শর্তহীন সংলাপের জন্য চিঠি দিয়েছিলেন।

এবারের সফরের প্রথম দিনে সুশীল সমাজের সঙ্গে বৈঠক করেন লু। এতে শ্রম, মানবাধিকার এবং আর্থিক পরিস্থিতি নিয়ে আলোচনা হয়েছে। একই সঙ্গে রাতে প্রধানমন্ত্রীর বেসরকারি শিল্প ও বিনিয়োগ উপদেষ্টা সালমান এফ রহমানের নৈশভোজে যোগ দেন। এতে ডোনাল্ড লু ছাড়াও আইনমন্ত্রী আনিসুল হক, বাণিজ্য প্রতিমন্ত্রী আহসানুল ইসলাম টিটু, তথ্য ও সম্প্রচার প্রতিমন্ত্রী মোহাম্মদ আলী আরাফাত, পররাষ্ট্র সচিব মাসুদ বিন মোমেন, সাবেক পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শাহরিয়ার আলম, অ্যাম্বাসেডর ফারুক সোবাহান ও ড. কাজী খলিকুজ্জামান আহমেদ উপস্থিত ছিলেন।

নৈশভোজ শেষে সাংবাদিকদের সালমান এফ রহমান বলেন, ডোনাল্ড লুকে আমরা র্যাবের ওপর নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার ও বঙ্গবন্ধুর খুনি রশিদ চৌধুরীকে ফেরানোর কথা বলেছি। তিনি জানিয়েছেন, এই দুটি বিষয় তাদের জাস্টিস ডিপার্টমেন্টের কাছে। আর তাদের জাস্টিস ডিপার্টমেন্ট স্বাধীন। এছাড়া বাংলাদেশে কাজ করা মার্কিন কোম্পানিগুলো তাদের কাছে বলেছে, ডলার সংকটের কারণে তারা মুনাফা নিতে পারে না। আমরা বলেছি সমস্যার সমাধান হয়েছে।

সালমান এফ রহমান বলেন, ডোনাল্ড লুর সঙ্গে রোহিঙ্গা ইস্যু নিয়ে আলোচনা হয়েছে। রোহিঙ্গা ইস্যুতে সহযোগিতা অব্যাহত রাখার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন তিনি।

ফিলিস্তিন প্রসঙ্গে কথা হয়েছে জানিয়ে তিনি বলেন, যুক্তরাষ্ট্রও ফিলিস্তিন ইস্যুতে স্থায়ী সমাধান চায়। এছাড়া এ অঞ্চলে নেপাল, ভুটান থেকে বিদ্যুৎ আনা, জলবায়ু পরিবর্তন, ব্যবসা-বাণিজ্য, বিনিয়োগ নিয়ে আলোচনা হয়েছে।

আলাদা এক প্রশ্নের উত্তরে সালমান এফ রহমান বলেন, ভিসানীতি নিয়ে কোনো আলোচনা হয়নি। চীন ইস্যুতেও কোনো আলোচনা হয়নি।

সফরের দ্বিতীয় দিন বুধবার পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদ, পরিবেশ ও জলবায়ু পরিবর্তনবিষয়ক মন্ত্রী সাবের হোসেন চৌধুরীর সঙ্গে আলাদা বৈঠক হয় ডোনাল্ড লু’র। এছাড়া পররাষ্ট্র সচিব মাসুদ বিন মোমেনের সঙ্গে আনুষ্ঠানিক দ্বিপক্ষীয় বৈঠক হবে। তৃতীয় দিন বৃহস্পতিবার লু ঢাকা ত্যাগ করবেন।

এসইউজে/এএসএ/জিকেএস

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।