পরিবারতন্ত্র-অর্থের দাপটে কোণঠাসা তৃণমূলের নেত্রীরা

ইসমাইল হোসাইন রাসেল
ইসমাইল হোসাইন রাসেল ইসমাইল হোসাইন রাসেল
প্রকাশিত: ০৪:১০ পিএম, ২১ মার্চ ২০২৪

চার দশকেরও বেশি সময় ধরে দেশের প্রধান দুই দলের নেতৃত্বে দুই নারী। তাদের হাত ধরেই বাংলাদেশে রাজনীতিতে নারী নেতৃত্ব শক্ত অবস্থান তৈরি করেছে। তবে তিন দশকেরও বেশি সময় ধরে ধারাবাহিকভাবে নারীরা দেশ পরিচালনা করলেও তৃণমূল পর্যায়ে নারী নেতৃত্ব এখনো কোণঠাসা। লড়াই-সংগ্রাম করে অনেকে কেন্দ্রীয় রাজনীতিতে আসতে পারলেও পরিবারতন্ত্র আর অর্থের দাপটের কাছে হার মানতে হচ্ছে। ফলে সারাজীবনের আত্মত্যাগ আর রাজনীতির মূল্যায়ন থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন অনেক নারী।

তৃণমূলের নারী রাজনীতিবিদরা বলছেন, একটি দলের রাজনীতির অন্যতম কেন্দ্রবিন্দু তৃণমূল। এক্ষেত্রে স্থানীয় রাজনীতিতে অনেক লড়াই-সংগ্রাম করে কেন্দ্রে পৌঁছান নারীরা। কিন্তু দলীয় প্রভাবশালীর পরিবারের সদস্যকেন্দ্রিক জটিলতা আর অর্থের দাপটে সেখানে জায়গা করে নিতে ব্যর্থ হন অনেকেই। তবে সফলতাও রয়েছে। যদিও সে সংখ্যা একেবারেই কম।

এ বিষয়ে ঢাকা মহানগর দক্ষিণ বিএনপির সদস্য নাদিয়া পাঠান পাপন জাগো নিউজকে বলেন, ‘যখন ছাত্র রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত ছিলাম তখন সমস্যা ছিল একরকম। এখন যেহেতু ঢাকা মহানগর বিএনপিতে আছি, এখন সমস্যাগুলো একটু ভিন্নরকম। ছাত্রদল করার সময় বদরুন্নেসা সরকারি মহিলা কলেজের সেক্রেটারি ছিলাম। পরে ওই কলেজের সভাপতি প্রার্থী হই। দীর্ঘদিন সেখানে ছিলাম, আমার অনেক কর্মী ছিল। দুঃসময়ে ৪০ জন নারী নিয়ে মুভ করা কঠিন। ২০১৩-১৪ সালের দিকে এটি কঠিন ছিল। তবে তারপরও হয়তো সিনিয়রদের কোনো ক্যান্ডিডেট ছিল, তাই তারা কমিটি দেননি।

 

অনেক সময় নিউজেও দেখি যুবদলের যারা আছে, স্বেচ্ছাসেবক দলের যারা আছে তাদের পরে আমাদের নামটা দেওয়া হয়। যেখানে পদ এবং অবস্থান অনুযায়ী আমার নাম তাদের আগে আসার কথা। পদ পাওয়ার পরও গণমাধ্যম থেকে শুরু করে অনেক বিষয়ে নিজেদের অবস্থান তৈরি করতে আমাদের সংগ্রাম করতে হয়।

 

২০১৮ সালে আমি বহিষ্কার হওয়ার পর কিন্তু কমিটি দিয়েছে। এরপর নানান ইস্যুতে (কারণে) ছাত্রদলের কেন্দ্রীয় কমিটিতে আমাকে জায়গা দেওয়া হয়নি। আমার মতামতের গুরুত্ব কেউ দেয়নি। আমরা কিন্তু নতুন কর্মী তৈরি করতে পারছি না। কারও ভাই বা বাবা দলের রাজনীতিতে আছে- তারা হয়তো আসছে। একেবারে নতুন করে সেভাবে কেউ রাজনীতিতে আসছে না। হয়তো নারী হওয়ায় আমার কথাগুলো আমলে নেওয়া হয়নি।’

তিনি বলেন, ‘ঢাকা মহানগর দক্ষিণ বিএনপির সদস্য আমি। অনেক সময় বিভিন্ন অনুষ্ঠানে দেখা যায় কোনো নেতার স্ত্রী বা নেতার মেয়ে কিংবা প্রভাবশালী ধনী কোনো নারী হলে তার জন্য জায়গা ছেড়ে দেওয়া হচ্ছে। কিন্তু যখন আমাদের মতো তৃণমূল থেকে উঠে আসা নেতৃত্ব ধীরে ধীরে তিলে তিলে কষ্ট করে একটি জায়গা পাই, পদবি অনুযায়ী আমাদের জায়গাটি পেতে খুব কষ্ট হয়। এমনকি অনেক সময় নিউজেও দেখি যুবদলের যারা আছে, স্বেচ্ছাসেবক দলের যারা আছে তাদের পরে আমাদের নামটা দেওয়া হয়। যেখানে পদ এবং অবস্থান অনুযায়ী আমার নাম তাদের আগে আসার কথা। পদ পাওয়ার পরও গণমাধ্যম থেকে শুরু করে অনেক বিষয়ে নিজেদের অবস্থান তৈরি করতে আমাদের সংগ্রাম করতে হয়।’

আরও পড়ুন

নাদিয়া পাঠান পাপন আরও বলেন, ‘মহানগর বিএনপিতে কিছুদিন আগে আমাদের টিম করে দেওয়া হয়েছিল। লালবাগ, কামরাঙ্গীরচর, চকবাজার- এই তিন থানার দায়িত্বে আছি আমি। আমাদের আহ্বায়ক ও সদস্য সচিব কিন্তু নারী হিসেবে আমাদের সম্মানটা দিয়েছেন। আমরা বিভিন্ন অনুষ্ঠান সঞ্চালনা করেছি, যেটা অতীতে বিএনপির কোনো কমিটিতে হয়নি। কিন্তু সমস্যা হলো টিম গঠনে গুরুত্ব দেওয়া হলেও দলের অনেক বৈঠকই আমাদের বাদ দিয়ে করা হতো। এখানে কিন্তু আমার মতামত দেওয়ার অধিকার আছে। বৈঠকে যদি আমাকে বাদ দেওয়া হয় তখন আমার জায়গা কতটুকু থাকে! অথচ দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান প্রোগ্রামে সংযুক্ত থাকলে সেখানে আমাদের বাদ দেওয়া হয় না, সেখানে সবার আগে আমাদের রাখা হয়। জুম মিটিংয়ে আমাদের সবার বক্তব্য দেওয়ার সুযোগ থাকে। অন্য সময়ে কিন্তু আমাদের অবহেলা করা হয়। নারী হিসেবে সেখানে আমরা মূল্যায়ন পাই না।’

 

জেলা আর কেন্দ্রের পরিস্থিতি অনেকটাই ভিন্ন। কারণ দেখা যায় কেন্দ্রে ঢাকার আধিক্যই বেশি। ঢাকা তো একটা জেলা, তাহলে ঢাকার তো আলাদা প্রতিনিধিত্ব করার জায়গা থাকবে। সবারই তো সমান সুযোগ। কিন্তু নারীদের কণ্ঠ কম শোনা যাচ্ছে, এক্ষেত্রে কেন্দ্রীয় কমিটিতে সব জেলার প্রতিনিধি থাকা দরকার।

 

বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের শিক্ষা ও মানবসম্পদ বিষয়ক সম্পাদক বেগম শামসুন নাহার জাগো নিউজকে বলেন, ‘আমি গ্রামের মেয়ে। আমাকে কিন্তু কেউ ধরে রাখেনি। আজ যেখানে এসেছি, এটা আমার নিজের উদ্যোগে। তৃণমূলের রাজনীতিতে নারীদের কিছু কিছু সমস্যা আছে। এগুলো ধীরে ধীরে উতরে উঠবে। নারীদের জন্য সর্বত্রই চ্যালেঞ্জ।’

সিলেট জেলা আওয়ামী লীগের কার্যকরী কমিটির সদস্য ডা. নাজরা চৌধুরী বলেন, ‘জেলা আর কেন্দ্রের পরিস্থিতি অনেকটাই ভিন্ন। কারণ দেখা যায় কেন্দ্রে ঢাকার আধিক্যই বেশি। ঢাকা তো একটা জেলা, তাহলে ঢাকার তো আলাদা প্রতিনিধিত্ব করার জায়গা থাকবে। আমি তৃণমূলে বিশ্বাস কম করি, আমি মনে করি আমরা প্রান্তিক অথবা প্রত্যেকেই আলাদা জেলা, উপজেলাসহ সব জায়গায় সমান সুযোগ পাবো। কারণ এখন তো গ্রামও হবে শহর। সুতরাং সবারই তো সমান সুযোগ। কিন্তু নারীদের কণ্ঠ কম শোনা যাচ্ছে, এক্ষেত্রে কেন্দ্রীয় কমিটিতে সব জেলার প্রতিনিধি থাকা দরকার। কেন্দ্রীয় কমিটিতে যদি শুধুই ঢাকা জেলার আধিক্য থাকে, তখন এটা মুশকিল।’

তিনি আরও বলেন, ‘শুধু অনুষ্ঠানে বসার সিটের বেলায় নয়, যখন নারীদের কমিটি হচ্ছে তখন কমিটিগুলোতেও প্রভাব বিস্তার করতে দেখা যায়। সিলেট জেলার কথা যদি বলি, এখানকার সেক্রেটারি কিন্তু তার স্ত্রীকে রাজনীতিতে আনছেন না। তারা দুজনই রাজনীতি করে এসেছেন, কিন্তু তার প্রভাব এখানে দেখাচ্ছেন না। অনেক ক্ষেত্রে কারও ক্ষমতার বলে কেউ মহিলা আওয়ামী লীগের সেক্রেটারি হচ্ছেন, সেই বলে হয়তো নির্বাচনে দাঁড়িয়ে যাচ্ছেন। দেখা যাচ্ছে একজনের ক্ষমতাকে পরিবারের ছয়জন ব্যবহার করছেন। এটাও তৃণমূলের নেত্রীদের রাজনীতির ক্ষেত্রে অন্তরায়। আমার বাপ-দাদারা রাজনীতি করেছেন, তারা কখনো আমাদের নাম কোথাও বলেননি। আমরা তদবিরের রাজনীতিতে আসিনি। নিজের যোগ্যতায় রাজনীতিতে আসা এক জিনিস, আর বাবার পাওয়ার বিক্রি করে রাজনীতিতে আসা আরেক জিনিস।’

 

যখন কেউ ক্ষমতায় থাকেন তখন ক্ষমতার চর্চাটা তার পরিবারের বাইরে যেতে দিতে চান না। তার মধ্যেই কুক্ষিগত রাখতে চান। এর মূল কারণ দলের মধ্যে গণতান্ত্রিক চর্চা নেই। গণতান্ত্রিক চর্চা যদি হতো দলের মধ্যে, সেক্ষেত্রে পরিবারের কেউ এলেও সেটা কেউ প্রশ্ন তুলতো না।

 

রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করেন, দলের মধ্যে গণতান্ত্রিক চর্চার অভাব থাকলে এ ধরনের সংকট তৈরি হয়। এক্ষেত্রে তৃণমূলের নেত্রীরা কেন্দ্রে এসে নিজেদের অবস্থান তৈরি করতে পারেন না। ফলে রাজনীতি বাদ দিয়ে তোষামোদি আর লবিংয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়েন অনেকে।

এ বিষয়ে ডেমোক্রেসি ইন্টারন্যাশনালের সিনিয়র ডিরেক্টর লিপিকা বিশ্বাস জাগো নিউজকে বলেন, ‘সার্বিকভাবে রাজনৈতিক দলের মধ্যেও দেখি গণতান্ত্রিক চর্চার জায়গায় গ্যাপ আছে। সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষেত্রে সবাই বসে আলোচনা করার বিষয়টির চর্চা হয় না। অনেক ক্ষেত্রে দেখা যায় কমিটির দু-তিনজন বসে সিদ্ধান্ত নিচ্ছেন। রাজনীতিটা এখন লবিংভিত্তিক। কারও কাজের ভিত্তিতে তার মূল্যয়ন হওয়া উচিত, কিন্তু সবসময় তেমনটা হয় না। এক্ষেত্রে সরকারি দলে থাকলে এক রকম আর বিরোধী দলে থাকলে আরেক রকম চর্চা হচ্ছে। সরকারি দলে থাকলে তোষামোদের বিষয় থাকলে লবিংভিত্তিক রাজনৈতিক চর্চা হয়। ফলে তৃণমূল থেকে যেসব নারী আসেন তাদের আসলে সেখানে খেই পাওয়াটা কঠিন হয়ে যায়।’

তিনি বলেন, ‘যখন কেউ ক্ষমতায় থাকেন তখন তার ক্ষমতার চর্চাটা তার পরিবারের বাইরে যেতে দিতে চান না। তার মধ্যেই কুক্ষিগত রাখতে চান। তখন তিনি ক্ষমতার জায়গাটি বাইরে দিতে চান না। ক্ষমতার চর্চা এখন এমন হয়ে গেছে। এর মূল কারণ দলের মধ্যে গণতান্ত্রিক চর্চা নেই। গণতান্ত্রিক চর্চা যদি হতো দলের মধ্যে, সেক্ষেত্রে পরিবারের কেউ এলেও সেটা কেউ প্রশ্ন তুলতো না। কিন্তু এখানে গণতান্ত্রিক চর্চা না থাকার কারণে একজন বাইরে থেকে এলে তার জন্য সবকিছু কঠিন হয়ে যায়, সে হাবুডুবু খেতে থাকে। বিরোধী দলের রাজনীতি মানে দলের জন্য মিছিল-মিটিংয়ে যাওয়া, মানুষ নিয়ে আসা। কিন্তু সিদ্ধান্ত গ্রহণের জায়গায় যেতে হলে যে গণতান্ত্রিক চর্চা দলের মধ্যে থাকা দরকার, সেটা বাংলাদেশের রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে খুবই অভাব। এ কারণে একজন তৃণমূলের নারীর জন্য এখানে এসে জায়গা করে নেওয়া কঠিন, তার জন্য রাজনীতিতে একটা লিডিং রোলে যাওয়া কঠিন। তার লবিং যদি খুব স্ট্রং হয়, তাহলে হয়তো দেখা যায় তিনি এগিয়ে যেতে পারেন। কিন্তু নারীদের জন্য সেটি আসলেই কঠিন।’

আইএইচআর/কেএসআর/জিকেএস

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।