ঢাকা-৫

আওয়ামী লীগেরই তিন নেতার লড়াই, নেতাকর্মীরা বিভক্ত

ইসমাইল হোসাইন রাসেল
ইসমাইল হোসাইন রাসেল ইসমাইল হোসাইন রাসেল
প্রকাশিত: ০৫:৩৬ পিএম, ০২ জানুয়ারি ২০২৪
একই গলিতে পাশাপাশি শোভা পাচ্ছে নৌকা, ট্রাক ও ঈগল প্রতীকের পোস্টার

ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের ১৪টি ওয়ার্ড নিয়ে গঠিত ঢাকা-৫ আসন। আসন্ন দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে এ আসন থেকে প্রার্থী হয়েছেন ১২ জন। তবে আওয়ামী লীগ সমর্থিত একজন ও দলের মনোনয়নবঞ্চিত দুই নেতা, যারা স্বতন্ত্র প্রার্থী হয়েছেন, তাদের মধ্যেই হবে প্রতিযোগিতা। সারাদেশের মতো এ আসনেও ঈগল ও ট্রাক মার্কা পাওয়া আওয়ামী লীগের দুই নেতা চালাচ্ছেন ব্যাপক প্রচারণা। নিজেদের অনুসারীদের নিয়ে সমানভাবে মাঠ চষে বেড়াচ্ছেন তিন নেতা। সব মিলিয়ে ভোটে নৌকা, ঈগল ও ট্রাকের মধ্যে ত্রিমুখী জমজমাট লড়াই হবে বলে মনে করছেন স্থানীয়রা। একই সঙ্গে নিজেদেরই তিন নেতাকে নিয়ে বিভক্ত হয়ে পড়েছে স্থানীয় আওয়ামী লীগ।

ঢাকা-৫ আসনে মোট ভোটার ৪ লাখ ৯০ হাজার ৮০৫। এরমধ্যে পুরুষ ভোটার ২ লাখ ৫১ হাজার ৫৩৯ এবং নারী ভোটার ২ লাখ ৩৯ হাজার ২৬৩ জন।

সরেজমিনে দেখা গেছে, এ আসনের প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীদের মধ্যে নৌকার প্রার্থী হারুনর রশিদ মুন্না, ঈগল প্রতীকের স্বতন্ত্র প্রার্থী কামরুল হাসান রিপন এবং ট্রাক প্রতীকের আরেক স্বতন্ত্র প্রার্থী মশিউর রহমান মোল্লা সজল সরব প্রচারণা চালাচ্ছেন। এ আসনের বাকি প্রার্থীরা অপরিচিত এবং প্রচারণায়ও তাদের নেই তেমন সাড়া।

এ আসনে অন্য প্রার্থীরা হলেন তৃণমূল বিএনপির (সোনালি আঁশ) মো. আবু হানিফ হৃদয়, ইসলামিক ফ্রন্ট বাংলাদেশের (চেয়ার) আবু জাফর মো. হাবিব উল্লাহ, বাংলাদেশ কংগ্রেসের (ডাব) মো. সাইফুল আলম, বাংলাদেশ ন্যাশনালিস্ট ফ্রন্টের (টেলিভিশিন) এস এম লিটন, ইসলামী ঐক্যজোটের (মিনার) মো. আব্দুল কাইয়ুম, ন্যাশনাল পিপলস পার্টির (আম), মো. আরিফুর রহমান (আম), বাংলাদেশ সাংস্কৃতিক মুক্তিজোটের (ছড়ি) মো. নূরুল আমিন, বাংলাদেশ সুপ্রিম পার্টির (একতারা) মো. মোশারফ হোসেন মিয়া, বাংলাদেশ জাতীয় পার্টির (কাঁঠাল) সারোয়ার খান।

স্বতন্ত্র প্রার্থী, আওয়ামী লীগ নেতা মশিউর রহমান মোল্লা সজল (সাদা পাঞ্জাবি পরিহিত)

ভোটের ইতিহাস বলছে, ঢাকা-৫ আসনে ১৯৯১ সালের পঞ্চম সংসদ নির্বাচনে প্রয়াত আওয়ামী লীগ নেত্রী সাহারা খাতুনকে পরাজিত করে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া। ১৯৯৬ সালের সপ্তম সংসদ নির্বাচনে বিএনপির প্রার্থী মো. কামরুল ইসলামকে হারিয়ে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন আওয়ামী লীগের প্রার্থী এ কে এম রহমতুল্লাহ। ২০০১ সালে অষ্টম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী এ কে এম রহমতুল্লাহকে হারিয়ে নির্বাচিত হন বিএনপির প্রার্থী মো. কামরুল ইসলাম। ২০০৮ সালে নবম সংসদ নির্বাচনে বিএনপির প্রার্থী সালাহ উদ্দিন আহমেদকে, ২০১৪ সালে দশম সংসদ নির্বাচনে তরিকত ফেডারেশনের প্রার্থী আরজু শাহ সায়দাবাদীকে, ২০১৮ সালের একাদশ সংসদ নির্বাচনে বিএনপির প্রার্থী নবীউল্লা নবীকে হারিয়ে টানা তিনবার জয়লাভ করেন আওয়ামী লীগের প্রার্থী হাবিবুর রহমান মোল্লা।

আরও পড়ুন>> ফাঁকা মাঠে নসরুল হামিদের একক আধিপত্য

ঢাকা-৫ আসন ঘুরে দেখা গেছে, এ আসনের তিনজন প্রার্থী ছাড়া অন্যদের প্রচারণা তেমন নেই। নৌকা, ঈগল ও ট্রাকের প্রার্থীদের ব্যানার, পোস্টার ও মাইকিংয়ে চলছে সরব প্রচারণা। এ তিন প্রার্থী পাড়া-মহল্লা চষে বেড়াচ্ছেন। প্রতিশ্রুতি দিচ্ছেন ভোটারদের। দুই স্বতন্ত্র প্রার্থীর প্রচারণায় অনেকটা বাড়তি চাপে আছেন ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগের প্রার্থী।

এ নিয়ে দনিয়ার বাসিন্দা মুজিবর রহমান জাগো নিউজকে বলেন, আমাদের এলাকায় তিনজন প্রার্থীকেই বেশি দেখছি। এরমধ্যে নৌকার প্রার্থী মুন্না, স্বেচ্ছাসেবক লীগের রিপন আর সাবেক এমপি মোল্লা সাহেবের ছেলে সজল মোল্লা। সমানে সমান লড়াই হবে বলে মনে হচ্ছে। সুষ্ঠু নির্বাচন হলে তিনজনের ভোটের ব্যবধান থাকবে খুবই কম। তবে বিএনপি যেহেতু ভোট করছে না, সেহেতু অনেকেরই আবার ভোট নিয়ে আগ্রহ নেই।

জনসংযোগ করছেন স্বেচ্ছাসেবক লীগ নেতা কামরুল হাসান রিপন (বামে)

শনির আখড়ার বাসিন্দা মাহমুদুল হাসান জাগো নিউজকে বলেন, এবার প্রথম ভোট দেবো। গতবারও ভোটার ছিলাম কিন্তু নানান কারণে ভোট দেওয়া হয়নি। তাই এবারই প্রথম বলা যায়। সব প্রার্থীই উন্নয়নের আশ্বাস দিচ্ছেন। আমরা বুঝে শুনেই ভোটটা দেবো। তবে এলাকায় তিনজন প্রার্থীরই প্রচারণা দেখছি। এর বাইরে কেউ প্রার্থী আছে কি না সেভাবে জানা নেই। তাদের মধ্যেই কম্পিটিশন হবে বলে মনে হচ্ছে।

আরও পড়ুন>> ঢাকা মহানগর: ৩ আসনের বাইরে ‘দেখা নেই’ জাতীয় পার্টির

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতা জাগো নিউজকে বলেন, মূলত ভোটে নৌকার প্রার্থী মুন্নার চেয়ে ভালো করবে ঈগল প্রতীকের রিপন এবং ট্রাক প্রতীকের সজল। নৌকার ভোটাররা কিছুটা দ্বিধাবিভক্ত হওয়ায় দলের প্রার্থী মুন্নার অবস্থা খুব একটা ভালো বলা যাবে না। তবে বিএনপির ভোটাররা ভোট দিলে কামরুল হাসান রিপন জয়লাভ করতে পারেন। কারণ সব দল মতের মানুষের সঙ্গে তার সংখ্য। অন্যদিকে সাবেক এমপি হাবিবুর রহমান মোল্লার ছেলে সজল মোল্লা ট্রাক প্রতীকে ভোট করছে। বাবার পরিচিতির কারণে তারও একটি অবস্থান এ আসনে আছে। সুতরাং দুই স্বতন্ত্র প্রার্থী বেশ ভালো ভোট পাবেন বলে মনে হচ্ছে। আর বাকি প্রার্থীদের কেউ সেভাবে চেনেই না।

ডেমরা থানা আওয়ামী লীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক ও ঢাকা-৫ আসনের স্বতন্ত্র প্রার্থী মশিউর রহমান মোল্লা জাগো নিউজকে বলেন, এবার প্রধানমন্ত্রী একটি দূরদর্শী সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। আমাদের প্রতিযোগিতার একটি আয়োজন করে দিয়েছেন। সেদিক থেকে আমি ট্রাক প্রতীক নিয়ে ঢাকা-৫ আসনের ভোটারদের ব্যাপক সাড়া পাচ্ছি। এখানে দল থেকে একজনকে মনোনয়ন দিয়েছে, আবার জননেত্রী শেখ হাসিনার অনুমতি নিয়ে আমি স্বতন্ত্র প্রার্থী হয়েছি। এখানে আওয়ামী লীগের সহযোগী সংগঠনগুলো সিদ্ধান্ত গ্রহণের একটি সুযোগ পেয়েছে। এ সুযোগটার কারণেই আজ আমাদের এখানে অংশগ্রহণমূলক ও উৎসবমুখর ভোট হচ্ছে। আমার বাবা হাবিবুর রহমান মোল্লা ঘরে ঘরে আওয়ামী লীগের কর্মী তৈরি করে গেছেন। আমার বাবা যেভাবে কাজ করেছেন সেটি আমি দেখে শিখেছি। আশা করি ৭ তারিখের ভোটে মানুষ আমার পক্ষেই রায় দেবেন।

আরেক প্রার্থী ঢাকা মহানগর দক্ষিণ স্বেচ্ছাসেবক লীগের সভাপতি মো. কামরুল হাসান বলেন, আমি নির্বাচিত হলে সব স্তরের মানুষের জন্য কাজ করবো। সন্ত্রাসমুক্ত, মাদকমুক্ত ও চাঁদাবাজমুক্ত এলাকা হিসেবে ঢাকা-৫ আসনকে গড়তে চাই। আমি নির্বাচিত হলে এলাকার মানুষের জন্য সব সময় আমার দরজা উন্মুক্ত থাকবে। আমি সিংহাসন ভোগ করি না, আমি মানুষের সেবা করার চেষ্টা করি। আমাদের এ আসনে জলাবদ্ধতার সমস্যা আছে, গ্যাস-পানির সমস্যাসহ যেসব সমস্যা আছে আমি সমাধানে কাজ করবো। কোনো ধরনের মাস্তানকে আশ্রয়-প্রশ্রয় আমি দেই না। যেহেতু আমি স্বতন্ত্র প্রার্থী, দলমত নির্বিশেষে সবাই আমাকে ভোট দিতে পারবেন। আমি সাধারণ জনগণের প্রার্থী। আগামী ৭ তারিখ ভোটাররা কেন্দ্রে গিয়ে ঈগল মার্কায় ভোট দেবেন বলে প্রত্যাশা করছি।

আরও পড়ুন>> প্রতিদ্বন্দ্বীরা ‘লাইটওয়েট’, তবুও দিন-রাত গণসংযোগে সাঈদ খোকন

স্থানীয়দের অনেকে বলছেন, এখানে তিনজন নেতাই স্থানীয়ভাবে প্রভাবশালী। ফলে সংঘর্ষের শঙ্কাও থেকে যায়। তবে প্রার্থীরা সে শঙ্কা নাকচ করে দিয়েছেন।

নৌকা প্রতীকের প্রার্থী হারুনর রশীদ মুন্না (ডানে, চশমা পরিহিত)

আওয়ামী লীগের প্রার্থী ও যাত্রাবাড়ী থানা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক হারুনর রশীদ মুন্না বলেন, আমি ভোটারদের বলবো, ৭ তারিখে সবাইকে নিয়ে নৌকা মার্কায় ভোট দেবেন। কারও যদি কোনো কথা থাকে বা অভিযোগ থাকে সেটি আমরা ৭ তারিখের পর অবশ্যই শুনবো। নির্বাচনে যে মোট ভোট পড়বে তার ৭০ শতাংশ নৌকায় পড়বে বলে প্রত্যাশা করছি। আমাকে ভোট দিয়ে নির্বাচিত করে ভোটাররা দেখতে পারেন, আমি বিগত এমপিদের মতো হই কি না। আমি কথা দিতে পারি, চাঁদাবাজি চিরতরে বন্ধ করে দেবো। অনিয়ম, দুর্নীতি, স্বেচ্ছাচারিতা এ এলাকায় থাকবে না। আমি সেটি পারবো এবং আমি পারি।

তিনি বলেন, নির্বাচনের পরিবেশ এখন পর্যন্ত ভালো আছে। সুন্দর ও সুষ্ঠুভাবে প্রচারণা চলছে। আমার নির্দেশ আছে কোনো নেতাকর্মী যেন উচ্ছৃঙ্খলতা না করে এবং সবাইকে সুন্দরভাবে ভোটকেন্দ্রে আসার আহ্বান জানায়, এটা আমাদের শিক্ষা। ঢাকা-৫ নির্বাচনী এলাকার নেতাকর্মীরা এক ও অভিন্ন, এর বাইরে কিছু নেই। কে স্বতন্ত্র ভোট করলো বা না করলো আওয়ামী লীগ তা বুঝতেও চায় না। মানুষ অধীর আগ্রহে বসে আছে আমাদের ভোট দেওয়ার জন্য। প্রধানমন্ত্রী সব কিছুই দিয়েছেন, যদি কিঞ্চিত কিছু বাকি থাকে সেটিও আগামীতে তিনি করবেন। বাংলাদেশের মানুষের লেখাপড়ার জন্য আর বিদেশে যেতে হবে না, কোনো রোগীকে আর ভারতবর্ষ বা সিঙ্গাপুরে যেতে হবে না। বাংলাদেশেই প্রধানমন্ত্রী সব ব্যবস্থা করবেন।

আইএইচআর/এমএইচআর/এএসএম

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।