আওয়ামী লীগে ‘গৃহদাহ’
প্রতীক বরাদ্দের দিন থেকেই মাঠ দাপিয়ে বেড়াচ্ছেন প্রার্থীরা। জোরেশোরে চলছে নির্বাচনী প্রচারণা, মিছিল, সভা-সমাবেশ। ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ, স্বতন্ত্রপ্রার্থীর পাশাপাশি মাঠে রয়েছে জাতীয় পার্টিসহ অন্য দলের প্রার্থীরা। প্রচারণা শুরুর প্রথম পাঁচদিনেই দেশের বিভিন্ন স্থানে হত্যা, সংঘর্ষ, বোমাবাজি হয়েছে। তবে এসব সংঘর্ষে জড়ানো উভয়পক্ষই আওয়ামী লীগ সমর্থিত। কারণ স্বতন্ত্রপ্রার্থীরা অধিকাংশই আওয়ামী লীগের পদধারী নেতা। জাতীয় নির্বাচন কেন্দ্র করে এ ‘গৃহবিবাদ’ নিয়ে বিপাকে ক্ষমতাসীনরা। এরই মধ্যে এজাতীয় কর্মকাণ্ড থেকে বেরিয়ে না এলে ব্যবস্থা নেওয়ার হুঁশিয়ারি দিয়েছেন দলের সভানেত্রী।
গত কয়েকদিনে গণমাধ্যমে আসা বিভিন্ন ঘটনা বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, বেশির ভাগ জায়গায় নৌকার সমর্থকরাই হামলা করছেন। বেশ কয়েকটি জায়গায় স্বতন্ত্র প্রার্থী শক্তিশালী। কর্মী-সমর্থকদের মধ্যে বাগবিতণ্ডা রূপ নিচ্ছে হত্যা-সংঘর্ষে। এ গৃহবিবাদে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে আওয়ামী লীগ।
যদিও আওয়ামী লীগ চায়, প্রতিদ্বন্দ্বিতায় যেই জিতে আসে, আসুক। এ নিয়ে একে অপরের বাধা হতে পারবে না। বিশেষ করে, পদধারী নেতাদের এ বিষয়ে কঠোর নির্দেশনা দিয়েছেন দলটির সভাপতি শেখ হাসিনা।
আরও পড়ুন>> স্বতন্ত্রপ্রার্থীর নির্বাচনী ক্যাম্প স্থাপন নিয়ে সংঘর্ষ, নিহত ১
দলটির নেতারাও বলছেন, নির্বাচন প্রতিদ্বন্দ্বিতামূলক করার জন্য ও উৎসবমুখর করতে স্বতন্ত্র উন্মুক্ত করে দেওয়া হয়েছে। কিন্তু সংঘাত সংঘর্ষ কাম্য নয়। বিষয়টি মনিটরিং করা হচ্ছে। এটি ধীরে ধীরে কমে আসবে। কেউ সংঘাতে জড়ালে ব্যবস্থা নেওয়া হবে বলেও জানিয়ে দেওয়া হয়েছে।
জানা যায়, জাতীয় সংসদের ৩০০ আসনের মধ্যে ২৬৬ আসনে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ নৌকার প্রার্থী দিয়েছে। এর মধ্যে ২২১ আসনে স্বতন্ত্র প্রার্থী ৩৮২ জন। এদের বেশিরভাগই আওয়ামী লীগের পদধারী নেতা। নৌকার সমর্থকদের পাশাপাশি স্বতন্ত্র প্রার্থীর কর্মী-সমর্থকরাও আওয়ামী লীগ ও তার সহযোগী সংগঠনের পদধারী নেতাকর্মী। জেলা, উপজেলা, থানা ও ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের নেতারাও কাজ করতে গিয়ে দ্বিধাবিভক্ত। এদের কর্মী-সমর্থকরা একে অপরের মুখোমুখি হয়ে সংঘাতে জড়াচ্ছেন। এতে ব্যক্তির পাশাপাশি দল হিসেবেও ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে আওয়ামী লীগ।
ময়মনসিংহে স্বতন্ত্র প্রার্থীর ক্যাম্প করতে গিয়ে নিহত ১
১৯ ডিসেম্বর মঙ্গলবার ময়মনসিংহ সদর উপজেলার গুতাপাড়া গ্রামে স্বতন্ত্র প্রার্থীর নির্বাচনী ক্যাম্প করতে গিয়ে দুপক্ষের সংঘর্ষে আওয়ামী লীগ কর্মী রফিকুল ইসলাম (৫২) হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়েছেন। হুতারপাড়া মোড়ের আইনুদ্দিনের দোকানের সামনে ময়মনসিংহ-৪ আসনের স্বতন্ত্র প্রার্থী আমিনুল হক শামীমের ট্রাক প্রতীকের অস্থায়ী নির্বাচনী ক্যাম্প স্থাপনের প্রস্তুতি চলছিল। ক্যাম্প তৈরি নিয়ে ছোট ভাই ফারুক (৪০), বড় ভাইয়ের ছেলে রাজু (২৮), সাজু (২৫) ও রফিকুল ইসলামের মধ্যে বাগবিতণ্ডা হয়। একপর্যায়ে নিজেরা সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়েন। এসময় রফিকুল ইসলাম গুরুতর আহত হন। পরে স্থানীয়রা তাকে উদ্ধার করে হাসপাতালে নেওয়ার পর কর্তব্যরত চিকিৎসক মৃত ঘোষণা করেন।
আমাদের সিদ্ধান্ত ছিল- নির্বাচন প্রতিদ্বন্দ্বিতা ও উৎসবমুখর করতে নৌকার বাইরে কেউ নিজেকে ইলেক্টেবল মনে করলে স্বতন্ত্র নির্বাচন করতে পারবে। এটি করতে গিয়ে কোথাও কোথাও প্রার্থীর সমর্থকরা সংঘাতে জড়িয়েছেন। এটি আমাদের নজরে এসেছে। কেন্দ্র থেকে বলা হয়েছে, সহিংসতায় জড়িতদের ছাড় দেওয়া হবে না। এ নিয়ে আমরা সাংগঠনিকভাবে কাজ করছি। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীও কাজ করছে। আশা করি, সংঘাত কমে আসবে।- এ এইচ এম খায়রুজ্জামান লিটন
পিরোজপুরে স্বতন্ত্র প্রার্থীর সমর্থককে কুপিয়ে হত্যা
পিরোজপুর সদরে স্বতন্ত্র প্রার্থীর কর্মিসভা শেষে বাড়ি ফেরার পথে লালন ফকিরকে ১০-১৫ জন মিলে কুপিয়ে আহত করে। পরে হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় তার মৃত্যু হয়। এ ঘটনার প্রতিবাদে রাতে জেলা আওয়ামী লীগ ও অঙ্গ সংগঠনের নেতারা শহরে বিক্ষোভ মিছিল ও পথসভা করেন। নিহত লালন ফকির (৩২) পিরোজপুর পৌরসভার ৯ নম্বর ওয়ার্ডের ডুমুরিতালা এলাকার হান্নান ফকিরের ছেলে। তিনি পিরোজপুর-১ আসনে স্বতন্ত্র প্রার্থী এ কে এম এ আউয়ালের সমর্থক ছিলেন।
মাদারীপুরে কুপিয়ে স্বতন্ত্র প্রার্থীর সমর্থক খুন, আলাদা বোমা হামলায় আহত ১০
২৩ ডিসেম্বর মাদারীপুরের কালকিনিতে এসকেন্দার খাঁ (৭০) নামে স্বতন্ত্র প্রার্থীর এক কর্মীকে কুপিয়ে হত্যার অভিযোগ উঠেছে নৌকার সমর্থকদের বিরুদ্ধে। এসকেন্দার খাঁ উপজেলার লক্ষ্মীপুর ইউনিয়নের ৮ নম্বর ওয়ার্ড আওয়ামী লীগ সদস্য। তিনি মাদারীপুর-৩ আসনে স্বতন্ত্র প্রার্থী মোসা. তাহমিনা বেগমের সমর্থক ও কর্মী।
আরও পড়ুন>> নির্বাচনী সভা শেষে যুবলীগের দুই গ্রুপের মারামারি, আহত ৩
একই এলাকায় (মাদারীপুরের কালকিনি) ২১ ডিসেম্বর বৃহস্পতিবার স্বতন্ত্র প্রার্থীর মিছিলে বোমা হামলার ঘটনা ঘটে। এতে উভয়পক্ষের ১০ জন আহত হন। মাদারীপুর-৩ আসনের স্বতন্ত্র প্রার্থী তাহমিনা বেগমের পক্ষে ঈগল মার্কার মিছিল বের করেন কর্মী-সমর্থকরা। এসময় নৌকার প্রার্থী ড. আবদুস সোবহান মিয়া গোলাপের লোকজন বাধা দেন। পরে মিছিলে হঠাৎ অর্ধশত হাতবোমা নিক্ষেপের ঘটনা ঘটে।
বরিশালের বানারীপাড়ায় নৌকার প্রার্থীর সামনে সংঘর্ষ
১৮ ডিসেম্বর সোমবার বানারীপাড়া পৌর এলাকায় আওয়ামী লীগের কার্যালয়ের সামনে বরিশাল-২ আসনে নৌকার প্রার্থী রাশেদ খান মেননের সামনে আওয়ামী লীগের দুই পক্ষের মধ্যে মারামারি হয়। এতে বানারীপাড়া উপজেলা আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক সুব্রত লাল কুণ্ড, সাংগঠনিক সম্পাদক ও উপজেলা ভাইস চেয়ারম্যান নুরুল হুদা এবং জুয়েল হাওলাদার আহত হন।
চৌদ্দগ্রামে নৌকা-স্বতন্ত্র প্রার্থীর সমর্থকদের মধ্যে সংঘর্ষ
একই দিন চৌদ্দগ্রামের কাশিনগর বাজারে কুমিল্লা-১১ আসনে নৌকার প্রার্থী মুজিবুল হকের সমর্থকদের সঙ্গে স্বতন্ত্র প্রার্থী সাবেক পৌর মেয়র মিজানুর রহমানের সমর্থকদের সংঘর্ষে দুজন আহত হন। এসময় একাধিক ককটেল বিস্ফোরণের ঘটনাও ঘটে।
স্বতন্ত্র প্রার্থীদের যত অভিযোগ
এছাড়া পাবনা-১ আসনের স্বতন্ত্র প্রার্থী সাবেক অধ্যাপক আবু সাইয়িদ প্রচারণায় নেমে বাধা পেয়ে থানায় অভিযোগ করেন। নেত্রকোনা-৩ আসনে স্বতন্ত্র প্রার্থীর সমর্থকদের ওপর হামলার অভিযোগে নৌকার সমর্থক খোকন মিয়াকে গ্রেফতার করেছে পুলিশ। নাটোরে প্রতীক বরাদ্দের পরই তিনটি সংঘর্ষের ঘটনায় তিন মামলা হয়েছে। শরীয়তপুর-২ আসনে প্রচারণায় বাধা দেওয়া ও তার পোস্টার ছিঁড়ে ফেলার অভিযোগ করেন স্বতন্ত্র প্রার্থী খালেদ শওকত আলী। ব্রাহ্মণবাড়িয়া-৩ আসনে স্বতন্ত্র প্রার্থীর পোস্টার ছিনিয়ে নেওয়ার ঘটনায় নৌকার সমর্থক মঞ্জুর মওলাকে ১০ হাজার টাকা জরিমানা করেছেন ভ্রাম্যমাণ আদালত।
আরও পড়ুন>> রূপগঞ্জে আ’লীগ-স্বেচ্ছাসেবকলীগের সংঘর্ষ, আহত ১০
ময়মনসিংহ-৯ আসনে স্বতন্ত্র প্রার্থীর সমর্থক সাদেক হোসেন ভুইয়াকে বৈঠা দিয়ে পিটিয়েছে নৌকার সমর্থকরা। নাটোরের সিংড়ায় নৌকার সমর্থক ও ঈগলের সমর্থকদের মধ্যে সংঘর্ষে ১১ জন আহত হন। ফরিদপুর-৩ আসনে নৌকার প্রার্থী ও স্বতন্ত্র প্রার্থীর সমর্থকদের মধ্যে মারামারি হয়েছে। যশোর-৫ আসনে নৌকার সমর্থকরা স্বতন্ত্র প্রার্থীর গাড়িবহরে হামলা চালিয়ে ছয়টি মোটরসাইকেল ও দুটি গাড়ি ভাঙচুর করে। এতে আটজন আহত হন। গত বুধবার চট্টগ্রামের সাতকানিয়ায় আওয়ামী লীগের স্বতন্ত্র প্রার্থীর সমর্থক ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) এক চেয়ারম্যানের বাড়ি লক্ষ্য করে গুলি চালানো হয়। এসময় তিনটি গাড়ি ও ওই প্রার্থীর নির্বাচনী ক্যাম্প ভাঙচুর করা হয়।
ঢাকার বাইরে কিছু ঘটনা ঘটে থাকতে পারে। কিন্তু ঢাকায় এমন কোনো ঘটনা ঘটেনি। ঢাকার বাইরের সহিংসতাও কমে আসবে দ্রুতই।-মোস্তফা জালাল মহিউদ্দিন
যা বলছে আওয়ামী লীগ
নির্বাচন ঘিরে এসব বিষয় নজরে এসেছে আওয়ামী লীগ সভাপতির। ২১ ডিসেম্বর ভার্চুয়ালি জনসভায় যুক্ত হয়ে দলীয় নেতাকর্মীদের এ বিষয়ে কঠোর হুঁশিয়ারি দিয়েছেন। শেখ হাসিনা বলেন, ‘৭ জানুয়ারি নির্বাচন এবং সে নির্বাচনে জনগণ অবাধে ভোট দেবেন। ভোটের মালিক জনগণ, এটা তাদের সাংবিধানিক অধিকার। তবে আমরা এ নির্বাচন উন্মুক্ত করেছি, আমাদের নৌকার প্রার্থীও আছে, স্বতন্ত্র প্রার্থীও রয়েছে এবং অন্য দলের প্রার্থীও রয়েছে। আপনারা জনগণের কাছে যাবেন, জনগণ যাকে ভোট দেবেন তিনি নির্বাচিত হবেন। কেউ কারও অধিকারে হস্তক্ষেপ করবে না। এখানে কিন্তু কোনো রকমের সংঘাত বা মারামারি, কোনো কিছুই আমি দেখতে চাই না। কোনো সংঘাত হলে, সংঘাত যদি আমার দলেরও কেউ করে, তাদের কিন্তু রেহাই নেই।’
এ বিষয়ে আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য এ এইচ এম খায়রুজ্জামান লিটন জাগো নিউজকে বলেন, ‘আমাদের সিদ্ধান্ত ছিল- নির্বাচন প্রতিদ্বন্দ্বিতা ও উৎসবমুখর করতে নৌকার বাইরে কেউ নিজেকে ইলেক্টেবল মনে করলে স্বতন্ত্র নির্বাচন করতে পারবে। এটি করতে গিয়ে কোথাও কোথাও প্রার্থীর সমর্থকরা সংঘাতে জড়িয়েছেন। এটি আমাদের নজরে এসেছে। কেন্দ্র থেকে বলা হয়েছে, সহিংসতায় জড়িতদের ছাড় দেওয়া হবে না। এ নিয়ে আমরা সাংগঠনিকভাবে আমরা কাজ করছি। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীও কাজ করছে। আশা করি, সংঘাত কমে আসবে।’
দলটির আরেক প্রেসিডিয়াম সদস্য মোস্তফা জালাল মহিউদ্দিন জাগো নিউজকে বলেন, ‘ঢাকার বাইরে কিছু ঘটনা ঘটে থাকতে পারে। কিন্তু ঢাকায় এমন কোনো ঘটনা ঘটেনি। ঢাকার বাইরের সহিংসতাও কমে আসবে দ্রুতই।’
এসইউজে/এএসএ/এমএস